পুরান ঢাকার মিটফোর্ডে লাল চাঁদ ওরফে সোহাগ কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া তিনজনকে শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নৃশংস এই হত্যকাণ্ডের দৃশ্য ভাইরাল হলেও তাদের গতকাল পর্যন্ত শনাক্ত করতে না পারায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। একই সঙ্গে উঠে আসছে মামলার এজাহারে তিনজনের নাম বাদ দেওয়ার প্রসঙ্গটি। যদিও পুলিশের দাবি, কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া ওই তিনজন কারা, তা অনেকটাই নিশ্চিত হওয়া গেছে।
জানা গেছে, একজন যুবনেতার ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিতি ছিলেন নিহত সোহাগ এবং কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া ব্যক্তিরা। পুরান ঢাকার রজনী বোস লেনের সোহানা এন্টারপ্রাইজ নামের দোকানটি নিয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হওয়া আসামি মাহমুদুল হাসান মহিন, টিটন গাজী এবং কামরাঙ্গীরচরের এম এ গাফফারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল সোহাগের। তবে গত জুন মাস থেকে তাদের এড়িয়ে চলছিলেন সোহাগ। ৭ জুলাই সর্বশেষ তর্কাতর্কি এবং হাতাহাতি পর্যন্ত গড়ায়। ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েন মহিন ও টিটন। সিদ্ধান্ত নেন দুনিয়া থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়ার। তবে সোহাগ হত্যাকাণ্ডে ওই যুবনেতার কোনো সিগন্যাল ছিল কি না, তা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হতে পারেননি তদন্তসংশ্লিষ্টরা।
কোতোয়ালি থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) নাসির উদ্দিন বলেন, সোহাগ হত্যার ঘটনায় হত্যা ও অস্ত্র আইনে দুটি মামলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারে চেষ্টা চলছে।
এ ঘটনায় পুলিশ ও র্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার হওয়া সাতজন হলেন মূল হোতা মাহমুদুল হাসান মহিন, তারেক রহমান রবিন, মো. টিটন গাজী, আলমগীর, লম্বা মনির, সজীব বেপারি ও রাজীব বেপারি।
তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, সোহাগকে খুন করার জন্য অস্ত্র সংগ্রহ করা হয়েছিল ছোট মনিরের মাধ্যমে। টিটন গাজীর কাছে ওই যুবনেতার অনেক অস্ত্র রয়েছে। খুনিদের ধারণা ছিল, সোহাগকে মিটফোর্ডের ৩ নম্বর গেটের সামনে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে যদি অনেকে মিলে উল্লাস করা যায়, তাহলে ঘটনাটি মব হিসেবে চালিয়ে দেওয়া যাবে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার মোস্তাক সরকার বলেন, ‘আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি হামলায় অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের। অনেক অগ্রগতিও আছে। শিগগিরই তা জানতে পারবেন।’
তিন আসামির নাম বাদ দেওয়ায় বাদীর ক্ষোভ : নিহত সোহাগের স্বজনরা বলছেন, এজাহার থেকে হামলায় জড়িত থাকা তিনজনের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। আমাদের দেওয়া অভিযোগপত্রে ১৭ নম্বর আসামি হিসেবে আবদুল লতিফ মোল্লার ছেলে কাইউম মোল্লা (৪৫), ১৮ নম্বর আসামি হিসেবে হাবিবুর রহমান হবির ছেলে রাকেশ (৩৫) এবং ১৯ নম্বর আসামি হিসেবে রহিমের (৩৬) নাম উল্লেখ করা ছিল। কিন্তু পুলিশ এজাহার হিসেবে যে অভিযোগপত্রটি গ্রহণ করেছে, তাতে এই তিনজনের নাম নেই বলছেন মামলার বাদী মঞ্জুয়ারা বেগম।
এ বিষয়ে নিহত সোহাগের ভাগনি বীথি বলেন, ‘ওসি মনিরুজ্জামান মনির আমাকে মামলার কপিটি পড়তে বলেছিলেন। আমি তখন ওই কপিটির ছবি ফোনে তুলে রাখি। আমাদের প্রথম যে কপিটা দেওয়া হয়েছিল তাতে ১৭, ১৮, ১৯ নম্বর আসামি ঠিকই ছিল। দ্বিতীয়বার যেটা রেডি করা হয়েছে, তিনটা আসামির নাম কেটে দেওয়া হয়েছে।’
তদন্ত ও অনুসন্ধান কমিটি করবে বিএনপি : মিটফোর্ড এলাকায় সংঘটিত লাল চাঁদ সোহাগ হত্যাকাণ্ডের অন্তর্নিহিত কারণ অনুসন্ধানের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি ‘তদন্ত ও তথ্যানুসন্ধানী কমিটি’ গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। এ কমিটি প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন করবে এবং তা জনসম্মুখে প্রকাশ করবে। রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে গতকাল আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
মির্জা ফখরুল বলেন, মিটফোর্ড হত্যাকাণ্ড নিয়ে যারা রাজনৈতিক পরিবেশ নষ্ট এবং জাতীয় নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত ও অনিশ্চিত করতে চান এবং প্রকারান্তরে ফ্যাসিবাদ উত্থানের পথ কারা সৃষ্টি করতে চান, তাদের চিহ্নিত করা ও প্রতিহত করার প্রত্যয়ও একই সঙ্গে উচ্চারণ করতে চাই। বিএনপির অবস্থান বরাবরের মতোই স্পষ্ট- অপরাধীর কোনো দলীয় পরিচয় থাকতে পারে না। ব্যক্তির অপরাধের সঙ্গে দলের কোনো সম্পর্ক নেই। বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমরা কুণ্ঠিত হই, যখন লক্ষ করি বিকৃত রুচির এই বিকারগ্রস্ত গোষ্ঠী তাদের অশ্লীল-কদর্য মানসিকতা কোমলমতি শিশু- কিশোরদের কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত করিয়ে আমাদের আগামী প্রজন্মের মূল্যবোধ ধ্বংস করছে শুধু তাদের কুৎসিত ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে। মির্জা ফখরুল বলেন, শত বাধা অতিক্রম করে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশের মালিকানা বাংলাদেশের মানুষের কাছে ফেরত দেওয়াই আমাদের একমাত্র অগ্রাধিকার। বিগত ১৭ বছরের দীর্ঘ সংগ্রামে আমাদের কষ্টার্জিত সফলতা ব্যর্থ করার সুযোগ নেই। মির্জা ফখরুল বলেন, দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে ঐক্যবদ্ধ জাতিকে বিভক্ত করার ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ আজ উন্মোচিত। এই অপরাজনীতি প্রতিহত করার ক্ষেত্রে সরকারের উদাসীনতার প্রতি আমরা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করছি। আমরা দৃঢভাবে আশাকরি দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি অবনতির ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে দায়িত্বশীল সব রাজনৈতিক দল সচেতন হবে। রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত এ জাতীয় কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথ বাধাগ্রস্ত হলে তার দায় সংশ্লিষ্টদেরই বহন করতে হবে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান, সালাহউদ্দিন আহমেদ, বেগম সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ ও অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন।