গত এক সপ্তাহে বেশ কয়েকটি সুখবর এসেছে জাতির জন্য। ড. মুহাম্মদ ইউনূস আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে জানিয়েছেন, রাষ্ট্র সংস্কারে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য ও ভোটার তালিকা তৈরির পর নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হবে। অন্যদিকে রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেছেন, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রয়োজনীয় সংস্কার করে যাতে আগামী দেড় বছরের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে সে ব্যাপারে সরকারের প্রতি সেনাবাহিনীর পূর্ণাঙ্গ সমর্থন থাকবে।
দেশের মানুষ দীর্ঘ পৌনে ১৮ বছর ধরে গণতন্ত্রহীন অবস্থায় রয়েছে। নতুন প্রজন্ম ভোট কাকে বলে, কীভাবে ভোট দিতে হয় সেটিই জানে না। এ অপমানজনক অবস্থা থেকে নিজেরা শুধু নয়, পুরো জাতিকে মুক্ত করতে তারা রাজপথে রক্ত ঝরিয়েছে। এশিয়ার কোনো দেশে গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের জন্য এত মানুষকে প্রাণ হারাতে হয়নি। জুলাই বিপ্লবের পরিণতিতে কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটেছে। গত ৫ আগস্ট থেকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ বৈষম্যহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথে যাত্রা শুরু করেছে বাংলাদেশ। প্রায় দেড় যুগের গণতন্ত্রহীনতায় সাধারণ মানুষ উন্মুখ কখন তারা ভোট দিতে পারবে। জাতিসংঘ সদর দপ্তরে সাধারণ পরিষদের বার্ষিক অধিবেশনের ফাঁকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে বৈঠকে ড. ইউনূস জানিয়েছেন তাঁর সরকারের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা। বলেছেন, ইতোমধ্যে রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতে সংস্কারের সুপারিশ করার জন্য ছয়টি কমিশন গঠন করা হয়েছে। কমিশনের সুপারিশ নিয়ে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে। সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্যে উপনীত হওয়ার পাশাপাশি ভোটার তালিকা তৈরি হলেই নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হবে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশে ফিরে ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেন ড. ইউনূস। ওই সময়ই সরকারের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, দেশে আগে সংস্কার দরকার, তারপর নির্বাচন। নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপি বলেছিল, প্রয়োজনীয় সংস্কারে তারা সরকারকে সময় দিতে প্রস্তুত, তবে সেটি ‘অনির্দিষ্টকালের জন্য নয়।’ এরপর দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসেন অধ্যাপক ইউনূস। সংলাপে নির্বাচনের ‘সময়সীমা’র কোনো প্রসঙ্গ আসেনি।
দেশের মানুষ নির্বাচন নিয়ে যেমন আগ্রহী, তেমন আগ্রহী রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে যে জঞ্জাল জমে উঠছে তা অপসারণেও। রাজনৈতিক দলগুলোও সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে একমত। যে কারণে দেশের গণমানুষের দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আগামী নির্বাচনের পর জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী সব দলকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠনের আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন। যাতে অন্তর্বর্তী সরকারের শুরু করা সংস্কার কার্যক্রম থেমে না থাকে। গত দেড় যুগ অর্থাৎ আওয়ামী লীগের পৌনে ১৬ বছর এবং তার আগের ওয়ান- ইলেভেন সরকারের দুই বছরে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কেঁদেছে। এ সময় বিচারহীনতার সংস্কৃতি বিরাজ করেছে দেশে। দেশের বিচারব্যবস্থা খাতাপত্রে স্বাধীন হলেও পৃথক সচিবালয় না থাকায় প্রতিটি ক্ষেত্রে আওয়ামী আইন মন্ত্রণালয়ের খবরদারির সুযোগ ঘটেছে। যার নির্মম শিকার হয়েছেন বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা। বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার ইতোমধ্যে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। এ-সংক্রান্ত আইন ও বিধিমালা পর্যালোচনায় কয়েকজন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক করতে ঐতিহাসিক গুরুত্ব পাওয়া মাসদার হোসেন মামলার রায় দেওয়া হয়েছিল ১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর। বিচার বিভাগকে বঞ্চনার বেড়াজাল থেকে মুক্ত করতে এবং সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থেকে দেওয়া ওই রায়ে ১২ দফা নির্দেশনা ছিল। রায়ের আলোকে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক ঘোষণা করে। এরপর ১২ দফার মধ্যে দু-এক দফার আংশিক ছাড়া অধিকাংশই বাস্তবায়ন হয়েছে। তবে রায়ের আলোকে বিচার বিভাগের জন্য আলাদা সচিবালয় গঠনসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু নির্দেশনা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। বিচারকদের নিয়োগ, কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি, বরখাস্তকরণ, শৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিষয়ে এখনো সুপ্রিম কোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয়ের দ্বৈত কর্তৃত্ব রয়েছে। গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পালাবদলের পর বিচার বিভাগ ব্যবহার করে বিরোধী মত দমনের অভিযোগ ওঠে শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে। ছাত্র-জনতার আলটিমেটামের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হন তার সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতি। এরপরই মূলত নতুন করে আলোচনায় আসে বিচার বিভাগের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা প্রসঙ্গ। দাবি ওঠে ঐতিহাসিক মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার। গত ১৪ আগস্ট ‘ইয়াং জাজেস ফর জুডিশিয়াল রিফর্ম’ ব্যানারে তরুণ বিচারকরাও ১২ দফা প্রস্তাব দেন। এই ১২ দফার প্রথম দফাতেই ছিল- জেলা পর্যায়ের আদালতগুলোর নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির জন্য সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক ‘সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়’ গঠন এবং মাসদার হোসেন মামলার রায়ে দেওয়া সব নির্দেশনার বাস্তবায়ন।
তরুণ বিচারকদের প্রস্তাব খুবই প্রাসঙ্গিক ও তাৎপর্যপূর্ণ। গত পৌনে ১৬ বছর তাদের ওপর অশুভ প্রভাব বিস্তার করা হয়েছে আইন মন্ত্রণালয় থেকে। আদালত কী করবেন তা সরকার আগে থেকে নির্ধারণ করে দেবে এটা তরুণ বিচারকদের জন্য ছিল বিব্রতকর। গত ২১ সেপ্টেম্বর বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের দেওয়া অভিভাষণে তিনি সুপ্রিম কোর্টের অধীনে বিচার বিভাগে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার কথা বলেন। তাঁর অভিমত, বিচারকদের প্রকৃত স্বাধীনতা ততদিন পর্যন্ত নিশ্চিত হবে না, যতদিন পর্যন্ত বিচার বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান দ্বৈত শাসনব্যবস্থা বিলোপ করে বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা না হবে। পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা হবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকল্পে প্রয়োজনীয় সংস্কারের প্রথম ধাপ। জরুরি ভিত্তিতে এ সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব পাঠানো হবে বলেও জানিয়ে ছিলেন মাননীয় প্রধান বিচারপতি। ওই দিন মঞ্চে উপস্থিত আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলও প্রধান বিচারপতির বক্তব্য সমর্থন করেন। আইন উপদেষ্টার সমর্থনে নিশ্চিত হয়েছে পৃথক সচিবালয় এবার স্বপ্ন নয় বাস্তবে পরিণত হবে। যে সচিবালয় চলবে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনায়। এর ফলে মানুষের ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে। বিরোধী দল দমনের হাতিয়ার হিসেবে কোনো সরকার আদালতকে ব্যবহার করতে পারবে না। গত ১৬ বছর আমরা যারা বিরোধী দলের নেতা-কর্মী তাদের সাজানো মামলার জামিন চাইতে গিয়ে বারবার হতাশার শিকার হতে হয়েছে। আশা করা যায়, সে অবস্থার আর কখনো পুনরাবৃত্তি হবে না বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা পূর্ণাঙ্গতা পেলে।
আমার মতে, দেশের বিচার বিভাগ সভ্য দুনিয়ার অন্যান্য দেশের মতো স্বাধীন হয়ে উঠলে তা হবে সত্যিকারের এক বড় অর্জন। জুলাই বিপ্লব আমাদের রাজনীতিকদের রাজনীতি নিয়ে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। প্রায় ১৮ বছর ধরে অবর্ণনীয় নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছে বিএনপি। কিন্তু আমরা প্রতিহিংসার বদলে সহিষ্ণুতার পথ বেছে নেওয়ার নির্দেশনা পেয়েছি আমাদের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের কাছ থেকে। আমরা বিশ্বাস করি, প্রতিহিংসা নয় বরং গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করে অগণতান্ত্রিক শক্তিকে জবাব দিতে হবে। দেশে যাতে আর কোনো দিন বাকশাল অথবা নব্য বাকশালি কর্তৃত্ববাদের উদ্ভব না হয় তা নিশ্চিত করতে জাতি ধর্ম ভাষা নির্বিশেষে সব বাংলাদেশিকে এক সূত্রে কাজ করতে হবে।
সহিষ্ণুতার শিক্ষা আমরা পেয়েছি শহীদ জিয়ার কাছ থেকে। এ শিক্ষা আমরা পেয়েছি দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কাছ থেকে। জুলাই বিপ্লবের পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বক্তব্যে দেশের সব মানুষের ঐক্যের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি শুধু অন্তর্বর্তী সরকার নয়, আগামী নির্বাচনের পর যে সরকার জনগণের ভোটে ক্ষমতায় আসবে তাদেরও দায়িত্ব হবে জুলাই বিপ্লবের আকাক্সক্ষা পূরণ করা। আর সে আকাক্সক্ষা হলো একটি গণতান্ত্রিক এবং বৈষম্যমুক্ত দেশ ও সমাজ প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করা। গণতান্ত্রিক সমাজে জাতি ধর্ম ভাষা নির্বিশেষে সব মানুষের সহাবস্থান উৎসাহিত করা হয়। কে মুসলমান, কে হিন্দু, কে খ্রিস্টান, কে বৌদ্ধ পার্থক্য নির্ণয় করা হয় না। বৈষম্য না থাকলে দেশের এক প্রান্তের মানুষের সঙ্গে অন্য প্রান্তের মানুষের বিরোধ দানা বেঁধে ওঠার সুযোগ থাকে না।
শহীদ জিয়া উৎপাদনের রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সময়ে বাংলাদেশ মুক্তবাজার অর্থনীতির পথে যাত্রা শুরু করে। গত ৩৩ বছরে দেশ উন্নতির পথে যতটুকু এগিয়েছে তা সম্ভব হয়েছে সর্বস্তরের মানুষের নিরন্তর প্রচেষ্টায়।
দেশের ব্যবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতকে এগিয়ে নিতে মুক্তবাজার অর্থনীতি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত খাতকে নিরুৎসাহিত করে বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করায় জনগণের ট্যাক্সের টাকার অপচয় বন্ধ হয়েছে। অন্যদিকে বেসরকারি খাতের বিকাশের কারণে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে যেখানে শত শত কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হতো সেখানে বেসরকারি খাত হাজার হাজার কোটি টাকা রাজস্ব প্রদান করছে।
দেশের উন্নয়ন নিশ্চিত হচ্ছে। আগামীতে যে দলই ক্ষমতায় যাক, তাদের দায়িত্ব হবে গণতন্ত্রের পথে দেশকে নিয়ে যাওয়া। অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা। মানুষ যাতে দুবেলা পেট ভরে খেতে পারে তা নিশ্চিত করতে বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা। দেশের মানুষ যাতে শান্তিতে ঘুমাতে পারে সেটা নিশ্চিত করা আরও জরুরি। সমাজে নারী-শিশুসহ প্রতিটি মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো ধরনের অবহেলা করা চলবে না।
♦ লেখক : বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব, সাবেক সংসদ সদস্য ও ডাকসু সাধারণ সম্পাদক