দেড়’শ বছরের প্রাচীন বট-পাকুড় গাছের ডালে ডালে ও পাতায় পাতায় বাদুড়ের রাজ্য। যুগ যুগ ধরে প্রাচীন বট-পাকুড়ের গাছে যেন শত শত বাদুড়ের নিরাপদ আবাস। এটাই বসবাসের অভয়ারণ্য। গাছের নিচ দিয়ে চলাচলের সময় কিচিরমিচির শব্দই জানান দেয় এসব গাছে বাদুড়ের নিরাপদ আবাস।
স্থানীয়রা দেড়’শ বছর আগে প্রাচীন বট-পাকুড়ের এই গাছের বিয়েও দিয়েছে। ফলে গাছ কাটার চিন্তাও কেউ করে না। অনেকে এই এলাকায় এসে বাদুড়ের নিরাপদ আবাস না দেখে যান না। যারা পশুপাখি নিয়ে কাজ করেন তারাও এই বাদুড়ের অভায়রণ্য দেখতে আসেন।
দিনাজপুরের চিরিরবন্দরের তেঁতুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের গোন্দলগ্রামের ঠাকুরবাড়ির বট-পাকুড়ের গাছে গাছে এ অবস্থা।
গোন্দলগ্রামের ঠাকুরবাড়ির পুকুর পাড়ে শতবর্ষীয় এসব গাছের ডালে ডালে ও পাতায় পাতায় সর্বত্র বাদুড়ের নিরাপদ আবাস। সকালে কিংবা বিকেল-সন্ধ্যায় দেখা যাবে শত শত বাদুড়। এই চিত্র প্রতিদিনের। গাছের আগায় মনে হবে গাছের পাতাই নেই, আছে শুধু বাদুড় আর বাদুড়। বাদুড় দিনে চলাফেরা করতে পারে না। বাদুড় রাতের আঁধারে চলে। তাই খাবারের সন্ধানে সন্ধ্যা হলেই এসব বাদুড় চলে যায় বিভিন্ন দূর-দূরান্তের এলাকায়। কিন্তু সকাল হওয়ার আগেই এসব গাছে আবার ফিরে আসে এসব বাদুড়। দিনের বেলায় এই এলাকার গাছের ছায়ায় উল্টো হয়ে ঝুলে থাকে। দিনের বেলায় মানুষসহ পৃথিবীর অধিকাংশ প্রাণীই জেগে থাকে। দিবাচর প্রাণীদের কোলাহলে বাদুড়ের পথচলার সেই বিশেষ শব্দ তরঙ্গ হারিয়ে যায়। তাই কোটি কোটি শব্দ তরঙ্গের ভিড়ে নিজের শব্দ তরঙ্গটি খুঁজে খুঁজে পায় না বলেই বাদুড় দিনের বেলা বাসা ছেড়ে বের হয় না।
তবে বিভিন্ন এলাকায় বৈদ্যুতিক তারে মাঝে মাঝে মৃত বাদুড় ঝুলন্ত অবস্থায় দেখা যায়, কারণ তারের প্রস্থ কম হওয়ায় তাৎক্ষণিক তারের সুস্পষ্ট ধারণা পায় না। বাদুড়ের বড় বড় দু’টি চোখ থাকলেও সেগুলো দিয়ে তারা দেখতে পায় না। বাদুড়কে তাই দেখার কাজটা করতে হয় কান দিয়েই। আজব প্রাণীদের মধ্যে বাদুড় একটা। ডানা আছে আকাশে উড়তেও পারে, তবু সে পাখি নয়, স্তন্যপায়ী প্রাণী! মুখটা শিয়ালের মতো, খরগোশের মতো বড় বড় দুটো কান, ছাতার মতো অদ্ভুত দু’টি পাখা। বাদুড় খাদ্যের ঠিকানা খুঁজে বের করতে শব্দ তরঙ্গের সঙ্গে সঙ্গে নাকের গন্ধ শক্তির ওপরও নির্ভর করে।
অমলী কান্তসহ (৬৫) স্থানীয়রা জানান, মনি ঝা, ফণি ঝাঁ’র ঠাকুরবাড়ির সাথে বট-পাকুড় গাছটি যেন বাদুড় বাড়ি। আশপাশের বাড়ির লোকজন বাদুড়গুলো কিচিরমিচির শব্দে বিরক্ত হন না। তারা মনে করেন বাড়িতে বাদুড় থাকা ভাগ্যের ব্যাপার বা চিহ্ন। এ বাড়ির মানুষরাও যেন বাদুড় প্রেমিক। গ্রামীণ জীবনে প্রচলিত আছে-বাদুড় মানুষের জন্য নানা শুভ-অশুভ বার্তা বহন করে। রক্তচোষা বলেও অপপ্রচার রয়েছে। বাদুড় নিয়ে কল্পকাহিনী আর কুসংস্কারের যুগ কেটে গেছে।
গোন্দল গ্রামের ঠাকুরবাড়ির মনি ঝাঁ (৬৫) জানান, কখন এ বাড়িতে বাদুড় আশ্রয় নিয়েছে তার সঠিক ইতিহাস কারো জানা নেই। নিজের খাদ্যের অভাব মেটানো ছাড়া কোনো ক্ষতি করে না। এভাবে যুগের পর যুগ বাদুড়দের জীবন চলছে। আমার ঠাকুর দা নবকান্ত ঝাঁ ওই বট-পাকুড় গাছের বিয়ে দিয়েছিলেন।
কখন বাদুড়গুলো আসে এই ব্যাপারে তিনি জানান, স্বাধীনতার সময় তিনি যখন ছোট ছিলেন তার ঠাকুর দা নবকান্ত ঝাঁ জানায়, পূর্বপুরুষরা তার দাদাকে জানিয়ে ছিলেন তাদের জন্মেরও আগে বাদুড়গুলো এভাবে বসবাস করছে।
ইছামতি ডিগ্রি কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. আতাউর রহমান বাদুড় সম্পর্কে জানান, এরা নিশাচর প্রাণি। প্রচলিত নাম ভারতীয় উড়ন্ত বাদুড় (Indian Flying Bat) এর বৈজ্ঞানিক নাম bvg Pteropus giganticus। এরা Frugivorus স্বভাবের। এদের প্রধান খাদ্য পাকা আম, কলা, পেয়ারা, ডুমুর, পেঁপেসহ অন্যান্য ফলমুল। বাদুড় সাধারণত বট, পাকুড়, ডুমুর এবং তেঁতুল জাতীয় গাছে আশ্রয়স্থল তৈরি করে। আশ্রয়স্থল তৈরিকারী গাছগুলো পানির সন্নিকটে থাকে। এরা মানুষের উপকারই করে থাকে। কীটপতঙ্গ খেয়ে ফসলকে রক্ষা করে। ফুল-ফলের পরাগায়ণ সৃষ্টি করে। জীববৈচিত্র্য, পরিবেশবান্ধব ও মানবকল্যাণকারী এ স্তন্যপায়ী প্রাণিটি রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব।
বিডি-প্রতিদিন/বাজিত