গুজববিরোধী অভিযানে নেমেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। চলছে ফেসবুকসহ সব সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর কঠোর নজরদারি। সন্দেহজনক ওয়েব পেজ ও ফেসবুক আইডিগুলো চিহ্নিত করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের গ্রেফতারে চলছে বিশেষ অভিযান। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের বিশেষ নির্দেশনায় র্যাব-পুলিশসহ সব কটি সংস্থা এ অভিযানে নামে। এতে সফলতাও মিলেছে। এরই মধ্যে অনেক সন্দেহভাজনকে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো।
‘সবাই আসুন। আমাদের বাঁচান। জিগাতলার একটি পার্টি সেন্টারে অনেক অনেক ছাত্রীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করছে ছাত্রলীগের লোকজন। চারজন ছাত্রভাইকে হত্যা করেছে। আপনারা এখনো ঘরে বসে থাকবেন। সবাই এসে আমাদের বাঁচান।’ কথাগুলো ৪ আগস্ট নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালে ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে থাকা মুখ ঢাকা এক নারীর। একই দিন বীভৎস অবস্থায় থাকা কয়েকজন নারীর লাশের ছবিকে ছাত্রলীগের ধর্ষণের শিকার বলে প্রচার করা হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তবে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও বাস্তবে এমন ঘটনার অস্তিত্ব পায়নি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। তবে প্রকাশিত ছবিগুলো ভারত ও বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া অতীত ঘটনার ছবি বলেই প্রমাণ মিলেছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগের উপ-কমিশনার মো. আলীমুজ্জামান বলেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক তথ্য, ভিডিও তথ্য আসতে পারে। তবে শেয়ার করার আগে আইনানুগ প্রশ্নের বিপরীতে প্রত্যেককে ওই তথ্য পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই-বাছাই করে নিজ দায়িত্বে শেয়ার করা উচিত। আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রপাগান্ডামূলক পোস্টগুলো কঠোরভাবে মনিটরিং করছি। ইতোমধ্যে পাঁচটি মামলার বিপরীতে নয়জন গ্রেফতার হয়েছেন। তার মধ্যে সাতজন রিমান্ডে রয়েছেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তদন্তে নেপথ্য মদদদাতাদের বিষয়টিও খুঁজে বের করা হচ্ছে। প্রত্যেককেই আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। ৪ আগস্ট বিকালে উত্তরার একটি শুটিং স্পট থেকে ফেসবুক লাইভে এসে অভিনেত্রী কাজী নওশাবা আহমেদ বলেন, ‘জিগাতলায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে একজনের চোখ উঠিয়ে ফেলা হয়েছে। আর চারজনকে মেরে ফেলা হয়েছে। আপনার কিছু একটা করেন।’ তার এ আহ্বান মুহূর্তের মধ্যে অনলাইনে ভাইরাল হয়ে যায়। পরে গণমাধ্যমকর্মীরা তার এ তথ্যের সত্যতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি তা দেখাতে ব্যর্থ হন। সেদিন রাতেই নওশাবাকে গ্রেফতার করে র্যাব। র্যাবের কাছে তিনি স্বীকার করেন, রুদ্র নামের একটি ছেলের কাছ থেকে ফোনে এমন তথ্য পেয়ে তিনি উত্তরায় বসে ফেসবুক লাইভে আসেন। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে মামলা হয়। একই দিন নওশাবার মতো অনেকেই ফেসবুক লাইভে একই ধরনের অপপ্রচার চালান। এর মধ্যে অনেক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন উসকানিমূলক অপপ্রচার চালিয়ে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টিও চেষ্টা চালান অনেকে। ফেসবুক ও টুইটারের এমন ৩ শতাধিক আইডি শনাক্ত করেছে পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থা। সূত্র জানিয়েছে, নিরাপদ সড়কের দাবিতে ২৯ জুলাই শুরু হওয়া শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে সহিংস করে তুলতে যারা বিভিন্নভাবে উসকানি দিয়েছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচার চালিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে সরকার। সরকারের নীতিনির্ধারক মহল থেকে পুলিশ ও গোয়েন্দাদের এ বিষয়ে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এদিকে গতকালও ফেসবুকে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে ছাত্রশিবিরের তিন কর্মীকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। র্যাব-২-এর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রবিউল ইসলাম বলেন, মঙ্গলবার রাতে ধানমন্ডির আবাহনী মাঠের সামনে থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এরা হলেন আখতারুজ্জামান টনি (২২), আসাদুল্লাহ আল গালিব (২২) ও মো. মুনীম সরকার (২৩)। এর আগের দিন র্যাব-১-এর একটি দল গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে সাখাওয়াত হোসেন ওরফে রাতুল সরকার ওরফে রিংকুকে গ্রেফতার করে। এ ব্যাপারে র্যাব-১-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেম বলেন, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন। আমরা সব সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিং করছি। যারাই বিভ্রান্তিমূলক পোস্ট দিয়ে গুজব সৃষ্টির চেষ্টা করবেন তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে রাজধানীসহ দেশজুড়ে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি এবং এর মাধ্যমে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে তৎপর ছিল একাধিক পক্ষ। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছদ্মবেশে নিজেদের লোক ঢুকিয়ে ব্যাপক নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনাও করেছিল। এমন স্বার্থান্বেষী পক্ষগুলোই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা ধরনের অপপ্রচার চালিয়েছিল শিক্ষার্থীদের অহিংস আন্দোলনকে সহিংসতায় রূপ দিতে। বিশেষ করে ফেসবুক ও টুইটারেই অধিকাংশ অপপ্রচার ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়ানো হয়। পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দাদের অনুসন্ধান ও তদন্তে এমন তথ্য উঠে এসেছে। অনেকে দেশের বাইরে অবস্থান করে সোশ্যাল মিডিয়ায় অপপ্রচার চালাচ্ছে। তবে তাদের এসব তথ্য যাচাই-বাছাই না করে শেয়ার না করার জন্য বিশেষভাবে সতর্ক করেছেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের অর্গানাইজড ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, আমরা এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। এরই মধ্যে ৪০টি ফেসবুক আইডি চিহ্নিত করেছি। যাদের আটজন ব্যবহারকারীকে খোঁজা হচ্ছে।
গুজব ছড়ানোর সাজাও কঠিন : অনলাইন বা তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে গুজব ছড়ালে বা কারও বিরুদ্ধে কুৎসা রটালে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন, ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৩) অনুযায়ী অপরাধীর ১৪ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। একই সঙ্গে গুনতে হতে পারে অর্থদণ্ডও। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন, ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৩)-এর ৫৪ থেকে ৬৭ নম্বর ধারায় অপরাধের দণ্ডসংক্রান্ত বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। আইন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আইনের ৫৪ ধারায় বলা হয়েছে, কম্পিউটার বা কম্পিউটার সিস্টেম ইত্যাদির ক্ষতি, অনিষ্ট সাধন যেমন ইমেইল পাঠানো, ভাইরাস ছড়ানো, সিস্টেমে অনধিকার প্রবেশ বা সিস্টেমের ক্ষতি করা ইত্যাদি অপরাধ করলে সর্বোচ্চ ১৪ বছর ও সর্বনিম্ন সাত বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমান হতে পারে। আইনের এ বিধান অনুযায়ী উভয় (কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড) দণ্ড প্রদানের বিধানও রয়েছে।
এ ছাড়া ৫৭ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে কোনো মিথ্যা বা অশ্লীল কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করে, যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি হয় অথবা রাষ্ট্র বা ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়, তাহলে এগুলো হবে অপরাধ। এর শাস্তি সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদণ্ড এবং সর্বনিম্ন সাত বছর কারাদণ্ড এবং ১ কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা। উভয় (কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড) দণ্ড দেওয়ার বিধানও এ আইনে রয়েছে। উল্লেখ্য, তীব্র সমালোচনা ও বিতর্কের পর এ ধারাটি আইনে বাদ দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার। তবে একই ধরনের একটি ধারা ডিজিটাল নিরাপত্তা নামে নতুন একটি আইনে সংযুক্তির চেষ্টাও চলছে জানা গেছে।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল বাসেত মজুমদার এ বিষয়ে বলেন, কেউ সাইবার অপরাধ করলে রেহাই পাবে না। এ আইনে কঠিন সাজার বিধান রয়েছে। ফলে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে সচেতনতার বিকল্প নেই।
 
                         
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        