শুক্রবার, ১ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

সর্বাধিক খেতাবপ্রাপ্ত খলিফা হজরত আলী (রা.)

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

সর্বাধিক খেতাবপ্রাপ্ত খলিফা হজরত আলী (রা.)

কুফা মসজিদ

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) স্বয়ং নাম রাখেন ‘আলী’ (রা.)

কথিত আছে, জন্মের পর পুরুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম হজরত আলী (রা.)-কে কোলে তুলে নেন স্বয়ং মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এবং তাঁর নাম আলী (রা.) বলে ঘোষণা করেন, যার অর্থ সম্মানিত বা মহিমান্বিত। এখানে উল্লেখ্য, কুরাইশ বংশের নেতা আবদুল মুতালিবের সন্তানদের মধ্যে তাঁর এক পুত্র আবু তালিবের ঘরে হজরত আলী (রা.)-এর জন্ম। আর অপর পুত্র আবদুল্লাহর ঘরে জন্মগ্রহণ করেন স্বয়ং মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। তাই জন্মসূত্রে হজরত আলী (রা.) ছিলেন হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর চাচাতো ভাই, মাতৃগর্ভে থাকাকালে বাবার মৃত্যু এবং মাত্র ৬ বছর বয়সে মাকে হারানোর ফলে দাদা আবদুল মোতালিবের কাছে বড় হন হজরত মুহাম্মদ (সা.)। দাদাকে হারানোর পর তাঁর ঠাঁই হয় চাচা আবু তালিবের ঘরে, যেখানে জন্ম নেন হজরত আলী (রা.)। অন্যদিকে হজরত আলী (রা.) বিভিন্ন কারণে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ঘরে বড় হন। হজরত মুহাম্মদ (সা.) এবং তাঁর স্ত্রী হজরত খাদিজা (রা.) ৫ বছর বয়স থেকে হজরত আলী (রা.)-কে পরম যতেœ লালন করেন।

 

পবিত্র কাবাঘরে জন্ম

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে যেসব অনুসারী স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেতাব পেয়েছিলেন হজরত আলী বিন আবু তালিব (রা.)। তাঁর জন্ম তৎকালীন আরব বিশ্বের মর্যাদাপূর্ণ কুরাইশ বংশের বানু হাশিম গোত্রে। তাঁর মা ফাতিমা বিনতে আসাদও ছিলেন বানু হাশিম গোত্রীয়। তাই গোত্র সূত্রে তিনি ছিলেন কাবাঘরের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হজরত ইব্রাহিম (আ.) এবং তাঁর পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)-এর ধারক ও বাহক। বংশ মর্যাদাগুণে হজরত আলী (রা.)-এর পিতা আবু তালিব ছিলেন কাবাঘরের সংরক্ষক। এই কাবাঘরে তখন মূর্তিপূজা হলেও ছোটবেলা থেকেই হজরত আলী (রা.) মূর্তিবিমুখ ছিলেন। পরবর্তীতে তাঁর হাতেই কাবাঘরের মূর্তি অপসারিত হয় এবং কোরাইশ বংশ ও বানু হাশিম গোত্র ইসলামের ইতিহাসে মর্যাদার আসনে আসীন হয়। এই কাবাঘর চত্বরেই ৬০১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর হজরত আলী (রা.)-এর জন্ম, যা বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ বলে মনে করে ‘শিয়া সম্প্রদায়’। তাই তাঁর একটি খেতাব হলো ‘আওলাদ আল কাবা’ অর্থাৎ ‘কাবার শিশু’ বা ‘কাবার সন্তান’।

 

পুরুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম ইমান আনেন

হজরত মুহাম্মদ (সা.) ৪০ বছর বয়সে হেরা পর্বতের গুহায় নবুয়তপ্রাপ্ত হন এবং ৪৩ বছর বয়স থেকে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। নবুয়ত প্রাপ্তির অলৌকিক ঘটনা বিশ্বাস করে বিনা প্রশ্নে সর্বপ্রথম ইমান আনেন তাঁর স্ত্রী হজরত খাদিজা বিনতে খালিদ (রা.)। তাঁর পরপরই ইমান আনেন হজরত আলী (রা.)। ইতিহাসবিদ সৈয়দ আলী আসগর রাজী তাঁর ‘এ রিজস্টেটমেন্ট অব ইসলাম অ্যান্ড মুসলিমস’ গ্রন্থে বর্ণনা করেন যে, পবিত্র কোরআন এবং হজরত আলী (রা.) সমান্তরালভাবে হজরত মুহাম্মদ (সা.) এবং মা খাদিজাতুল কুবরা (রা.)-এর ঘরে পরিপূর্ণতা লাভ করেন। হজরত মুহাম্মদ (সা.) যখন ইসলাম প্রচার শুরু করেন, তখন হজরত আলী (রা.)-এর বয়স মাত্র নয় বছর। এ সময় হজরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর নিজ গোত্র বানু হাশিমের একটি অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে মূর্তিপূজার বদলে এক আল্লাহ এবং তাঁর রসুলের প্রতি ইমান আনার আহ্বান জানান। এতে কেউ সাড়া না দিয়ে বরং বিরোধিতা করে। একে একে এমন তিনটি আহ্বানে কেউ সাড়া না দিলেও একমাত্র হজরত আলী (রা.) সাড়া দেন এবং বিনা প্রশ্নে ইসলাম গ্রহণ করেন। ফলে আবেগাপ্লুত হজরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরেন এবং তাঁর উত্তরসূরি ও প্রতিনিধি (উজির) ঘোষণা করেন। পরিবার এবং নিজ গোত্র থেকে প্রবল বাধা এলেও হজরত আলী (রা.) ছিলেন অনড়।

 

হজরত ফাতেমা (রা.)-এর সঙ্গে বিবাহ

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরত করার পর মক্কায় অবস্থানকারী তাঁর নিকটাত্মীয়দের জীবনেও ঝুঁকি নেমে আসে। এ সময় হজরত আলী (রা.) হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পরিবারের পাশে থাকেন। নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে তিনি তাঁর মা ফাতেমা বিনতে আসাদ, হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কন্যা ফাতেমা বিনতে মুহাম্মদ (সা.) এবং অপর দুজন নারীসহ মদিনায় গমন করেন। মদিনায় পৌঁছার পর হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মধ্যস্থতায় এবং তাঁর অপর দুজন স্ত্রী মা আয়েশা (রা.) ও মা উম্মে সালমা (রা.)-এর আতিথেয়তায় হজরত আলী (রা.) এবং হজরত ফাতেমা (রা.)-এর বিবাহ সম্পন্ন হয়। মুসলমানদের কাছে উভয়েই পবিত্র এবং স্বর্গীয় মহিমার প্রতীক। তাদের দুই পুত্র ইমাম হাসান (রা.) ও ইমাম হোসেন (রা.) পরবর্তীতে শাহাদাতবরণ করেন। হজরত আলী (রা.) এবং হজরত ফাতেমা (রা.)-এর বিবাহিত জীবন প্রায় ১০ বছর স্থায়ী হয় এবং হজরত ফাতেমা (রা.)-এর অকাল মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয়।

 

মহানবী (সা.) এর নিরাপত্তা বিধানে জীবনের ঝুঁকি

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) দীর্ঘ প্রায় নয় বছর মক্কাবাসীকে ইসলামের পথে ও সত্যের পথে আহ্বান জানান। কিন্তু বংশগত ঐতিহ্য এবং গোঁড়ামি ছেড়ে তাদের অধিকাংশই এই আহ্বানে সাড়া না দিয়ে বরং তাঁকে প্রতিহত করে। ৬২২ সালে পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, মক্কায় অবস্থান হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনের প্রতি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। ফলে তিনি মক্কা ছেড়ে মদিনায় গমনের সিদ্ধান্ত নেন, যা ইতিহাসে ‘হিজরত’ নামে পরিচিত। সত্যবাদিতার জন্য ‘আল আমিন’ বা বিশ্বাসী হিসেবে পরিচিত হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে এ সময় অনেক সম্পদ আমানত রেখেছিলেন মক্কাবাসী। হজরত মুহাম্মদ (সা.) জমাকারীদের কাছে তা ফেরত দেওয়ার জন্য তাঁর আস্থাভাজন হজরত আলী (রা.)-কে বুঝিয়ে দেন, যা যথাযথভাবে প্রাপকের কাছে বুঝিয়ে দেন হজরত আলী (রা.)। নির্দিষ্ট রাতে শত্রুর চোখ ফাঁকি দেওয়ার জন্য হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বিছানায় চাদরমুড়ি দিয়ে শুয়েছিলেন হজরত আলী (রা.)। শত্রুদের পরিকল্পনা মোতাবেক রাতে কাউকে হত্যা করা কাপুরুষোচিত হবে বিধায় রাত পোহানো মাত্র বিছানা বা ঘরে থাকা হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে হত্যার কথা ছিল। নিশ্চিত মৃত্যুঝুঁকি সত্ত্বেও হজরত আলী (রা.) শত্রুকে ফাঁকি দিয়ে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নিরাপত্তা বিধানের জন্য ঘরে অবস্থান করেন এবং চাদরমুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকেন। তফসিরবিদদের মতে, হজরত আলী (রা.)-এর এই আত্মত্যাগের প্রতি ইঙ্গিত করে সূরা বাকারার ২০৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে যে, আর এমন লোকও আছে, যে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জীবন সমর্পণ করে দেয়। আর আল্লাহ তো তাঁর বান্দাদের অনেক দয়া করেন।

 

জুলফিকার, আলী ও হায়দার

জুলফিকার আলী হায়দার বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ মুসলিম বিশ্বে একটি জনপ্রিয় নাম। ইতিহাস মতে, বিভিন্ন যুদ্ধে হজরত আলী (রা.) একটি বিশেষ তরবারি ব্যবহার করতেন। যা জুলফিকার নামে পরিচিতি পায়। একটি হাতলের সঙ্গে সংযুক্ত দুটি ধারালো তরবারি ব্যবহার করতেন হজরত আলী (রা.), যা আজও জুলফিকার নামে সমাদৃত। মহররমের সময় শিয়া সম্প্রদায় আজো এই তরবারির প্রতিকৃতি বহন করে এবং পতাকার মাঝে এই তরবারি আঁকে। হজরত আলী (রা.)-এর আরেকটি খেতাব হলো ‘হায়দার’। আরবিতে সিংহের একাধিক নামের একটি হলো হায়দার। তা ছাড়াও সাহসী বা সাহসী হৃদয় বোঝাতেও হায়দার শব্দটি ব্যবহৃত হয়। মুসলিম সৈন্যরা যুদ্ধ শুরুর আগে রণহুঙ্কার হিসেবে অথবা সম্মুখযুদ্ধে শত্রুর ওপর চূড়ান্ত আঘাত হানার আগে উচ্চস্বরে ‘হায়দার’ শব্দটি উচ্চারণ করে নিজেদের মনোবল বৃদ্ধি ও শত্রুর মনে ভয় ধরানোর উদ্দেশ্যে।

 

৫ বছরের শাসনকাল

৬৫৬ সালে মদিনা ও আরববিশ্বে তথা মুসলিমদের মাঝে নানা বিষয়ে মতভেদ দেখা দেয় এবং বেশ কিছু বিদ্রোহী দল ও উপদল সৃষ্টি হয়। এসব দল বা উপদলের মধ্যে দ্বন্দ্ব-ফ্যাসাদ একটি নৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়। এমনি এক প্রেক্ষাপটে ৬৫৬ সালের ১৭ জুন ইসলামের তৃতীয় খলিফা হজরত ওসমান ইবনে আফফান তাঁর নিজ কক্ষে একদল বিদ্রোহী মিসরীয় সেনার হাতে শাহাদাতবরণ করেন। এ সময় মসজিদে নববীতে মুসলিমদের সমাবেশে পরামর্শক্রমে হজরত আলী (রা.)-কে ইসলামের চতুর্থ খলিফার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাঁর শাসনকাল ছিল রাজনৈতিক ও সামরিক দুর্যোগপূর্ণ। পদে পদে তাঁকে যুদ্ধ, বিদ্রোহ, ষড়যন্ত্র, উগ্রবাদ, হানাহানি, দুর্নীতিসহ নানাবিধ জটিলতা মোকাবিলা করতে হয়। মুসলিমদের মাঝে ঐক্য ফিরিয়ে আনতে তিনি আপ্রাণ চেষ্ট করেন। মালিক আল আস্তারকে মিসরের শাসক নিয়োগ করে হজরত আলী (রা.) প্রশাসন পরিচালনায় রীতি-নীতি বিষয়ে একটি নির্দেশনামূলক চিঠি প্রদান করেন। এই চিঠি যুগে যুগে প্রশাসন পরিচালনার মূলমন্ত্র বা সংবিধান হিসেবে বিবেচিত হয়। আজও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রশাসনিক একাডেমিতে এই চিঠি নিয়ে আলোচনা হয়।

 

রণাঙ্গনে বীরত্ব ও ‘আসাদুল্লাহ’ খেতাব লাভ

ইসলাম প্রচারের প্রাথমিক দিনগুলোতে তাবুকের যুদ্ধ ব্যতীত অবশিষ্ট সব যুদ্ধে সাহসিকতাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করেন হজরত আলী (রা.)। তবে তাঁর বীরত্বের কথা সর্বাধিক প্রচারিত হয় বদরের যুদ্ধে। এ সময় মূল যুদ্ধ শুরুর আগে প্রচলিত প্রথা মোতাবেক মুসলিমদের পক্ষে তিনজন এবং অমুসলিমদের পক্ষের তিনজন সেরা যোদ্ধা একে অপরকে ঘায়েলে সচেষ্ট হন। মুসলিমদের পক্ষে এ সময় হজরত আলী (রা.) মাত্র ২৩ বছর বয়সে অমুসলিম মক্কা বাহিনীর শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা ওয়ালিদ ইবনে উৎবাকে পরাজিত করেন। শুরুতেই হজরত আলী (রা.)-এর বীরত্ব ও জয়লাভ সমগ্র যুদ্ধ জয়ে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। তাই হজরত আলী (রা.)-এর সম্মুখযুদ্ধে জয়কে ইসলামের জয়যাত্রার শুভ সংকেত গণ্য করা হয়। বদরের যুদ্ধের পরের বছর (৬২৫ সাল) মদিনার নিকটবর্তী ওহুদের ময়দানে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। এ ক্ষেত্রেও চূড়ান্ত যুদ্ধের পূর্বে সেরা যোদ্ধাদের দ্বৈরথে হজরত আলী (রা.) শুরুতেই তরবারির আঘাতে অমুসলিম মক্কা বাহিনীর শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা ও পতাকাবাহী তালহা ইবনে আবি তালহা আল আবদারিকে হত্যা করেন। পরবর্তীতে দুই বাহিনীর সরাসরি যুদ্ধে হজরত আলী (রা.) বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। বিশেষত যুদ্ধের এক পর্যায়ে মুসলমানদের একটি অংশ হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আদেশের অপেক্ষা না করে তাদের অবস্থান ত্যাগ করলে শত্রুরা দ্রুত মুসলিম বাহিনীর অবস্থানে ঢুকে পড়ে এবং যে কোনো মূল্যে হজরত মুহাম্মদ (সা.) কে হত্যার চেষ্টা চালায়। এ সময় হজরত আলী (রা.) জীবন বাজি রেখে অসীম সাহসিকতায় সব আক্রমণ রুখে দেন এবং মহানবী (সা.)-এর জীবন রক্ষায় দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেন। ওহুদের যুদ্ধের দুই বছর পর সংঘটিত হয় খন্দকের যুদ্ধ (৬২৭ সাল)। এই যুদ্ধেও হজরত আলী (রা.) মুসলিম বাহিনীর পক্ষে মূল যুদ্ধ শুরুর আগে সেরাদের দ্বৈরথে অংশ নেওয়ার দায়িত্ব পান। তাঁকে দায়িত্ব দিয়ে হজরত মুহাম্মদ (সা.) হজরত আলী (রা.)-এর প্রশংসা করেন এবং দোয়া করেন। অন্যদিকে মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যা করতে তখন মরিয়া ছিলেন অমুসলিম সেনাপতি আমির ইবনে আব্দাল উদ। কথিত আছে, যুদ্ধে পারদর্শিতাঁর জন্য আমির ইবনে আব্দালকে অমুসলিমরা ১০০০ সৈন্যের সমতুল্য মনে করতেন। তাঁকে মোকাবিলার জন্য হজরত আলী (রা.) এগিয়ে এলে আমির ইবনে আব্দাল তাচ্ছিল্য করে তাঁকে ফিরে যেতে বলেন। কিন্তু হজরত আলী ছিলেন অকুতোভয় এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তিনি তাঁকে ইসলাম গ্রহণ অথবা যুদ্ধ করার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। ফলে যুদ্ধ শুরু হয়। মরুভূমির বালু ওড়ার কারণে যুদ্ধের জয়-পরাজয় বোঝার উপায় ছিল না। এই ধূলিময় অস্পষ্ট স্থানে ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনিত হলে সবাই নিশ্চিত হয় ১০০০ যোদ্ধার সমান বিবেচিত আমির ইবনে আব্দাল পরাজিত তথা মৃত্যুবরণ করেছেন হজরত আলী  (রা.)-এর হাতে। এতে ভীতসন্ত্রস্ত শত্রুরা পিছু হটে। এই যুদ্ধের পরই হজরত মুহাম্মদ (সা.) স্বয়ং হজরত আলী (রা.)-কে ‘আসাদুল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহর সিংহ উপাধি দেন। তিনি আরও বলেন যে, হজরত আলী (রা.) কর্তৃক আমির ইবনে আব্দাল উদকে আঘাতের মূল্য সমগ্র মানব ও জিন জাতির কেয়ামত পর্যন্ত এবাদতের মূল্যের চেয়েও বেশি। খন্দকের যুদ্ধের তিন বছর পর ৬৩০ সালে হুনায়নের যুদ্ধ হয়। মক্কা থেকে তায়েফগামী রাস্তার পাশে ইসলামের দীর্ঘদিনের শত্রু একদল বেদুইন উপজাতির সঙ্গে এই যুদ্ধের এক পর্যায়ে লুকিয়ে থাকা শত্রুরা অতর্কিতে মুসলিমদের ওপর আক্রমণ করে। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল হজরত মুহাম্মদ (সা.)। তাই মহানবী (সা.)-কে লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো পাথর ছুড়তে থাকে শত্রুরা। এ সময় অন্য কয়েকজনের সঙ্গে হজরত আলী (রা.) হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নিরাপত্তায় নিজ শরীর দিয়ে বর্ম তৈরি করেন। এভাবে ইসলামের সুরক্ষা, প্রচার ও প্রসারে যুদ্ধ করার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখেন হজরত আলী (রা.)।

 

পতাকা বহনের গৌরব

ইসলামের ইতিহাস এবং প্রাচীন ঐতিহ্যে যুদ্ধক্ষেত্রে পতাকা বহন করা যে কোনো যোদ্ধা বা সেনাপতির জন্য অনন্য গৌরবের বিষয়। একটি দেশ বা সম্প্রদায়ের প্রধান তাঁর সবচেয়ে আস্থাভাজন এবং তাঁর বিবেচনায় শ্রেষ্ঠ সেনাপতির হাতে তাঁর দেশ বা সম্প্রদায়ের পতাকা তুলে দিয়ে যুদ্ধে পাঠান। খন্দকের যুদ্ধের আগে ইসলামের পতাকা হজরত আলী (রা.)-এর হাতে তুলে দেওয়ার আগে হজরত মুহাম্মদ (সা.) মন্তব্য করেন যে, আমি এমন একজনের হাতে পতাকা তুলে দেব, যিনি আল্লাহ ও তাঁর রসুল (সা.)-কে ভালোবাসেন এবং আল্লাহ ও রসুল (সা.) যাকে ভালোবাসেন। তিনি বিজয়ী হয়ে ফিরে আসবেন। রসুলুল্লাহ (সা.)-এর এই বাণী সার্থকভাবে প্রমাণিত হয় খন্দকসহ পরবর্তী বহু যুদ্ধে।

 

রমজান মাসে শাহাদাতবরণ

হিজরি ৪০ সালের ১৯ রমজান অর্থাৎ ২৬ জানুয়ারি ৬৬১ সালে হজরত আলী (রা.) ইরাকের কুফা মসজিদে ফজরের নামাজ আদায় করছিলেন। এ সময় আব্দাল রহমান ইবনে মুলজাম নামক এক ভিন্নমতাবলম্বী বিষ মাখানো তরবারি দিয়ে হজরত আলী (রা.)-কে আঘাত করেন। ফলে মারাত্মকভাবে আহত হন তিনি এবং তীব্র বিষক্রিয়া ও যন্ত্রণায় ভুগতে থাকেন। এ অবস্থায়ও হজরত আলী (রা.) তাঁর পুত্র এবং অনুসারীদের আঘাতকারীকে ক্ষমা করে দিতে বলেন এবং তাঁর মৃত্যু হলেই কেবল আঘাতকারীকে শাস্তি হিসেবে একইভাবে আঘাতের নির্দেশ দেন। এ ঘটনার ২ দিন পর অর্থাৎ রমজান মাসের ২১ তারিখে হজরত আলী (রা.) শাহাদাত বরণ করেন। তাঁর কবর নিয়ে মতভেদ রয়েছে। একদল গবেষকের মতে, হজরত আলী (রা.) তাঁর মৃতদেহ ও কবরকে শত্রুরা অপমান করতে পারে বলে আশঙ্কা করেন। ফলে নিকটজনদের প্রতি তাঁর নির্দেশ ছিল মৃত্যুর পর তাঁকে যেন গোপনে কবর দেওয়া হয়। তাই তাঁর কবরের সঠিক অবস্থান দীর্ঘদিন অজানা ছিল। পরবর্তীতে একদল গবেষক ইরাকের নাজাফ শহরে তাঁর কবর রয়েছে বলে দাবি করেন, যেখানে এখনো ইমাম আলী মসজিদ রয়েছে। অপর দিকে আরেক দল দাবি করেন যে, হজরত আলী (রা.) এর দেহ আফগানিস্তানে নিয়ে কবর দেওয়া হয়।

 

অন্যান্য খেতাব

আওলাদ আল কাবা (কাবার সন্তান), আসাদুল্লাহ (আল্লাহর সিংহ) এবং হায়দার (সাহসী) ছাড়াও আরও কিছু খেতাবে ভূষিত হন হজরত আলী (রা.)। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রিয়ভাজন এবং তাঁর বর্ণনায় আল্লাহর প্রিয়ভাজন হিসেবে হজরত আলী (রা.)-কে আল মুরতাজা বা পছন্দের একজন বলে আখ্যায়িত করা হয়। ইসলামের চতুর্থ খলিফা হিসেবে অন্য খলিফাদের মতো হজরত আলী (রা.)-কে আমির উল মোমেনিন বা বিশ্বাসীদের দলপতি হিসেবে সম্বোধন করা হতো। হজরত আলী (রা.) নানা বিষয়ে অত্যন্ত জ্ঞানী ছিলেন। বিশেষত আরবি সাহিত্য এবং আরবি ব্যাকরণে তাঁর প-িত্য ছিল। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে প্রেরিত কোরআনের বাণী লেখকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন হজরত আলী (রা.)। মুহাম্মদ (সা.)-এর সঙ্গী হিসেবে ইসলামী বিষয়েও তাঁর জ্ঞানের সীমা ছিল না। একদল গবেষক বলেন, জীবদ্দশায় হজরত মুহাম্মদ (সা.) নিজেকে জ্ঞানের শহর এবং হজরত আলী (রা.)-কে সেই জ্ঞানের শহরে প্রবেশের দরজা বলে অভিহিত করেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর উপাধি ‘বাবে মদিনাতুল ইলম’ অর্থাৎ জ্ঞানের শহরের দরজা। কোনো এক বিশেষ মুহূর্তে সাদামাটা জীবনে অভ্যস্ত হজরত আলী (রা.) মাটির ওপর ঘুমিয়ে পড়েন এবং তাঁর শরীর ধুলাবালু বা মাটিতে ঢেকে যায়। সেই দৃশ্য দেখে হজরত মুহাম্মদ (সা.) হজরত আলী (রা.)-কে মাটির বাবা বা ‘আবু তুরাব’ উপাধি দেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ইসলামে শিয়া-সুন্নি বিভক্তিসহ নানাবিধ কারণে হজরত আলী (রা.)-কে নিয়ে বহু মতামত পাওয়া যায়। তবে সব মতামতের ঊর্ধ্বে বাস্তবতা হলো হজরত আলী (রা.) নিঃসন্দেহে আল্লাহকে ভয় করতেন, মহানবী (সা.)-কে গভীরভাবে ভালোবাসতেন, ভোগ-বিলাসের পরিবর্তে একান্তে ধর্মচর্চা করতেন, সত্য কথা বলতেন ও ন্যায় বিচার করতেন। তাই ইসলামের ইতিহাসে তিনি অনুকরণীয় বলে চিহ্নিত হয়েছেন। ১৯৯৭ সালের ৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে হজরত আলী (রা.) প্রশাসনের যে অবয়ব তুলে ধরেছেন তাঁর উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়াও মানবাধিকারের ক্ষেত্রে হজরত আলী (রা.) এর দর্শন মানব ইতিহাসে অমূল্য সম্পদ।

সর্বশেষ খবর