মহান আল্লাহ্ সর্বশ্রেষ্ঠ আশেক ছিলেন হজরত রসুল (সা.)। স্রষ্টা ও তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টির পারস্পরিক অধ্যাত্ম প্রেমের কথা মহাগ্রন্থ আল কোরআন ও হাদিসে বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ এরশাদ করেন, ‘হে মাহবুব (সা.)! আপনি বলে দিন, তোমরা যদি আল্লাহ্কে ভালোবাসতে চাও, তবে আমার অনুসরণ কর। তাহলে আল্লাহ্ তোমাদের ভালোবাসবেন, তোমাদের পাপরাশি ক্ষমা করে দেবেন। অবশ্যই আল্লাহ্ পরম ক্ষমাশীল ও দয়াময়।’ (সুরা আলে ইমরান ৩ : আয়াত ৩১) হজরত রসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের পিতা-মাতা, সন্তানসন্ততি ও অন্য সব মানুষ অপেক্ষা আমাকে বেশি ভালো না বাসবে, সে মোমেন হতে পারবে না।’ (বোখারি শরিফ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭) মুমিন হওয়ার পূর্বশর্ত হলো হজরত রসুল (সা.)-কে সবকিছুর ঊর্ধ্বে ভালোবাসা। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! আল্লাহ ও তাঁর রসুলের প্রতি সাড়া দাও। যখন রসুল তোমাদের এমন কিছুর প্রতি আহ্বান করেন, যা তোমাদের জীবনদান করবে।’ (সুরা আনফাল ৬ : আয়াত ২৪) । হজরত রসুল (সা.) যখন মক্কাবাসীকে এক আল্লাহ্র প্রতি ইবাদতের আহ্বান করলেন, তখন আল্লাহ্র রসুল (সা.)-কে ভালোবেসে একদল আশেকে রাসুল নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেই আহ্বানে সাড়া দিলেন। ওই সব আশেকে রসুল সাহাবিদের আধ্যাত্মিক প্রেমের গভীরতা এত বেশি ছিল যে হজরত রসুল (সা.)-এর জন্য মৃত্যুকে হাসিমুখে বরণ করে নিয়েছেন, তবু মক্কার কাফেরদের কাছে মাথা নত করেননি। দয়াল রসুল (সা.)-কে ভালোবেসে আত্মত্যাগের মাধ্যমে অনেক সাহাবি জগতের বুকে অমর হয়ে আছেন এবং অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন।
হজরত বিলাল (রা.)-এর নাম একজন নিবেদিত আশেকে রসুল হিসেবে উল্লেখযোগ্য। তিনি ছিলেন হাবসি বংশোদ্ভূত কৃষ্ণকায় ক্রীতদাস। তাঁর মনিব ছিলেন কাফের উমাইয়া ইবনে খালফ। হজরত বিলাল (রা.) আল্লাহ্র রসুল (সা.)-কে ভালোবেসে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। হজরত রসুল (সা.)-এর নির্দেশিত পথে চলে তাঁর অন্তরাত্মা সত্যের উজ্জ্বল দীপ্তিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। তাঁর মনিব উমাইয়া ইবনে খালফ যখন জানতে পারল যে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন, তখন সে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়। কাফের উমাইয়া হজরত বিলাল (রা.)-এর ওপর অমানবিক নির্যাতন শুরু করে। ঠিক দুপুরে যখন সূর্য পূর্ণ উষ্ণতা ও তীব্রতা নিয়ে মধ্যগগনে অবস্থান করে, তখন সে হজরত বিলাল (রা.)-কে মরুভূমির গরম বালুর ওপর বুকে পাথর চাপা দিয়ে রাখত। এত নির্যাতনের পরও হজরত বিলাল (রা.) বলতেন, ‘আহাদ’ ‘আহাদ’ অর্থাৎ আল্লাহ্ এক, আল্লাহ্ এক। শত নির্যাতন করেও কাফেররা তাঁকে হজরত রসুল (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা থেকে একবিন্দুও টলাতে পারেনি। আল্লাহ্র রসুল (সা.)-এর প্রতি গভীর ভালোবাসা তাঁর হৃদয়ে ছিল বলেই আজও মুসলিম জাতি তাঁকে আশেকে রসুল হিসেবে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাসে প্রথম মুয়াজ্জিন।
আশেকে রসুল হিসেবে মহিলা সাহাবি হজরত আফিফা (রা.)-এর নাম স্মরণীয় হয়ে আছে। তৃতীয় হিজরিতে কাফেরদের সঙ্গে উহুদ প্রান্তরে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে কাফেরদের নিক্ষিপ্ত পাথরের আঘাতে হজরত রসুল (সা.)-এর দাঁত মোবারক শহীদ হয়। কাফেররা ঘোষণা করল যে মুহাম্মদ (সা.) নিহত হয়েছেন। হজরত আফিফা (রা.) হজরত রসুল (সা.)-এর শাহাদাতের সংবাদ শুনে সহ্য করতে না পেরে উহুদ প্রান্তরের দিকে ছুটলেন। পথিমধ্যে এক সাহাবি বললেন, ‘আফিফা! এই যুদ্ধে তোমার স্বামী শাহাদাতবরণ করেছেন।’ আফিফা (রা.) বললেন, ‘ইন্নালিল্লাহ্’। বল, ‘আমার দয়াল রসুল (সা.) কেমন আছেন?’ কিছুদূর গেলে অন্য এক সাহাবি বললেন, ‘হে আফিফা! তোমার পিতা এই যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন।’ আফিফা (রা.) বললেন, ‘ইন্নালিল্লাহ্’। বল দয়াল রসুল (সা.) কেমন আছেন? আরও কিছুদূর অগ্রসর হলে আরেক সাহাবি বললেন, ‘হে আফিফা! তুমি কি জানো, এই যুদ্ধে তোমার সন্তান ও ভাই শাহাদাতবরণ করেছেন।’ আফিফা (রা.) বললেন, ‘ইন্নালিল্লাহ্। বল দয়াল রসুল (সা.) কোথায় আছেন? কেমন আছেন?’ ওই সাহাবি দুই চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘বোন! তোমার মতো আশেকের জন্যই আল্লাহ্ তাঁর রসুলকে বাঁচিয়ে রেখেছেন!’ এই সংবাদ পেয়ে হজরত আফিফা (রা.) দ্রুত পাহাড়ের চূড়ায় উঠে বললেন, ‘ইয়া রসুলাল্লাহ্! এই যুদ্ধে আমার স্বামী, আমার পিতা, আমার সন্তান, আমার ভাই শহীদ হয়েছেন, কিন্তু আমার মনে কোনো দুঃখকষ্ট নেই, আপনাকে দেখে আমার মনের সব জ্বালা-যন্ত্রণা দূর হয়ে গেছে।’
আল্লাহ্র রসুল (সা.)-এর ধর্ম মোহাম্মদী ইসলামকে রক্ষার জন্য ৬১ হিজরিতে কারবালার প্রান্তরে ইমাম হোসাইন (রা.), তাঁর পরিবার-পরিজন এবং অন্যান্য আহলে বাইত প্রেমিক নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। এই সুমহান আত্মত্যাগ পৃথিবীর বুকে সংঘটিত সব আত্মত্যাগের ঊর্ধ্বে এবং নিঃসন্দেহে সর্বশ্রেষ্ঠ আত্মত্যাগ। এই আত্মত্যাগের মহৎ দৃষ্টান্ত স্থাপন করা সম্ভব হয়েছে হজরত রসুল (সা.)-এর প্রতি গভীর অধ্যাত্ম প্রেমের জন্য। মূলত হজরত রসুল (সা.)-কে ভালোবাসাই হলো ইমান। যে যতটুকু দয়াল রসুল (সা.)-কে ভালোবাসবে, সে ততটুকু ইমানদার।
লেখক : গবেষক, কদর রিসার্চ অ্যান্ড পাবলিকেশন্স; সাবেক সহযোগী অধ্যাপক, পিইউবি