বলা হয়ে থাকে, ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না। এ কথাটি সবার জন্য হয়তো সব সময় সত্য নয়। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মনে হয় এ এক কঠিন সত্য। এ ভয়ংকর অচলায়তন। বিশেষ করে ক্ষমতার স্বাদ পেলে মানুষ ইতিহাস ভুলে যায় অথবা ইতিহাসকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করে যাতে নিজের ক্ষমতা বা আধিপত্যের আসনে একটুও ধাক্কা না লাগে। ক্ষমতা বা আধিপত্য এমন এক বিভ্রম, যা থেকে লোভী ও চতুর মানুষ সহজে বের হতে পারে না। নিজের অজান্তে তারা অচলায়তনের বৃত্তে বাঁধা পড়ে যান। তিনি বা তারা এই বৃত্ত থেকে বের হতেও হয়তো চান না। এই ঘোরের মধ্যে থাকতেই তাদের সুখ। অথচ তারা হয়তো সুখের ঠিকানাই কখনো খুঁজে পাননি। আজ তুমি একদল মানুষের অধিকার কেড়ে নিচ্ছ, কাল হয়তো আরেক দল এসে তোমাকে অধিকারের ‘অ’ অক্ষরটিও উচ্চারণ করতে দেবে না। কিন্তু মোহগ্রস্ত মানুষের মাথায় এ বাস্তব চিন্তাটা জায়গা পায় না। তা না পেলেও যা ঘটার তা ঘটেই যায়। বালির বাঁধ দিয়ে সেই অবশ্যম্ভাবী ঘটনাকে থামানো যায় না। বেগম খালেদা জিয়া ফিরে এসেছেন বিপুল জনস্রোতের মাঝে। জনগণের অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় আজ তিনি অভিষিক্ত। বাড়ির গেটে বালির ট্রাক রেখে জনগণ থেকে তাঁকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করা হয়েছিল। সেই বালির বাঁধ ভেঙে গেছে অনেক আগেই। বালির বাধা সৃষ্টি করে ইতিহাসের সত্য রুখে দেওয়ার চেষ্টা কতটা নির্বুদ্ধিতার কাজ ছিল, এই জনস্রোত চোখে আঙুল দিয়ে সেই সত্যটা দেখিয়ে দিল। যিনি বা যারা সেই বাঁধ দিয়েছিলেন, তারা আজ কোথায়? এটা একটা ইতিহাস। এই ইতিহাস থেকে সবারই শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ রয়েছে। শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। কিন্তু কই; শিক্ষা তো আমরা গ্রহণ করি না। যদি ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা হতো, তাহলে একই পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি ঘটত না।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তরুণদের উদ্দেশে গত মঙ্গলবার বলেছেন, দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ সেকেলে। তাঁর ভাষায়, অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হলো আগের রেখে যাওয়া বিশৃঙ্খলা পরিষ্কার করা। ধ্বংসস্তূপ থেকে টুকরোগুলো তুলে নিয়ে নতুন সূচনার জন্য নতুন কাঠামো তৈরি করাই এখন মূল চ্যালেঞ্জ। ড. ইউনূস এ সময়টাকে আখ্যায়িত করেন রূপান্তরের কাল হিসেবে। সেই রূপান্তরের জন্য কাঠামো তৈরির কাজ কত দিনে শেষ হবে, সেই প্রশ্নটি অবশ্য থেকেই যাচ্ছে।
রূপান্তর একটি শ্রুতিমধুর শব্দ। রূপান্তর নামে ফ্রানৎস কাফকার একটি নভেলা রয়েছে, যেখানে একজন সেলসম্যান এক সকালে নিজেকে পোকারূপে আবিষ্কার করে। রূপান্তর ইংরেজিতে মেটামরফিসিস একটি বহুল আলোচিত উপন্যাসোপম গল্প। রূপান্তর জীববিজ্ঞানের একটি তত্ত্বও বটে। সমাজ ও রাজনীতিতেও রূপান্তর ঘটতে পারে। সেই রূপান্তর খারাপ হতে পারে আবার ভালোও হতে পারে। রূপান্তরের মধ্য দিয়ে মানুষের মর্যাদা সমুন্নত হতে পারে। আবার সাধারণ মানুষের মর্যাদা অবনমিত হতে পারে। আমাদের সমাজে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে রূপান্তরের যে লক্ষণগুলো দেখা যাচ্ছে তার মধ্যে নেতিবাচকতার অংশ যে নেহাতই কম নয়, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর প্রয়োজন পড়ে না। একটা কথা পরিষ্কার করে বলা দরকার- বুদ্ধির মুক্তি তথা চিন্তার ঔদার্য ছাড়া সমাজ ও রাজনীতির কাক্সিক্ষত রূপান্তর অসম্ভব। কৌশলের রূপান্তর টেকসই হওয়ার কথা নয়। ভালো মানুষের ভেক ধরলেই কেউ ভালো মানুষ হয়ে যায় না। ভালো হতে হবে অন্তর থেকে।
এজন্য প্রয়োজন বুদ্ধির মুক্তি। চিন্তার ঔদার্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চার বছরের মাথায় কয়েকজন অধ্যাপক মিলে শুরু করেন বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন। সেই আন্দোলন ইতিহাসে বাঙালি মুসলমানের রেনেসাঁ বা নবজাগরণ নামে অভিহিত। এ আন্দোলনের পোশাকি নাম শিখাগোষ্ঠী। শিখাগোষ্ঠীর মুখপত্র শিখার নীতিবাক্য ছিল; জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব। বাঙালির অগ্রসরতা ও ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে সেই নবজাগরণ সঞ্চারিত করেছিল ফলপ্রসূ অভিঘাত। বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য, সমাজচিন্তা ও প্রগতিভাবনাকে বহুদূর এগিয়ে দিয়েছিল বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন। এ আন্দোলন থেকেই সৃষ্টি হয় মুসলিম সাহিত্য সমাজ। অবিদ্যার অন্ধকার থেকে মুক্তি আনতে এই সাহিত্য সমাজ পালন করে ঐতিহাসিক ভূমিকা। মুসলিম সাহিত্য সমাজের ঘোষণায় বলা হয়েছিল, আমরা আমাদের চোখ খুলতে চাই, সত্যিকার অর্থে জীবনকে অনুভব করতে চাই এবং কুসংস্কারগুলো পুড়িয়ে ফেলতে চাই।
আজ এতগুলো বছর পর মনে হচ্ছে আবারও দেশে জোরদার বুদ্ধির মুক্তির একটা আন্দোলনের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করে ওপর পর্যন্ত বুদ্ধির আড়ষ্টতা, যুক্তিহীনতা নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করছে অগ্রসর চিন্তার স্রোত। গত ২৭ এপ্রিল টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলায় একটি পাঠাগারের ৫০০ বই লুটে নেওয়া হয়েছিল। পাঠাগারে যারা বই পড়ছিলেন তাদের ধমকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, এসব বই পড়ে এবং পাঠাগারে এসে যুবকরা নাস্তিক হয়ে যাচ্ছে। কাজেই এই পাঠাগার এখানে তারা চলতে দেবেন না। তারা যে বইগুলো লুটে নিয়েছিলেন তার মধ্যে ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, হুমায়ূন আহমেদসহ দেশিবিদেশি লেখকদের গ্রন্থাবলি। হামলাকারী যুবকরা তাদের ভাষায় নাস্তিক্যবাদের বই পুড়িয়ে ফেলতে চেয়েছিল। ঠিক সেই সময়ে স্থানীয় থানার একজন পুলিশ অফিসার ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছালে তারা বইগুলো না পুড়িয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের অফিসে জমা দিতে সম্মত হয়।
এভাবে বই লুট করা আইনসিদ্ধ কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, মব সৃষ্টির আশঙ্কায় প্রশাসন ধীরসুস্থে অগ্রসর হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে একটি পাঠাগার; যেখানে জ্ঞানচর্চা করা হয়, সেখানে সংরক্ষিত রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের বইও মবোক্রেসির শিকার হতে পারে এ আশঙ্কায় স্থানীয় প্রশাসন পর্যন্ত বিচলিত। এ পরিস্থিতিতে প্রতিকার চাইতে মানুষ কার কাছে যাবে? পরে ইউএনও সাহেবের মধ্যস্থতায় সমঝোতা বৈঠকে লুট করা বইয়ের মধ্যে একটিও নাস্তিক্যবাদের বই না পাওয়ায় বইগুলো লাইব্রেরিকে ফেরত দেওয়া হয়। সে না হয় দেওয়া হলো। কিন্তু যে যুবকরা অজ্ঞানতার অন্ধকারে ডুবে থেকে জ্ঞানের আলো নিভিয়ে দেওয়ার স্পর্ধা দেখাল, তাদের কি জবাবদিহির কোনো প্রশ্ন থাকতে নেই? খবরে পড়েছি, তারা একটি ইসলামি দলের স্থানীয় নেতা-কর্মী। ওই দলই বা এই ধরনের নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে?
কুমিল্লার একটি ঐতিহ্যবাহী পাঠাগারে অগ্নিসংযোগ ও বই লুটপাটের ঘটনা ঘটেছিল গত বছরের ৬ আগস্ট। ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের সেই টালমাটাল সময়ে দেশে কোনো সরকার ছিল না। তখন একশ্রেণির উচ্ছৃঙ্খল মানুষ দেশের নানা স্থানে যাচ্ছেতাই কাণ্ড করেছে। সেই সময়ে এ ধরনের নৈরাজ্যের জন্য প্রশাসনকে দায়ী করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু এই এপ্রিলে যখন নাস্তিক্যবাদের ধুয়া তুলে পাঠাগার লুট করা হলো, তখন কিন্তু শাসন-প্রশাসন সবই ছিল। তার পরও ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এ অপকর্মটি গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়নি। এটাও এক ধরনের সামাজিক রূপান্তর বৈকি। নাস্তিক কিংবা দোসর ট্যাগ দিয়ে যখন-তখন যাকে-তাকে হেনস্তা করার ঘটনাও ঘটছে দেশের নানা স্থানে, নানান অবয়বে।
অন্যদিকে সংস্কারের নামে সময় বয়ে যাচ্ছে। পতিত সরকারের আমলের ক্ষমতার অপব্যবহার, চাঁদাবাজি, মামলাবাজি, স্বজনপ্রীতি- তাও আছে যাহা পূর্বং তাহা পরং। কিন্তু এরূপ অন্যায়-অপকর্মের সঙ্গে যারা অতীতে যুক্ত ছিলেন, তাদের পরিণতি ভালো হয়নি। যে রাজনীতি এসব অপকর্মকে প্রশ্রয় দিয়েছে সেই রাজনীতি জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে বারবার। বারবারই তারা নিক্ষিপ্ত হয়েছে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। তা সত্ত্বেও একই জিনিস নতুন মোড়কে ফিরে এসেছে বারবার। এ যেন এক অপরিবর্তনীয় অচলায়তন।
যত দিন বুদ্ধির মুক্তি না ঘটবে, তত দিন এই অচলায়তন থেকে মানুষের মুক্তি নেই। মুখে এক আর কাজে আরেক কোনো মুক্তবুদ্ধির কাজ নয়; বরং এটা জড়বুদ্ধির নামান্তর।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক