সৃজনশীলতার এক অনন্য মাধ্যম ক্যালিগ্রাফি বা সহজ ভাষায় বললে হাতের লেখার নান্দনিক রূপ। যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এই শিল্পের চর্চা। এই ক্যালিগ্রাফি নিয়েই সম্প্রতি মেতেছে দেশের তরুণরা। ক্যালিগ্রাফির নান্দনিকতায় বাংলা বর্ণকে ফুটিয়ে তুলে প্রিয় মাতৃভাষাকে নতুন সৌন্দর্যে মেলে ধরছে দেশের তরুণ প্রজন্ম।
বিভিন্ন বর্ণকে নকশা আকারে লিখে দৃষ্টিনন্দনভাবে উপস্থাপন করাই মূলত ক্যালিগ্রাফি শিল্প। কাগজে, ক্যানভাসে কিংবা কাঁচের উপর, বিশেষ ধরনের কলম, ব্রাশ ও লেখালেখির অন্যান্য সরঞ্জামাদি দিয়ে মনের মাধুরী মেশানো সৃজনশীলতা থেকে তৈরি হয় এক একটি ক্যালিগ্রাফি। বর্তমান যুগে তরুণ প্রজন্ম মানেই ভিন্নতা, নতুনত্ব ও সৃজনশীলতা। বিভিন্ন মূলধারার সৃজনশীল কাজের পাশাপাশি এখন সবার নজর কাড়ছে ক্যালিগ্রাফি আর সেই সাথে শিল্পীরাও পাচ্ছে উৎসাহ, সমর্থন, বাহবা।
করোনার প্রকোপে বিশ্ব যখন নাজেহাল, সকলের মতো বাঙালিও হয়েছে গৃহবন্দি। লকডাউন চলাকালীন দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতে সবাই যখন হতাশাগ্রস্থ তখন কিছু মানুষ তাদের শৈল্পিক অস্ত্রে শাণ দিয়ে চর্চা করেছে ক্যালিগ্রাফি শিল্পের। তেমনই একজন ঢাকার নুর-ই-তামিমা তুবা, যিনি ক্যালিগ্রাফিকে বেছে নিয়েছেন পেশা হিসেবে। লম্বা সময় ধরে এই শিল্প নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলেও লকডাউন চলাকালীন তার এই প্রতিভা পূর্ণরূপে বিকশিত হয়। ঘরে বসে থাকার একঘেঁয়েমি দূর করতে নিয়মিত শুরু করে দেন ক্যালিগ্রাফি চর্চা। রাজধানীর এমএম আর্ট ফাউন্ডেশন থেকে অধ্যয়নের পর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি’র একটি চিত্র প্রদর্শনীতে অংশগ্রহন করেছিলেন। এছাড়াও বিভিন্ন অনলাইন এক্সহিবিশনেও যোগদান করেছেন তিনি। বাংলা ভাষার ও বর্ণের অপরূপ সৌন্দর্য শিল্পের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে এই চেষ্টা অব্যাহত রাখতে চান বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন তুবা। বাঙালির মাঝে ক্যালিগ্রাফি চর্চা যেন আরও বৃদ্ধি পায় এটাই তার কাম্য।
তুবা’র মতোই লকডাউনে ক্যালিগ্রাফি নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী তাসফিয়া রাহিম ফারিহা। পেশা না হলেও অদম্য ইচ্ছাশক্তির দ্বারা ক্যালিগ্রাফিকে যথাসাধ্য এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি। লকডাউন চলাকালীন শুরু করা এই চর্চা নজর কেড়েছে পরিবার, বন্ধু-বান্ধবসহ আরো অনেকের এবং সেই সাথে কুড়িয়েছেন প্রশংসাও। ফারিয়া’স ক্যানভাস নামক একটি অনলাইন পেইজ পরিচালনা করেন তিনি, যার মাধ্যমে তরুন প্রজন্মের অনেককেই উৎসাহিত করছেন নিজের প্রতিভা দিয়ে।
শুধু তুবা কিংবা ফারিহা-ই নয়, আরও অনেক উঠতি ক্যালিগ্রাফার চর্চা করছেন বাংলা ক্যালিগ্রাফির। তরুণদের আগ্রহের ফলে এ নিয়ে নানা উদ্যোগও পরিলক্ষিত হচ্ছে এখন। বাংলা ক্যালিগ্রাফি নিয়ে এরকম একটি উদ্ভাবনী ও ভিন্নধর্মী আয়োজন করেছে আইপিডিসি ফাইন্যান্স।
প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোগে দেশে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হচ্ছে বাংলা ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতা ‘বর্ণশিল্পী’। ক্যালিগ্রাফির নান্দনিকতাকে সাধুবাদ জানিয়ে এই আয়োজন, যা উৎসাহিত করবে সকল ক্যালিগ্রাফি শিল্পীদের। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গান, কবিতা, স্লোগান, উক্তি, ভাষণ প্রভৃতি থেকে জনপ্রিয় শব্দমালাকে ক্যালিগ্রাফির সৌন্দর্যে ফুটিয়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়েছে ‘বর্ণশিল্পী’ নামের এই আয়োজনে। দৃষ্টিনন্দন অক্ষরে সুসজ্জিত বর্ণবিন্যাসে বাঙালি চেতনার দৃপ্ত, মমতাময়, শক্তিশালী ও তাৎপর্যপূর্ণ শব্দমালাকে নতুন আঙ্গিকে সকলের মাঝে তুলে ধরার এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ।
হাজার বছরের ইতিহাস থেকে বর্ণিত এক একটি গল্প, গল্পের বাক্য, বাক্যের শব্দ, শব্দের বর্ণ এবং বর্ণের আবেগ সবই এক একটি অনবদ্য শিল্প। আবেগের সেই প্রতিফলনের চেষ্টা ধরে রাখতে হবে আমাদেরই, বাংলা ভাষাকে নিয়ে যেতে হবে আরো সামনের দিকে।
বিডি প্রতিদিন/হিমেল