২৯ ডিসেম্বর, ২০২০ ১১:৫৮

করোনাভাইরাসের পরিবর্তিত রূপ স্বাস্থ্যের তুলনায় অর্থনীতির জন্য বেশি ক্ষতিকর

ড. জিয়াউদ্দিন হায়দার

করোনাভাইরাসের পরিবর্তিত রূপ স্বাস্থ্যের তুলনায় অর্থনীতির জন্য বেশি ক্ষতিকর

কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন বাজারে এসেছে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাসহ উন্নত বিশ্বের অনেক দেশের স্বাস্থ্যকর্মীরা ইতিমধ্যেই ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ পেয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত পাওয়া ভ্যাকসিনগুলোর কার্যকারিতা ৯০-৯৫ শতাংশ। যার অর্থ হলো ভ্যাকসিন পেয়েছে এমন প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৯০ থেকে ৯৫ জনের কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই কম। বাকি ৫ থেকে ১০ জন কোন কারণে আক্রান্ত হলেও তাদের মধ্যে রোগের ভয়াবহতা মারাত্মক নাও হতে পারে। বাংলাদেশও অতি শীঘ্রই COVAX -এর মাধ্যমে ভ্যাকসিন পেতে যাচ্ছে যা প্রথম পর্যায়ে দেশের সকল স্বাস্থ্যকর্মী এবং জনস্বার্থে নিয়োজিত এমন সরকারি কর্মচারিদের মধ্যে প্রয়োগ করা হবে। COVAX হলো একটি আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ যার মাধ্যমে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো জরুরি ভিত্তিতে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন সংগ্রহ করতে পারবে এবং প্রতিটি দেশের জনসংখ্যার প্রথম ২০ শতাংশের কাছে গুরুত্বের ভিত্তিতে পৌঁছে দিতে পারবে। এই ২০ শতাংশের মধ্যে থাকছে স্বাস্থ্যকর্মী, দীর্ঘমেয়াদি রোগ যেমন, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ইত্যাদিতে আক্রান্ত জনগোষ্ঠী এবং প্রৌঢ় নাগরিক। পর্যায়ক্রমে দেশের সকল জনগোষ্ঠির কাছে করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন পৌঁছে দেওয়াই সরকার এবং আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাদের উদ্দেশ্য। দেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে ভ্যাকসিন প্রয়োগের পাশাপাশি সবাইকে মুখমণ্ডলের মাস্ক পরিধান, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, ঘনঘন সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, ইত্যাদি কার্যক্রমের মাধ্যমেই সম্ভব দেশকে কোভিড-১৯ সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করা।

কিন্তু, যে মুহূর্তে আমরা কোভিড-১৯-এর নিষ্ঠুর থাবা থেকে বেরিয়ে আসার স্বপ্ন দেখছি, সেই মুহূর্তেই যুক্তরাজ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নতুন ধরনের পরিবর্তিত করোনা ভাইরাসের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে যা আমাদের সকলকে একটি নতুন শঙ্কা এবং অজানা ভয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই ভয়ের প্রধান কারণ হলো পরিবর্তিত করোনা ভাইরাসটি মূল ভাইরাসটির চেয়ে নিদেনপক্ষে ৭০ শতাংশ বেশি সংক্রামক এবং এর বিস্তারের ফলে পৃথিবী একটি নতুন সঙ্কটের মধ্যে আবর্তিত হবে। ইতিহাসের দ্রুততম সময়ের মধ্যে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন আবিষ্কার হওয়ায় আমরা যে আশার আলো দেখছিলাম সেই আলোটি নিষ্প্রভ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

ডিসেম্বর মাসের ১৮ তারিখে যুক্তরাজ্য সরকার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে সর্বপ্রথম পরিবর্তিত করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব সম্পর্কে অবহিত করে। এই দিনই লন্ডন শহরকে তৃতীয়বারের মতো লকডাউন করে দেওয়া হয় এবং নতুনভাবে আন্তর্জাতিক ভ্রমণে কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আরোপ করা হয়। যুক্তরাজ্যের পরপরই জাপান, সিঙ্গাপুর, হংকং এবং অস্ট্রেলিয়াও নতুন ধরনের পরিবর্তিত করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব সনাক্ত করে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে অবহিত করে। বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যে কয়টি বিষয় পাঠকদের জন্য জানা জরুরি তাহলো- (১) করোনাভাইরাসের পরিবর্তন বা মিউটেশন কীভাবে হয়; (২) পরিবর্তিত করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন কার্যকর কিনা; (৩) যুক্তরাজ্যের বাইরে পরিবর্তিত করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা কতটুকু; (৪) এই পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর কতটুকু প্রভাব ফেলবে; এবং (৫) পরিবর্তিত করোনাভাইরাস অর্থনীতির উপর কোন ধরনের বাড়তি প্রভাব ফেলবে কিনা। আমি খুব সংক্ষেপে উপরের পাঁচটি বিষয়ের উপর আলোকপাত করবো।

১. করোনাভাইরাসের পরিবর্তিত ধরন: আসলে ভাইরাস একটি host -এর মধ্যে জায়গা করে নেওয়ার সাথে সাথেই পরিবর্তিত হতে থাকে। ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের ক্ষেত্রেও এমনটাই হয়। এখন পর্যন্ত জানা বৈজ্ঞানিক তথ্য মতে, প্রতি দুই সপ্তাহে মানব শরীরে করোনাভাইরাস পরিবর্তিত হয় অথবা করোনাভাইরাসের মিউটেশন হয়। তবে এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য মতে পরিবর্তিত করোনাভাইরাস মূল ভাইরাসটির চেয়ে ৭০ শতাংশ বেশি হারে সংক্রমিত হলেও এর ফলে  কোভিড-১৯ রোগের ভয়াবহতা এবং মৃত্যুর ঝুঁকি কিন্তু বেশি নয়। পরিবর্তিত করোনাভাইরাসটি এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিকে অধিক হারে সংক্রমিত করলেও ভয়াবহতার দিক থেকে অধিক পরিমাণে ভয় পাওয়ার কোন কারণ না থাকলেও নতুন সংক্রমণকে আয়ত্তের মধ্যে রাখার জন্য বিশেষজ্ঞরা সকলকে ঘনঘন হাত ধোয়া, মাস্ক পরা এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার উপর অধিক হারে গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

২. সদ্য আবিষ্কৃত কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন কার্যকর কি না: এই বিষয়টি এখনও অতটা পরিস্কার নয়। গত সপ্তাহে দেওয়া একটি বার্তায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছেন, এখন পর্যন্ত তাদের হাতে বিস্তারিত তথ্য নেই যার ভিত্তিতে বলা যেতে পারে যে পরিবর্তিত ভাইরাসটির সাথে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার কোনো সম্পর্ক আছে কিনা। বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান এই নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে এবং এই তথ্য জানার জন্য আমাদের আরও ২-৩ মাস অপেক্ষা করতে হবে। আশার কথা হলো, যুক্তরাজ্য এবং জার্মানির স্বাস্থ্যমন্ত্রীরা ইতিমধ্যে তাদের জনগণকে আশ্বস্ত করে বলেছেন যে এখন পর্যন্ত কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি পাওয়া যায়নি যার ভিত্তিতে বলা যাবে যে, বর্তমানে আবিষ্কৃত কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন পরিবর্তিত করোনাভাইরাসের প্রতিরোধের ক্ষেত্রে কার্যকরী নয়।

৩. যুক্তরাজ্যের বাইরে পরিবর্তিত করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা: যুক্তরাজ্যে যে ধরনের পরিবর্তিত করোনাভাইরাস আবিষ্কৃত হয়েছে সেটা ইউরোপের অন্যান্য রাষ্ট্র যেমন- ডেনমার্ক, ইতালি, নেদারল্যান্ড এবং ফ্রান্সেও শনাক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়াও পূর্ব এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে ভিয়েতনাম, জাপান, সিঙ্গাপুর, হংকং এবং অস্ট্রেলিয়াতেও পরিবর্তিত করোনাভাইরাসটির সন্ধান পাওয়া গেছে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যেই পরিবর্তিত ভাইরাসটির ব্যাপারে সাধারণ জনগণের মধ্যে রেড এলার্ট জারি করেছেন এবং সবাইকে মাস্ক পরাসহ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যাপারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। অস্ট্রেলিয়াসহ অন্যান্য দেশগুলোতেও অনুরূপ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাগুলোর উপর আবারও অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থাসমূহ এটাই প্রচার করছে যে দেশের জনগণের স্বাস্থ্য এবং অর্থনীতি বাঁচাতে হলে ঘনঘন হাত ধোয়া, মাস্ক পরা এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কোন বিকল্প নাই।শুধুমাত্র ভ্যাকসিনের উপর নির্ভর করে এই মহামারির হাত থেকে  বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।

৪. আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর প্রভাব: সকলদেশ আবারও আন্তর্জাতিক ভ্রমণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে জাপান এর সাথে তাল মিলিয়ে এশিয়া মহাদেশের অন্যান্য দেশ যেমন সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত এবং হংকং যুক্তরাজ্য থেকে আসা সকল যাত্রীদের দেশের ভিতরে প্রবেশে সম্পূর্ণভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। চীনও যুক্তরাজ্যের সাথে সকল ফ্লাইট বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
 
৫. অর্থনীতির উপর প্রভাব: ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা এবং নতুন করে আরোপ হওয়া সংশয় বৈশ্বিক অর্থনীতিকে আবার মেঘাচ্ছন্ন করে দিচ্ছে। সবার মধ্যে কাজ করছে বাড়তি শঙ্কা। বিশ্বের সেরা মটরযান প্রস্তুতকারক টয়েটা ইতিমধ্যেই যুক্তরাজ্যে এবং ফ্রান্সে তাদের কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে। লাইফ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান অর্থনীতিবিদ হিডিও কুমানো বলেছেন, অর্থনীতির উপর পরিবর্তিত করোনাভাইরাসের প্রভাব নির্ভর করবে বর্তমানে আবিষ্কৃত ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার উপর। যদি কার্যকারিতা আশানুরূপ না হয় তাহলে বিশ্ব অর্থনীতিকে পূর্ব অবস্থায় ফিরিয়ে আনার যত পরিকল্পনা করা হয়েছে সেগুলোকে পুনরায় নতুন করে ভাবতে হবে। এছাড়াও কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন প্রস্তুত এবং সরবরাহের পরিকল্পনায়ও আনতে হবে আমূল পরিবর্তন।

পরিশেষে বলতে চাই, কোভিড-১৯ মোকাবেলায় প্রথম থেকেই বাংলাদেশে বহুবিধ দুর্বলতা লক্ষ্য করা গেছে। বিভিন্ন ব্যর্থতার কারণে কোভিড-১৯ পরীক্ষা থেকে শুরু করে চিকিৎসা নেওয়ার ক্ষেত্রে সাধারণ জনগণকে ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে। এর ফলে মেনে নিতে হয়েছে অগণিত-অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু, চিকিৎসা অবহেলা, চিকিৎসার বাড়তি খরচের অভিশাপ, সামাজিক কুসংস্কার, আরও কত কী! ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোই এই সব নিগ্রহ এবং বঞ্চনার সাক্ষী হয়ে থাকবে। তাই সরকারসহ সকল স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে অতীত থেকে শিক্ষা নিতে হবে।

ভুলগুলোকে সততা এবং যোগ্যতার মাপকাঠি দিয়ে বিশ্লেষণ করতে হবে যাতে করে পুনরাবৃত্তি না ঘটে। বিশেষ করে লক্ষ্য রাখতে হবে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন যেন অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে দেশের সকল জনগোষ্ঠির কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। ভ্যাকসিন নিয়ে আমরা যেন আরও একবার অসাধুতা এবং অযোগ্যতার উদাহরণ না হয়ে যাই সেই দিকে সরকারকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে  হবে। পরিবর্তিত করোনাভাইরাস যেন আমাদের দেশে প্রবেশ করতে না পারে সেই জন্য এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলির মতো বাংলাদেশেও অতিসত্বর আন্তর্জাতিক ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করা প্রয়োজন। নিষেধাজ্ঞা জারিতে সমস্যা থাকলে অবশ্যই শতভাগ আগত যাত্রীদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেনটাইনের ব্যবস্থা করতে হবে।

সবশেষে বলতে চাই সকল স্তরের জনগণেকে আবশ্যিক ভিত্তিতে মাস্ক পরতে বাধ্য করতে হবে এবং যতটা সম্ভব সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে অদূর ভবিষ্যতে কোভিড-১৯-এর মরণ থাবা থেকে আমাদের পরিত্রাণের কোন সুযোগ নাই। অর্থনৈতিক ভয়াবহতার কথানাই বা লিখলাম।

লেখক: ঊর্ধ্বতন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, বিশ্ব ব্যাংক

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা

সর্বশেষ খবর