রাজশাহীতে গত ১৪ বছরে অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু বাড়েনি কর্মসংস্থান। নির্বাচনের আগে মেয়র-এমপির প্রতিশ্রুতি থাকলেও কর্মসংস্থান সে তুলনায় বাড়েনি। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে অন্য যে কোনো শহরের তুলনায় বেশ পিছিয়ে রাজশাহী। ফলে বেকারত্ব বাড়ছে, তৈরি হচ্ছে অর্থনৈতিক বৈষম্য। ষাটের দশকে রাজশাহীতে সরকারিভাবে চিনিকল, পাটকল, টেক্সটাইল এবং রেশমের মতো যে বড় চারটি শিল্প কারখানা স্থাপন করা হয়েছিল, অবহেলা, লোকসানে সেগুলোও এখন স্থবির। এরপর তেমন আর ভারী কোনো শিল্পকারখানা এখানে গড়ে ওঠেনি। শিল্পায়নের দিক থেকে রাজশাহী বরাবরই থেকে গেছে অবহেলায়। এখানকার শিল্পোদ্যোক্তারা অন্য অঞ্চলে গিয়ে বিনিয়োগ করছেন। স্বাধীনতার আগে রাজশাহীতে বৃহৎ চারটি শিল্প প্রতিষ্ঠান- চিনিকল, পাটকল, টেক্সটাইল মিল ও রেশম কারখানা গড়ে তোলা হয়। ষাটের দশকে এসব কারখানা গড়ে ওঠে পুরোপুরি সরকারি উদ্যোগে। এতে এ অঞ্চলের মানুষের ব্যাপক কর্মসংস্থান তৈরি হয়। কিন্তু বর্তমানে সেই চিত্র ভিন্ন। এক রকম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান। লোকসানে পড়ে একের পর এক বিপর্যয় ঘটায় কাজ হারিয়েছেন অনেক শ্রমিক। তাদের মধ্যে অনেকে বেকার, অনেকে জড়িয়েছেন অন্য পেশায়। ১৯৭৪ সালে ২৫ দশমিক ৯৮ একর জায়গার ওপর গড়ে ওঠা রাজশাহী টেক্সটাইল মিলের বিভিন্ন অংশ এখন ইজারা দেওয়া হয়েছে। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইজারার টাকার ওপর ভর করেই এখন পরিচালিত হচ্ছে এক সময়ে উত্তরাঞ্চলে সুতার চাহিদা মেটানো টেক্সটাইল মিল। মিলের এখন নিজস্ব কোনো উৎপাদন নেই। মিলের ব্যবস্থাপক (কারিগরি) ও মিল ইনচার্জ রবিউল করিম জানান, এখন মিলের দেখাশোনার জন্য পাঁচজন স্থায়ী ও ১৫ জন অস্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন। রাজশাহীর ঐতিহ্যে মিশে আছে রাজশাহী সিল্কে (রেশম)। সুপ্রাচীনকাল থেকেই রাজশাহীর আবহাওয়া রেশম চাষের অনুকূলে। রাজশাহী শহরের শিরোইল বাস টার্মিনাল এলাকায় ১৯৬১ সালে সাড়ে ১৫ বিঘা জমির ওপর স্থাপিত হয় রাজশাহী রেশম কারখানা। ৮০-এর দশকের শেষ দিকে তিন হাজার হেক্টর এলাকাজুড়ে তুঁত চাষ হতো। মূলত এ সময়টিকেই এ অঞ্চলে রেশম উৎপাদনের স্বর্ণযুগ হিসেবে বলা হয়। কিন্তু এখন আর সেই স্বর্ণযুগ নেই। ২০০২ সালে লোকসান দেখিয়ে রেশম কারখানাটি বন্ধ করে দেয় সরকার। এতে বেকার হয়ে পড়েন কারখানার প্রায় ৩০০ জন শ্রমিক। ২০১৮ সালের ২৭ মে পরীক্ষামূলকভাবে কারখানার ৫টি লুম চালু করা হয়। এরপর আরও ১৪টি লুম পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয়। সবশেষ ২০২১ সালের ১০ জানুয়ারি মোট ১৯টি লুম নিয়ে রাজশাহী রেশম কারখানায় আনুষ্ঠানিকভাবে কাপড় উৎপাদন শুরু হয়। যদিও শ্রমিকরা পাওনার জন্য প্রতিদিনই মিল গেটে বিক্ষোভ করছেন। বাংলাদেশ রেশম শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি লিয়াকত আলী বলেন, বিভিন্ন কারণেই ঐতিহ্যবাহী রেশম শিল্প ঝুঁঁকিতে। তবে পরিকল্পনা নিলেই রেশমের ঐতিহ্য ফেরানো সম্ভব। ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া রাজশাহী পাটকলও এখন মৃতপ্রায়। ১৯৭২ সালে রাজশাহীর পবা উপজেলার কাটাখালীতে চালু হয় রাজশাহীর একমাত্র সরকারি মালিকানাধীন পাটকলটি। লোকসান দেখিয়ে ২০২০ সালের ২ জুলাই পাটকলটি বন্ধ করে সরকার। এতে কাজ হারান ১ হাজার ২০৯ জন স্থায়ী এবং ১ হাজার ৫০ জন বদলি শ্রমিক। গোল্ডেন হ্যান্ডসেকে চাকরি হারানো শ্রমিকরা কিছু টাকা পেলেও আগেই মারা যাওয়া ১০০ জনের পরিবার তাদের প্রাপ্য অর্থ এখনো পায়নি। টাকা না পাওয়ার ক্ষোভে তাদের মাঝেমধ্যেই বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করতে দেখা যায়।
ভালো নেই রাজশাহীর আরেক ঐতিহ্যবাহী কারখানা চিনিকল। এই চিনিকলে চিনি উৎপাদন শুরু হয় ১৯৬৫-৬৬ সাল থেকে। পরে ১৯৭২ সালে এই প্রতিষ্ঠানটিকে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণা করে সরকার। রাজশাহী অঞ্চলে আগে আখচাষির সংখ্যা বেশি ছিল। চিনিকলে আখ দিয়ে সময়মতো টাকা না পাওয়াসহ নানা কারণে কমতে থাকে চাষির সংখ্যা। ২০২০ সালের দিকে রাজশাহীসহ দেশের ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকল বিকেন্দ্রীকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। তবে কারখানাটি এখনো রাষ্ট্রীয় মালিকানাতেই চলছে। কিন্তু আখের অভাবে ২০২১-২২ মাড়াই মৌসুমে চিনিকলটি চলেছে মাত্র ১৯ দিন।
রাজশাহী সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সভাপতি আহমদ শফি উদ্দিন বলেন, ‘বড়-বড় রাস্তা আর ভবন তোলার মধ্যেই আমরা সীমাবদ্ধ থাকছি। শুধু অবকাঠামো উন্নয়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেই চলবে না। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে না পারলে সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পেতে পারে। সামাজিক অস্থিরতা কমাতে হলে কর্মসংস্থানের কোনো বিকল্প নেই।’রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান বলেন, ‘রাজশাহীতে সেভাবে কর্মসংস্থান গড়ে ওঠেনি এটি সত্য। তরুণ-যুবকদের বেকারত্ব, রাজশাহীর বিভিন্ন কল-কারখানা পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করার জন্য আমরা দীর্ঘদিন আন্দোলন করে আসছি। সেগুলো আলোর মুখ দেখেনি। এটি দুুঃজনক।’