শুক্রবার, ২৩ আগস্ট, ২০১৩ ০০:০০ টা
সমরেশ মজুমদারের একান্ত সাক্ষাৎকার

অনিমেষ আবারও গ্রেফতার হবে

সমরেশ মজুমদার। প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি ঔপন্যাসিক। পশ্চিমবঙ্গের মতো এ দেশের পাঠকের কাছেও তিনি সমান জনপ্রিয়। উত্তরাধিকার, কালবেলা ও কালপুরুষ তার অন্যতম উপন্যাস-ত্রয়ী। এ ছাড়া বেশ কিছু সফল টিভি সিরিয়ালেরও কাহিনীকার। গত মঙ্গলবার ঢাকায় এসেছেন সমরেশ মজুমদার। কথা বলেছেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে। করেছেন স্মৃতিচারণ। জানিয়েছেন তার সমসাময়িক লেখালেখি ও অন্যান্য বিষয়ের কথা। বিশেষ এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন- শামছুল হক রাসেল

অনিমেষ আবারও গ্রেফতার হবে

কেমন আছেন?

সব মিলিয়ে ভালোই আছি। এ ছাড়া এখানে এলে কোনো পার্থক্য মনে করি না। কারণ বাংলাদেশের পাঠকরা আমাকে খুব ভালোবাসে। এখানকার আতিথেয়তা আমাকে খুব মুগ্ধ করে। মনে হয় নিজ শহরেই আছি।

তা এখন কি নিয়ে ব্যস্ত আছেন? মানে নতুন কোনো লেখালেখি বা উপন্যাস সামনে আসবে কি?

আসলে উত্তরাধিকার, কালবেলা ও কালপুরুষ আমার লেখালেখি জীবনে ওতপ্রোতভাবে মিশে গেছে। এই উপন্যাস-ত্রয়ীর জনপ্রিয়তা ও পাঠকদের ভালোবাসা মাথায় রেখে এই সিরিজের আরও একটি উপন্যাস সম্প্রতি শেষ করলাম। এখন প্রুভের কাজ চলছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, উপন্যাসের প্রুভ আমি নিজে খুব একটা দেখি না। কিন্তু এবারের বেলায় পুরোপুরি ব্যতিক্রম। নিজেই প্রুভ দেখছি। কারণ এবারের কাহিনী পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি-নির্ভর। নাম দিয়েছি 'মৌষলকাল'। মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের পর যে প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছিল তা তুলে ধরেছি এখানে। অন্যভাবে বলতে গেলে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন সমস্যা ও রাজনৈতিক বেড়াজাল তুলে ধরেছি। বলতে পারেন, এ উপন্যাসটি হবে আরেকটি ড্রিম প্রোজেক্ট। উপন্যাসের পটভূমি পশ্চিমবঙ্গের দুই মেয়াদের দুই সরকারের সময়কালীন। কাহিনীর শুরু ২০০৮ সাল থেকে। অর্থাৎ যখন ক্ষমতায় ছিল বামফ্রন্ট। আর শেষ হয়েছে বর্তমান সময়ে। ক্ষমতায় তৃণমূল কংগ্রেস।

আপনার এই ড্রিম প্রজেক্টের চরিত্র ও পটভূমি নিয়ে আরও কিছু বলুন।

যেহেতু সেই উপন্যাস-ত্রয়ীর ধারাবাহিকতায় এই উপন্যাস, তাই চরিত্রগুলোও আগের। কালবেলার সেই মাধবীলতার চরিত্রটি এখানে পাওয়া যাবে। কিন্তু পাঠকরা পাবেন ৭০ বছর বয়সী সেই মাধবীলতাকে। আরও অনেক চরিত্রই এখানে পাওয়া যাবে যেটা কালবেলারই অংশ। তবে সবাই বয়সের ভারে ন্যুব্জ। ঠিক তেমনি অনিমেষকেও পাওয়া যাবে। আর আগের কাহিনীর মতো এখানেও গ্রেফতার হবে অনিমেষ। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির অনেক কিছুই খুঁজে পাওয়া যাবে এই 'মৌষলকালে'। বামফ্রন্টের দুর্গে আঘাত করে ক্ষমতায় এসেছে তৃণমূল কংগ্রেস। এখানে দিন বদলের কিছুই হয়নি, হয়েছে জামাবদল। অর্থাৎ সেই আগের চিত্র। সেই আগের রাজনীতি। রাজনীতির এসব উত্থান-পতন নিয়েই এ উপন্যাসের পটভূমি। আশা করি খুব শীঘ্রই পাঠকদের হাতে পেঁৗছবে এটি। হয়তো পুজোর আগে নয়তো পরে।

একটু পেছনে ফেরা যাক; আপনার লেখালেখির শুরুটা কিভাবে?

বলতে পারেন অপ্রত্যাশিতভাবেই এ জগতে প্রবেশ করেছি। আমার বয়স তখন ২২ কি ২৩। থিয়েটার করতাম। বলতে পারেন অভিনয় নিয়ে মেতে থাকতাম। আমাদের গ্রুপের জন্য একবার একটা স্ক্রিপ্টের প্রয়োজন পড়ল। তা আমার এক বন্ধু বলল, 'তুই লেখ, চেষ্টা করলে ভালো কিছু করতে পারবি।' বন্ধুর কথায় সায় দিয়ে নাটক লিখলাম। কিন্তু সেটা মনঃপুত না হওয়ায় আমাকে গল্প লিখতে বলল। যেই কথা সেই কাজ। আমিও নাটকটিকে গল্পে রূপান্তর করলাম। প্রথমে দেশ পত্রিকায় ছাপানোর জন্য পাঠালাম। কিন্তু ছাপানো হয়নি। আমার লেখা না ছাপানোর কারণে সেই বন্ধু ওই পত্রিকার সম্পাদকের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করল। অবশেষে কাগজে ছাপালাম। সেখান থেকে আমাকে ১৫ টাকা দেওয়া হলো। আমি তো মহাখুশি। বন্ধুরাও পারে তো আমাকে মাথায় তুলে ফেলতে। ওই টাকা নিয়ে সবাই মিলে গেলাম কফি হাউসে। কফির কাপে ধোঁয়া উড়িয়ে চুটিয়ে আড্ডা মারলাম। বন্ধুরাও বলল, 'তুই আবার লেখ, তাহলে আবার টাকা পাবি।' আমিও কফি খাওয়ার লোভে আবার লিখলাম। এবার দেওয়া হলো ৫০ টাকা। সেখান থেকে ২৫ টাকা খরচ করে কফির সঙ্গে জলখাবারও খেলাম। বলতে পারেন কফির দাম মেটাতেই লেখালেখি শুরু করি।

উত্তরাধিকার, কালবেলা এবং কালপুরুষ আপনার উপন্যাস-ত্রয়ী। এ সম্পর্কে কিছু বলুন।

এই তিনটির মধ্যে প্রথম দুটি অনেকটা জোর করে লেখা। মন থেকে লিখিনি। বলতে পারেন বাধ্য হয়েই লিখেছি। সেই সময় আমার বয়স ৩১ কি ৩২। হঠাৎ করে পত্রিকা অফিস থেকে ফোন এলো। বলা হলো, লেখালেখি শুরু করতে। কিন্তু কিভাবে শুরু করব তা মাথায় আসছিল না। বলা হলো, নিজেকে নিয়ে লিখতে। তবে আমি যেন থেকেও সেখানে না থাকি। আমার দেখা জীবনী নিয়ে শুরু করে দিলাম উপন্যাস। আর সেটা হয়ে গেল উত্তরাধিকার। লেখার পর গোটা পশ্চিমবঙ্গে হৈচৈ পড়ে গেল। বয়ে গেল সমালোচনার ঝড়। বিশেষ করে রাজনৈতিক চাপটা বেশি ছিল। সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশক আমাকে বলল উত্তরাধিকারকে কাউন্টার দিতে। আরেকটা লেখা লিখতে, যা দিয়ে রাজনৈতিক চাপটাকে দমানো যায়। তাই উত্তরাধিকারের কারণে কালবেলাও লেখা হয়ে গেল। এর পর লিখলাম কালপুরুষ। এখন মনে হয়, চাপে পড়ে লিখেছি বলেই এগুলো এত গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল।

কোনটি সেরা_ মাধবীলতা, নাকি দীপাবলি?

কেউ কেউ বলেন কালবেলা আমার সর্বাধিক পঠিতব্য উপন্যাস। আবার কেউ বলেন সাতকাহন। আমার মনে হয়, এর উত্তর সাতকাহনই হবে। এ উপন্যাসটি আমার জীবনের অভূতপূর্ব সাড়া এনে দিয়েছিল। এটি বেরুনোর পর পশ্চিমবাংলা এবং বাংলাদেশ থেকে অনেক পাঠক আমাকে চিঠি লিখেছেন। এমনকি কোনো কোনো মেয়ে জানিয়েছে, তারা দীপাবলি হতে চায়। তাদের আদর্শ সাতকাহনের দীপাবলি। এটিই তো একজন লেখকের বড় পাওয়া। অন্যদিকে মাধবীলতা চরিত্রটি পুরুষদের মনে বেশি দাগ কেটেছে। কারণ এই চরিত্রটি কাল্পনিক। আর কাল্পনিক বা ছায়াকে পুরুষরা বেশি পছন্দ করে। সবাই চায় কল্পনার জগতে চড়ে বেড়াতে। এ ধরনের যে কোনো ছায়া পুরুষের মনে সবচেয়ে বেশি দাগ কাটে। তাই মাধবীলতা চরিত্রটি পুরুষের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য। অন্যদিকে দীপাবলি চরিত্রটি বাস্তব ও সংগ্রামী। যা মেয়েদের ক্ষেত্রে বেশি প্রযোজ্য। সমাজের অনেক কঠিন বাস্তবতা খুঁজে পাওয়া যায় এ চরিত্রে। তাই তো তারা একে আদর্শ হিসেবে নিয়েছে। মাধবীলতা ও দীপাবলিকে নিয়ে পাঠকদের এই আগ্রহ বেশ উপভোগ করি। একজন লেখকের এটাই তো পরম পাওয়া।

শুনেছি কোনো একটি মেয়েকে দেখে দীপাবলি চরিত্রটি সৃষ্টি করেছিলেন। এ সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?

আমি ১১ বছর বয়সী এক বিধবা মেয়ে দেখেছিলাম। সে আমাদের চা বাগানে কাজ করত। তাকে দেখে প্রায় মনে হতো, এত সুন্দর ফুটফুটে একটি মেয়ে কেন এভাবে হারিয়ে যাবে? কেন শেষ হয়ে যাবে? কেন ম্লান হবে তার জীবন? এর কোনো উত্তরই খুঁজে পাইনি। সাতকাহন লেখার সময় সেই মেয়েটিকেই আমি আমার মতো করে রূপ দিয়েছি। তাকে সমাজ সংসারে বড় করে ফুটিয়ে তুলেছি। বানিয়েছি তাকে সংগ্রামী। দাঁড় করিয়েছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে। মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছি বিভিন্ন বাধা ও প্রতিকূলতার। এভাবেই চরিত্রটি উঠে আসে। সময়ের পরিক্রমায় এ চরিত্রকেই কাছে টেনে নিয়েছে এখনকার সংগ্রামী মেয়েরা। মেনেছে আদর্শ। শুনেছি অনেকেই নাকি দীপাবলি হওয়ার স্বপ্ন দেখে।

রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। তারপরও জানতে চাই, আপনার জীবনে তার ছায়া বা তার সম্পর্কে আপনার ভাবনা।

রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পগুলো আমার সবচেয়ে প্রিয়। আমি ২২ বছর বয়সে যখন 'শেষের কবিতা' পড়ি, তখন তো রোমাঞ্চে থাকতাম। অনেকটা পুলকিত মন নিয়ে চিন্তা করতাম। মনে মনে অমিত রায় হয়ে গিয়েছিলাম। রাতে স্বপ্ন দেখতাম। অনেক ডায়ালগও মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। তখন ভাবতাম, কি অসাধারণ লেখা। কিন্তু ৫৫ বছর বয়সে 'শেষের কবিতা' পড়ে আমি দেখলাম এর কাহিনী পুরোটাই কাল্পনিক। চরিত্রগুলো বানানো। তিনি এই বানানো চরিত্রগুলো পাঠককে বিশ্বাস করাতে পেরেছিলেন। তিনি যেমন লিখেছেন, 'তব দয়া করে ধুতে হবে জীবন আমার', 'আমার এ জীবন ধুতে হবে মুছতে হবে' কিংবা 'দিনের সব তারাই আছে রাতের আলোর গভীরে'। এ সব কথাগুলো তিনি পাঠকদের বিশ্বাস করাতে পেরেছিলেন। এখনো সেসব কাহিনী চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আমার ঘরে রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য বই রয়েছে। এমনকি আমার বিছানাতেও সব সময় পড়ে থাকে তার বেশ কয়েকটি বই। মনে হয়, আমি যেন রবীন্দ্রনাথের পাশেই শুয়ে আছি।

বাংলা সাহিত্যকে বিশেষ করে বাংলা ভাষার বইকে এখনো সেভাবে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া যায়নি। কিভাবে বাংলা বইয়ের সাম্রাজ্যকে আরও বিকশিত করা যায়?

শুধু ব্যক্তিগত বা প্রতিষ্ঠানগত অগ্রগামী দিয়ে এ যুদ্ধে জয়ী হওয়া যাবে না। এ ছাড়া অনুবাদের ওপর জোর দিতে হবে। বিভিন্ন ভাষাভাষী পাঠকের হাতে পেঁৗছে দিতে হবে বাংলা ভাষার বই। এ জন্য যারা ভিন্ন ভাষায় দক্ষ তাদের দিয়ে বাংলা ভাষার সেরা রচনাগুলোর অনুবাদ করা যেতে যারে। আমাদের দুই বাংলার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে অনুবাদ বই বের হচ্ছে কিন্তু সেসব অনুবাদের মান নিয়ে নানা সময় প্রশ্ন ওঠে। তবে আমার বিশ্বাস বাংলা ভাষায় রচিত অনেক গুরুত্বপূর্ণ রচনা রয়েছে, যেগুলো সূচারু অনুবাদ হলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ সম্ভব। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজার সৃষ্টির জন্য প্রচারণা দরকার। বাংলা বইয়ের ক্ষেত্রে সেটি খুব বেশি হয় না। বাংলাদেশের বাইরে বহু মানুষ বাংলা বই পড়েন। নিউইয়র্ক, জার্মানি, কানাডাসহ পৃথিবীর নানা জায়গায় বাংলা বইয়ের মেলা হয়। সেখানে আমাদের প্রবাসীরা প্রচুর বই কিনেন। আমার মনে হয়েছে, বাংলাদেশে যত মানুষ বই পড়েন, তার চেয়ে তিন গুণ পাঠক বিদেশে রয়েছেন। তারা নিয়মিত বই পড়েন। বলতে পারেন, তাদের প্রত্যেকের বাড়ি এক একটি পাঠাগার। এ বিষয়টি এখান থেকে উপলব্ধি করা যায় না। দেশের বাইরে গেলে বোঝা যায়; কিন্তু দুর্ভাগ্য আমরা তাদের কাছে আমাদের বই পেঁৗছে দিতে পারি না। তাদের হাতে আমাদের বই পেঁৗছে দিতে হবে। তা হলেই বিস্তৃত হবে পাঠকের পরিধি। ছড়িয়ে পড়বে বাংলা ভাষার বই। সৃষ্টি হবে নতুন পাঠককুল।

বর্তমান প্রজন্মের লেখা আপনার কেমন লাগে? নতুনদের লেখালেখি সম্পর্কে কিছু বলুন।

তরুণদের লেখায় আমি নানা বৈচিত্র্য খুঁজে পাই। তাদের লেখায় খুঁজে পাই ছন্দ। তাদের বিভিন্ন বিষয়ে আগ্রহ দেখে ভালো লাগে। এ আগ্রহের মাত্রাকে বাড়াতে হবে। পাঠক চারপাশের মানুষের কথা জানতে চায়। পড়তে চায় বাস্তব ও বর্তমান চিত্র। তাই সমাজের চালচিত্র তুলে ধরতে হবে লেখনীতে। তবে তথ্যমূলক সাহিত্য আমাকে প্রভাবিত করে না। এবং তাতে আমার আসক্তি নেই। নতুনদের মানুষের আরও কাছে যেতে হবে। লেখার ভাঁজে ভাঁজে থাকতে হবে মমতা ও দরদ। আমি বিশ্বাস করি, তরুণদের হাত ধরে আমাদের সাহিত্য অনেক এগিয়ে যাবে। সবচেয়ে বড় কথা এ প্রজন্মের ওপর আস্থা রাখতে হবে। তাদেরও সুযোগ দিতে হবে। তা হলেই তারা এগিয়ে যাবে। ছড়িয়ে দেবে বাংলা সাহিত্যকে।

 

 

 

সর্বশেষ খবর