২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ১৮:২৯

সিএমএসএমই খাতে প্রণোদনার ঋণ শতভাগ বিতরণের তাগিদ

নিজস্ব প্রতিবেদক

সিএমএসএমই খাতে প্রণোদনার ঋণ শতভাগ বিতরণের তাগিদ

সিএমএসএমই খাতে সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ বিতরণ শতভাগ বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ব বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের নির্দেশ দিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আসাদুল ইসলাম। 

কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবে দেশের আর্থিক খাতের ক্ষয়-ক্ষতি মোকাবেলায় সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা এবং অন্যান্য বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ সংক্রান্ত অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক ভার্চুয়াল সভায় এই নির্দেশ দেন তিনি। 

ওই সভায় বাংলাদেশ ব্যাংক ও রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর উদ্যোগে ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্প খাতের উদ্যোক্তাদের আইডিকার্ড ভিত্তিক ডাটাবেজ তৈরি, খারাপ ঋণ খেলাপিদের চিহ্নিত করে তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার সিঙ্গেল ডিজিটে কমিয়ে আনা এবং ভালো গ্রাহকদের সুবিধা দেওয়ার বিষয়সহ ব্যাংক খাত সম্পর্কিত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।

গত ২২ সেপ্টেম্বর আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আসাদুল ইসলামের সভাপতিত্বে জুম প্লাটফর্মে সভাটি অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ঊর্ধতন কর্মকর্তাগণ, বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের মহাব্যবস্থাপক ও উপমহাব্যবস্থাপক এবং রাষ্ট্রায়ত্ব সকল বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকগণ অংশগ্রহণ করেন।

সিনিয়র সচিব আসাদুল ইসলাম করোনা পরিস্থিতিতে অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো অগ্রণী ভূমিকা রাখায় তাদের প্রশংসা করেন। তিনি জানান, করোনা পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলো ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সেবা খাতের প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত ৩৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ প্যাকেজের অধিকাংশ বিতরণ করতে সক্ষম হয়েছে। ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্প খাতে ঋণ বিতরণ কম হওয়ায় হতাশা ব্যক্ত করে অর্থনীতির স্বার্থে এই খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখার আহ্বান জানান এই সিনিয়র সচিব।

এই খাতের গ্রাহকদের চিহ্নিত করার জন্য সুনির্দিষ্ট আইডিকার্ড ভিত্তিক একটি তথ্যভাণ্ডার সৃষ্টি করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং রাষ্ট্রায়ত্ব বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেন আসাদুল ইসলাম। এছাড়া ঋণ ব্যবস্থাপনায় জামানত মর্টগেজের ক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যা নির্দিষ্টকরণের মাধ্যমে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে প্রেরণের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে পরামর্শ দেন।

সভায় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব অরিজিৎ চৌধুরী বলেন, সরকারের ঘোষিত প্যাকেজগুলো বাস্তবায়নের জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সর্বদা সচেষ্ট আছে। সিএমএসএমই খাতে ঋণ বিতরণ কার্যক্রম বাড়ানোর জন্য ব্যাংকগুলোর পল্লী শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষুদ্র গ্রাহকদের প্রতি আন্তরিক হতে হবে। ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিস্থিতি আরো ভালো করার জন্য ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টের আওতায় ঋণ পুনঃতফসিল না করে শ্রেণীকৃত ঋণ হতে নগদ আদায় কার্যক্রম জোরদার করতে বলেন তিনি।

সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের বিআরপিডি’র মহাব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম বলেন, সরকার ঘোষিত ১৯টি প্রণোদনা প্যাকেজের মধ্যে ৮টি প্যাকেজের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক সরসরি জড়িত। এই আটটি প্যাকেজের আওতায় ৮৫ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা বিতরণের অগ্রগতি তুলে ধরেন তিনি।

নজরুল ইসলাম জানান, ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সেবা খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ৩৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ প্যাকেজের মধ্যে ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ২৫ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। শতাংশের হিসাবে বিতরণের হার প্রায় ৭৮ শতাংশ।

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর এপ্রিল-মে সময়ে স্থগিতকৃত ঋণের সুদের বিপরীতে সরকারের আংশিক সুদ বাবদ ২ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি প্যাকেজ সম্পর্কে বিআরপিডি জিএম বলেন, সকল ব্যাংক থেকে আবেদন পাওয়ার পর অর্থ মন্ত্রণালয়ে চাহিদাপত্র পাঠানো হবে। উক্ত চাহিদা অনুযায়ী অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অর্থপ্রাপ্তি সাপেক্ষে প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় সুদ বা মুনাফা ভর্তুকি প্রদান করা হবে।

সভায় বিআরপিডি জিএম’র উত্থাপিত তথ্য অনুযায়ী, প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় সোনালী ব্যাংক ১ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা (লক্ষ্যমাত্রার ৭৭.৬৩ ভাগ), জনতা ব্যাংক ৪৫৮ কোটি টাকা (৯৩.৪৭ ভাগ), অগ্রণী ব্যাংক ৬৮২ কোটি টাকা (৬৬.৬৬ ভাগ), রূপালী ব্যাংক ৩০৩ কোটি টাকা (৩৭.১৩ ভাগ) ও বেসিক ব্যাংক ৩৪ কোটি টাকা (লক্ষ্যমাত্রার ৩২ ভাগ) বিতরণ করেছে।

সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও আতাউর রহমান প্রধান বলেন, ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্প খাতের উদ্যোক্তাদের ত্যথ ভাণ্ডার না থাকার কারণে সিএমএসএমই খাতে ঋণ বিতরণে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে।

বিদ্যমান রেজিস্ট্রেশন আইনের সংশোধনীর প্রস্তাব উত্থাপন করে তিনি বলেন, ঋণের বিপরীতে মর্টগেজকৃত একই সম্পত্তি বার বার মর্টগেজ করতে হয়। তাই মর্টগেজ সমস্যার জন্যও ঋণ বিতরণে সমস্যা হচ্ছে। তবে বেধে দেওয়া সময়ের মধ্যে ঋণ বিতরণ সম্ভব হবে বলে উল্লেখ করেন সোনালী ব্যাংকের এমডি।

এছাড়া ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্টের আওতায় পুনঃতফসিলিকরণের সময় আর বাড়ানোর প্রয়োজন নেই বলে জোরালো মত ব্যক্ত করেন তিনি।

রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মো. ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ বলেন, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ পর্যন্ত রপ্তানিমুখী শিল্পের শ্রমিকদের বেতন দেওয়া হয়েছে ১০১ কোটি টাকা যেখানে বরাদ্দ ছিল ৫৮ কোটি টাকা। বৃহৎ শিল্পে বরাদ্দকৃত ৭৭৮ কোটি টাকা থেকে ৪৪৪ কোটি টাকা অর্থাৎ ৫৬ শতাংশ বিতরণ করা হয়েছে। সিএমএসএমই গ্রাহকগণ করোনা পরস্থিতিতে ব্যাংকে আসেনি এবং ব্যাংক থেকেও গ্রাহক পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এ কারণে সিএমএসএমই খাতে ঋণ বিতরণ করা সম্ভব হয়নি।

জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মো. আব্দুছ ছালাম আজাদ বলেন, করোনা সংক্রমণের প্রাথমিক সময়ে সিএমএসএমই খাতের তৃণমূল ও পল্লী পর্যায়ের গ্রাহকদের দ্বারে দ্বারে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তাই সরকারি প্যাকেজ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে না পারায় উক্ত খাতে ঋণ বিতরণের হার কম। তবে আগামী অক্টোবরের মধ্যে সিএমএসএমই খাতে ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে জনতা ব্যাংকের।

সিএমএসএমই খাতে ঋণ বিতরণে আইন কিছুটা শিথিল ও নমনীয় করার জন্য ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের প্রতি অনুরোধ জানান অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মোহাম্মদ শামস উল ইসলাম। তিনি ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টের আওতায় এক্সিট পলিসি ও ঋণ পুনঃতফসিলিকরণের ক্ষেত্রে সময় বাড়ানোর প্রস্তাব করেন।

এছাড়া বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মো. রফিকুল আলম, বাংলাদেশ ডেভলপমেন্ট ব্যাংকের (বিডিবিএল) ব্যাবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও কাজী আলমগীর, কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আলী হোসেন প্রধানিয়া, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, আনসার-ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংক, ও কর্মসংস্থান ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকগণ প্রণোদনা প্যাকেজের অগ্রগতি সম্পর্কে নিজ নিজ ব্যাংকের অবস্থান তুলে ধরেন।

সভায় গৃহীত অন্যান্য সিদ্ধান্তগুলো হলো: ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্টের আওতায় ঋণ পুনঃতফসিলের সময় না বাড়িয়ে ভাল গ্রাহকদের বিআরপিডি-১৫ এর আওতায় সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এছাড়া ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার সিঙ্গেল ডিজিটে কমিয়ে আনা, ভালো গ্রাহকদের সহযোগিতা করা ও ঋণ খেলাপিদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে ব্যাংকগুলোকে। 

বিডি-প্রতিদিন/বাজিত হোসেন

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর