দেশের বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ হয়েছে টেক্সটাইল খাতে। যার পরিমাণ ২৩ বিলিয়ন ডলার বা ২ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। নানা সমস্যায় টেক্সটাইল খাতের উদ্যোক্তারা এখন ছাড়মূল্যে শিল্প কারখানা বিক্রি করতে চান। শুধু তাই নয়, বিগত এক বছরে ২০টিরও বেশি কারখানা বন্ধ হয়েছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৪০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান এখন হুমকিতে পড়েছে। সবমিলিয়ে টেক্সটাইল শিল্প এখন উদ্যোক্তাদের গলার কাঁটা হয়ে গেছে।
শিল্প মালিকরা জানান, বেসরকারি খাতের একক সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ হলো টেক্সটাইল খাতে। সরকার এ খাত নিয়ে কোনো পলিসি গ্রহণ করেনি। বিগত ২৫ বছরে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। এসব কারণে উৎপাদন সক্ষমতা কমেছে আর উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। ডলারের সংকট, টাকার অবমূল্যায়ন, ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের ঘাটতি, ব্যাংক সুদ হার ৯% থেকে ১৫-১৬% পর্যন্ত বৃদ্ধি, রপ্তানির বিপরীতে নগদ প্রণোদনার অস্বাভাবিক কমে যাওয়ায় সংকটে পড়েছে এ খাত। এ ছাড়া ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানিতে সমস্যা ও এলসির জটিলতা এখনো রয়ে গেছে। আয় ছাড়া অগ্রিম কর আদায়। তুলা আমদানির ওপর আরোপ করা ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর (এআইটি)সহ নানা সমস্যায় এখাতের বিনিয়োগে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। তাই কারখানা বিক্রি করতে চায় শিল্প মালিকরা। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন তথ্যে জানা যায়, প্রাইমারি টেক্সটাইল সেক্টরের সর্ববৃহৎ সংগঠন হলো বিটিএমএ। এর সদস্য সংখ্যা ১ হাজার ৮৫৮টি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে স্পিনিং, উইভিং এবং ডাইং-প্রিন্টিং-ফিনিশিং মিল অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। বিগত এক বছরে নানা সমস্যায় ২০টিরও বেশি কারখানা বন্ধ হয়েছে। এ খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা বেসরকারি খাতে একক বিনিয়োগ হিসেবে সর্বাধিক। এ জন্য দেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৫ শতাংশ আসে টেক্সটাইল এবং অ্যাপারেল খাত থেকে। এর প্রায় ৭০ শতাংশের জোগানদাতা টেক্সটাইল খাত। তৈরি পোশাকসহ টেক্সটাইল এবং অ্যাপারেল খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ৭৫ বিলিয়ন ডলার। সরকারের যথাযথ সহযোগিতা পেলে রপ্তানি আয় ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলার করা সম্ভব। বিটিএমএ সহ সভাপতি মো. সালেউদ্ জামান খান বলেন, একটা সময় গ্যাস আমাদের কাছে শক্তি হিসেবে ছিল। গ্যাসের দাম কম থাকায় আমরা ব্যবসায় টিকে ছিলাম। এখন গ্যাসের দাম কয়েকগুণ বেড়েছে। আমাদের প্রণোদনা বন্ধ হচ্ছে। পক্ষান্তরে, পাশবর্তী দেশ রোড ট্যাপ নামে প্রণোদনা দিচ্ছে। আমাদের ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে আগ্রিম আয়কর দিতে হচ্ছে। ইনকাম ছাড়া আয়কর দিতে হয়। আয়কর প্রত্যাহার না হলে পোর্টে তুলার স্তূপ পড়বে।
বিটিএমএ পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘টেক্সটাইল খাতের মালিকরা সব কারখানা আজ বিক্রি করতে চাচ্ছেন। কারখানায় গ্যাস নেই, ব্যাংকে টাকা নেই, অগ্রিম আয়কর সমস্যা। অগ্রিম আয়কর নিলেও পরে সমন্বয় করা হয় না। আয় ছাড়াও অগ্রিম আয়কর দিতে হয়। আমরা ছাড় মূল্যে কারখানা বিক্রি করতে চাই।’ বিটিএমএ পরিচালক প্রকৌশলী রাজীব হায়দার বলেন, আমরা নিত্যদিনই সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। গ্যাসের সমস্যা, বিদ্যুতের সমস্যা, অগ্রিম আয়করের সমস্যা। আমাদের প্রণোদনা কমছে আর পাশবর্তী দেশের টেক্সটাইলে প্রণোদনা বাড়ছে। এদেশের সুতা আর কাপড়ের কলকারখানা বন্ধ হওয়ার পর গার্মেন্ট বন্ধ হবে। আমাদের যদি কারখানা দুই মাসে বন্ধ হয়. গার্মেন্ট এক বছরে বন্ধ হবে। নানা সমস্যায় আমরা আর্থিক বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের কারখানা বন্ধ হলে সব বন্ধ হবে। এ বাস্তবতা এখন না বুঝলে কয়দিন পর বুঝতে হবে। পাশবর্তী দেশের পলিসি আর আমাদের পলিসি দেখলেই বুঝা যায়। বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, গ্যাসের মূল্য দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। বিদ্যুতের মূল্য বেড়েছে, ডলারের সংকট, টাকার অবমূল্যায়নের কারণে ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের ঘাটতি, ব্যাংক সুদের হার ৯% থেকে ১৫-১৬% পর্যন্ত বেড়েছে। রপ্তানির বিপরীতে নগদ প্রণোদনার অস্বাভাবিক কমে গেছে। এসব সমস্যা ছাড়াও প্রতিবেশীসহ অন্যান্য দেশ থেকে কোনো রকম ডিউটি পরিশোধ ব্যতীত অবাধে সুতা আমদানি করা হচ্ছে। ফলে দেশীয় বস্ত্র শিল্পের বিদ্যমান চ্যালেঞ্জে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে এবং মিলগুলো অচিরেই বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে। তিনি বলেন, গত ৭ জুলাইর সভায় অতিদ্রুত তুলা এবং ফাইবার আমদানিতে আরোপিত ২% এআইটি শুল্ক প্রত্যাহারের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হলেও এখনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। সিদ্ধান্ত না নেওয়ায় পার্শ্ববর্তী দেশের সুতা উৎপাদনকারী ব্যবসায়ীরা লাভবান হচ্ছে। পৃথিবীর কোনো দেশেই ইন্টারমিডিয়ারি শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে সাধারণত কোনো ধরনের কর আরোপ করা হয় না।
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল