শিরোনাম
শনিবার, ১০ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

বিলুপ্তির পথে তাঁতের গামছা-ম্যাট

রিয়াজুল ইসলাম, দিনাজপুর

বিলুপ্তির পথে তাঁতের গামছা-ম্যাট

ব্রিটিশ শাসনামল থেকে তাঁতসমৃদ্ধ এলাকা হিসেবে দিনাজপুরের রানীরবন্দরের পরিচিতি আর সুনাম রয়েছে। এখানকার উৎপাদিত শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা, তোয়ালে, মশারি এবং চাদর জেলার চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হতো। গড়ে উঠেছিল ছোট-বড় প্রায় ২ শতাধিক তাঁতশিল্প কারখানা। তাঁতশিল্পে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ১০ হাজার মানুষ জড়িত ছিলেন। এখন না থাকলেও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে কিছু তাঁত। অথচ এ অঞ্চলের তাঁতশিল্পের উজ্জ্বল সম্ভাবনা, সুদক্ষ তাঁতশিল্পী, সহজলভ্য শ্রমিক থাকা সত্ত্বেও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, রপ্তানির বন্দোবস্ত ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব, সহজ শর্তে তাঁত ঋণ না পাওয়া এবং প্রয়োজনীয় কাঁচা উপকরণের (সুতা-রং) দিন দিন মূল্য বৃদ্ধির কারণে রানীরবন্দরের ঐতিহ্য তাঁতশিল্প বিলুপ্তির পথে। এর পরও কয়েকজন পৈতৃক পেশা হিসেবে ধরে রেখেছেন তাঁতশিল্পকে। এখনো এখানকার তাঁতশিল্প স্থানীয়ভাবে কাপড়ের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। আবার জেগে উঠলে দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান ছাড়াও অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হবে। চিরিরবন্দরের নশরতপুর ইউপির বালাপাড়া গ্রামে ১৫০ বছর ধরে চলে আসছে তাঁত ব্যবসা। এ রকম এক পরিবারের আবদুল মালেক জানান, পৈতৃকভাবে এই পেশা ধরে রেখে তাঁতে গামছা তৈরি ও বিক্রি করে আসছি। আমার সঙ্গে স্ত্রীসহ ছেলেও এ কাজে সাহায্য করে। তিনটি তাঁত থাকলেও এখন একটি চালু আছে। প্রতিদিন এই তাতে ১২ পিচ গামছা তৈরি করা যায়। সুতা-রংসহ খরচ হয় ৮০০ টাকা। আর বিক্রি করি ১২০০-১৫০০ টাকা। তিনি জানান, ১০ বছর আগেও আমাদের দুই ভাইয়ের ৭০টা তাঁত ছিল। বর্তমানে আছে ১০টি। পুঁজি কম, বাজারজাতকরণে অসুবিধা এবং সুতা কিনতে যেতে হয় বিভিন্ন জেলায়। এলাকায় সুতার সহজলভ্যতা এবং উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণে সরকারের কোনো প্রজেক্ট নেওয়া হলে এ অঞ্চলের তাঁতশিল্প আবার জেগে উঠবে বলে জানান তিনি। বালাপাড়া গ্রামের আরেকজন তাঁতে ম্যাট তৈরি করছেন আবুল কালাম আজাদ।

আবুল কালাম আজাদ জানান, তাঁতের ব্যবসা ছেড়ে এখন ম্যাট তৈরি করছেন। অর্ডার অনুযায়ী ১৮ ইঞ্চি, ১৪ ইঞ্চি, ৬০ ইঞ্চি ও ১৪ ইঞ্চি মাপের বিভিন্ন ডিজাইনের ম্যাট তৈরি করা হয়। পাঁচজন শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। সব খরচ বাদ দিয়ে ১০ হাজার টাকা লাভ হয় বলে জানান তিনি। পাঁচ বছর ধরে এই ম্যাট তৈরি করছেন।

উল্লেখ্য, প্রায় ৫০০ বছর আগে এই রানীরবন্দর এলাকা জঙ্গল ও অনাবাদি ছিল। তৎকালীন রংপুরের জমিদার তার নিজের কাজের জন্য তাঁতপল্লী গড়ে তোলেন। তখন থেকেই বংশগতভাবেই কাপড় বুনার কাজ এখানে গড়ে ওঠে। দিনাজপুরের চিরিরবন্দরের নশরতপুর, দক্ষিণ নশরতপুর, রানীপুর, আলোকডিহি, গছাহার, কিষ্টহরি, খামার সাতনালা, জোত সাতনালা, তেঁতুলিয়া, খোচনা এবং খানসামার গোয়ালডিহি, ছাতিয়ানগড় ও কুমড়িয়া গ্রামের তাঁতশিল্প নিয়ে গড়ে ওঠে বৃহত্তর রানীরবন্দর তাঁত অঞ্চল।

তাঁতীরা জানান, কাপড় বুনতে তারা প্রথমত সুতার বান্ডিলগুলো ধুয়ে শুকাতে দেন। এরপর সাগু, বার্লি, ময়দা, একসঙ্গে পাক করে এক ধরনের মাড়ি তৈরি করে ঠাণ্ডা হওয়ার পর আবার সেই মাড়ি দিয়ে সাবানের মতো মাখিয়ে ধুয়ে শুকাতে দেওয়া হয়। শুকানোর পর সুতাগুলো কাজের উপযোগী করে তুলতে হালকা পানি দিয়ে স্যাঁতসেঁতে করে নেসা (বড় সুতার টোটার মতো) তৈরি করে চরকায় (বড় চাক্তির মতো) ববিন (কাপড়ের লম্বার দিকের সুতা), ললি (কাপড়ের খাটোর দিকের সুতা), পেলে (পাইড়ের সুতা) কাটা করা হয়। এরপর তাঁত মেশিনে হাতে শুরু হয় কাপড় বুনার কাজ।

 

সর্বশেষ খবর