নির্বাচনি প্রচারণায় পোস্টার ব্যবহার না করার নিয়ম চালু করার প্রক্রিয়া চলছে বলে যে সংবাদ পাওয়া যায়, তার সত্যতা কতটুকু? জানতে চেয়েছেন মকবুল আহমেদ। ৭৫ বছর বয়সি এই ভদ্রলোক পেশায় মুদি দোকানি। গুঁড়ো দুধ, চা-পাতা, চিনি, মুগডাল ইত্যাদি তাঁর দোকান থেকে কিনি। একদা ছিলেন ব্যাংক অফিসার, ওপরের কর্তার সঙ্গে ঘোরতর কাজিয়ার পর ইস্তফা দিয়ে স্বাধীন পেশায় অবতীর্ণ হয়েছেন। বছর সাতেক গভীর নিষ্ঠায় বসে বসে মাল বিক্রি করতে করতে তাঁর মনে হয়েছে স্বাধীনতা শুধু দায়িত্বশীলতাই নয়, এটা দুঃসহ এক যন্ত্রণাও।
শরীরে রক্তের স্বেচ্ছাচার, কোমরের অস্থিসন্ধিতে শিরশির বেদনা এবং অন্যান্য মৃদুব্যাধি মকবুল আহমেদকে ইদানীং অস্বস্তিতে ফেলছে ঘনঘন। তাই নিয়মিত দোকানে বসেন না। পুরোনো কর্মচারী শিবলি সব সামলায়, মাঝেমধ্যে শিবলিকে সহায়তা করেন মকবুলের বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছেলে আরমান। যেদিন পোস্টারবিষয়ক প্রশ্ন করেন মকবুল, সেদিনও তাঁর গায়ে জ্বর। ধুম বৃষ্টি হচ্ছিল। আমাকে যখনই পান, তখনই সারা দুনিয়ার ঘটনাবলির ইতি-নেতি জানার জন্য উতলা হওয়া তাঁর অভ্যেস। প্রতিকারস্বরূপ আমিও প্রয়োজনীয় পণ্য দ্রুত সংগ্রহ করে কেটে পড়লাম মতলবে থাকি আর বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে উচ্চারণ করি-‘হ্যাঁ, ঠিকই তো, অবশ্যই এবং কনফার্মড হয়ে আপনাকে জানাব।’
পোস্টারসংক্রান্ত জিজ্ঞাসার উত্তরে তাঁকে জানাই যে তাঁর মতোই আমারও কানে এসেছে-‘পোস্টার বিনা প্রচারকর্ম চালানোর বিধান আসছে।’ মকবুল বলেন, পোস্টার ব্যান করে দিয়ে গানে গানে প্রচারণার ব্যবস্থা করা উচিত। এতে গায়কদের আয়-রোজগার বাড়বে। গীতিকবিতা যাঁরা রচনা করেন, তাঁদের প্রতিভা বিকশিত হবে। সুরকারের হাতেও বাড়তি দু’পয়সা এসে যাবে। সবচেয়ে বড় কথা ভোটাররা মাগনায় পেয়ে যাবে গীতিবিনোদন।
মকবুল তাঁর কৈশোরে ‘মাগনায় পাওয়া’ সংগীত বিনোদনের কিছু উদাহরণও সুরে সুরে উপস্থাপন করলেন। শুনে মনে হলো, এই মুদি দোকানি অবশ্যই ভূতপূর্ব কণ্ঠশিল্পী। বলেছি, কণ্ঠস্বর যেভাবে ওঠালেন-নামালেন সেভাবে তো পেশাদার গাইয়েরা করে থাকেন। মকবুল স্বীকার করলেন, স্কুলজীবনে গানের পোকা তাঁর মগজে কিলবিল করেছে। বীরেণ ভদ্র নামে এক শিক্ষক ছিলেন তাঁর গুরু। বীরেণ স্যার বলতেন, গানের গলা ঈশ্বর সবাইকে দেন না। যাদের দেন, তাদের সেটা যত্ন করতে হয়। অবহেলায় ধনরাশি যেভাবে নিশ্চিহ্ন হয়, কণ্ঠের ঐশ্বর্যও সেভাবে দিনে দিনে ক্ষয়ে যায়।
আমারও ক্ষয়ে গেছে। কণ্ঠের ঐশ্বর্যকে যে অবহেলা করছি সেই বোধও আমার ছিল না। বলেন মকবুল। তিনি জানান, বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পীর গাওয়া গানগুলো অনায়াসে নিজের গলায় তুলে নেওয়ার সক্ষমতা তাঁকে নিজ এলাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় প্রিয়মুখ করে ফেলে।
নানা প্রতিষ্ঠানে ফাংশনে গাইবার ডাক পেতেন। অনুষ্ঠান উদ্যোক্তারা টাকা-ভরা খাম জোর করে তাঁর পকেটে ঢুকিয়ে দিতেন। বীরেণ স্যার বলায় একবার মাদারীপুরে গিয়ে এক ফাংশনে পরপর গাইলেন ১০টি গান। একটি ছিল মান্না দে’র ‘চাঁদের আশায় নিভিয়েছিলাম যে দীপ আপন হাতে/ অন্ধ পরাণ খুঁজিছে তাহারে জীবনের আঙিনাতে।’
এই গানে মুগ্ধ হয়ে ব্যবসায়ী আমজাদুল হক ৫০০ টাকা উপহার দেন মকবুলকে (১৯৭৪ সালে)। শুধু তা-ই নয়, পরদিন তাঁর বাড়িতে দুপুরে খাওয়ার দাওয়াত। ব্যবসায়ীর বাড়িতে খাওয়াদাওয়ার পর তাঁর দিকে হারমোনিয়াম এগিয়ে দেওয়া হয়। সুকণ্ঠী এক তরুণী অনুরোধ জানায়, ‘হার মানা হার পরাব তোমার গলে’ গাইবার জন্য। তরুণীর সঙ্গে পরিচয় হলো। নাম ইভা, সম্পর্কে মেজবানের ভাগনি, পড়ে দশম শ্রেণিতে। মকবুল গাইলেন এবং জয় করলেন ইভাকে। ব্যাংকে চাকরি নেওয়ার পর বিয়ে করলেন প্রেমিকাকে।
চাকরিতে উন্নতি করার নেশায় দিনরাত মেহনত করতে থাকেন মকবুল। গানের রেওয়াজ হয়ে যায় অনিয়মিত। চাকরির ব্যস্ততা সত্ত্বেও গাইতে ডাক পাওয়া ও গাওয়া চলছিল। একবার এক কলেজ ছাত্র সংসদের অভিষেক অনুষ্ঠানে পরপর তিনটি গান গাওয়ার পর হেমন্ত মুখার্জির গান গেয়ে শোনানোর অনুরোধ এলো। মকবুল শুরু করলেন, ‘ওগো যা পেয়েছি সেইটুকুতে খুশি আমার মন/ কেন একলা বসে হিসেব কষে নিজেরে কাঁদাই অকারণ।’ গানের অন্তরা-‘জল ভরিতে পিছল ঘাটে কেউ না আসে যদি/ যায় কি থেমে নদী...’ পর্যন্ত গাইতেই শ্রোতাদের একাংশ আওয়াজ তোলে ‘নদী থামনের কাম নাই, তুমি থাইম্মা যাও।’
শ্রোতাদের দোষ ছিল না। দোষ গায়কের। তিনি আর সুরের মায়ায় গানের চরণগুলো আটকে রাখতে পারেননি। গলা দিয়ে বেরোনো আওয়াজে ছিল না কোনো মোহন কারুকাজ। ‘থেমে গেলাম আমি’ বলেন মকবুল, ‘ফাংশনে গাওয়া ছেড়ে দিলাম। সন্তানদের গান শেখাতাম। শেখাতে গিয়ে টের পাই আমি আর সেই আমি নাই। তাই গানের টিচার নিয়োগ দিলাম সন্তানদের জন্য।’
গানে গানে ভোটের প্রচারণার যেসব নমুনা শুনিয়েছিলেন মকবুল, তার অন্যতম ছিল ‘চেরাগ আলী চেরাগ আলী/ জানি তোমার মাথা খালি/ মরদ হইয়া কানে ঝুলাও আস্ত দুইখান রুপার বালি/ তুমি একটা অর্দ্ধ-কন্যা এই সমাজের জ্বালা/ তোমারে ভোট দিবার আগে মোদের মরণ হওয়া ভালা॥’
পাকিস্তানি জমানায় ১৯৭০ সালে হওয়া সাধারণ নির্বাচনের আগে জহির রায়হান পরিচালিত ‘শেষ পর্যন্ত’ ছবিতে ভোট প্রার্থনার একটি দৃশ্যে ব্যবহৃত গানটি এখনো মনে আছে। কণ্ঠশিল্পী ছিলেন আবদুল লতিফ। ছবিতে দেখি, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সমর্থকরা পোস্টার হাতে মিছিল করছে। মিছিলে সবার সামনে থাকা লোকটি গাইছে-‘ভোট চাই ভোট চাই ভোট চাই/ ভোট দিলে যা চান তা পাবেন ভাই।’ সঙ্গে সঙ্গে মিছিলকারীরা গায়-‘ভোট চাই ভোট চাই...।’ সামনের লোকটি গায়- ‘বাড়িঘর করে দেব ফিটফাট/ সোনা দিয়ে মুড়ে দেব পথঘাট।’ তাকে অনুসারীরাও একই বাণীতে গলা মেলায়।
সোনায় মোড়া পথঘাটের স্বপ্ন দেখানো আর স্বপ্ন দেখার কাজ চলেছে, চলছে এবং মনে হয় চলতি শতকের পরবর্তী শতকগুলোয়ও চলবে। কারণ বাঙালি রূপকথা শোনার জন্য ব্যাকুল। ওটা না শুনতে পেলে তার হজমশক্তি এলোমেলো হয়ে যায়।
মধুময় হার : সংগীতচর্চাকে কেন্দ্র করে উপভোগ্য যেসব কাহিনি প্রচলিত তার একটির মূল হয়ে আছেন সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি। যুদ্ধাভিযানে গিয়ে দক্ষিণ ভারতে তাঁর সৈন্যরা লুটতরাজ চালিয়ে দিল্লিতে নিয়ে আসে মূল্যবান অনেক জিনিসপত্র। সুলতানের নির্দেশে তারা নায়ক গোপাল নামে গুণধর এক কণ্ঠশিল্পীকেও নিয়ে এসেছিল। ‘লুণ্ঠিত আলো’ গোপাল প্রমাণ করেছিলেন, উত্তর ভারতে তাঁর সমকক্ষ কেউ নয়।
আলাউদ্দিন খিলজির মন ভরছিল না। গোপালের প্রতিভা যাচাই করার উদ্দেশ্যে তিনি তাঁর দরবারে দিল্লির ‘সুরসাগর’ আমীর খসরুর সঙ্গে প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। সেখানে তিন দিন ধরে গাইলেন গোপাল। সিংহাসনের আড়ালে বসে নীরবে কান পেতে গোপালকে শুনলেন খসরু। এরপর খসরু কোনো বাণী ছাড়াই অর্থহীন আওয়াজ (তারানা) দিয়ে গোপাল উচ্চারিত সুরগুলো চমৎকার ফুটিয়ে তুললেন। দরবার ভর্তি শ্রোতারা উল্লাসে ফেটে পড়ে। সামান্য বিরতি নিয়ে এবার আমীর খসরু পরিবেশন শুরু করলেন তাঁর নিজের সুরারোপিত গান।
কয়েকটি গান শোনার পরই নায়ক গোপাল সহাস্যে এগিয়ে গিয়ে নতমস্তকে অভিবাদন জানান খসরুকে। বলেন, আজকের দিনটি আমার জীবনের সবচেয়ে মধুময় দিন। ওস্তাদজীর সামনে এই গোপাল বালুকণাও নয়। পরাজয় এত মধুর হতে পারে, এটা আমার জানা ছিল না।
সম্পদের সদ্ব্যবহার : গাইবার শক্তিকে বিরাট সম্পদ বলে মানা হয় বিশ্বের সর্বত্র। বলা হয়, এ সম্পদের সদ্ব্যবহার অপরিহার্য। যেহেতু শক্তিটি গলায় থাকে সেহেতু গলা দিয়ে খাদ্য গ্রহণের মাত্রাটা নিয়ন্ত্রিত রাখা চাই। সেজন্য গুরুভোজন থেকে শত হস্ত দূরে থাকা বাধ্যতামূলক। গানের ওস্তাদ আর শাগরেদরা কঠোরভাবে এই পন্থা অবলম্বনে অভ্যস্ত। ব্যতিক্রম নুসরত ফতেহ আলি খান (জন্ম : ১৩ অক্টোবর, ১৯৪৮-মৃত্যু : ১৬ আগস্ট, ১৯৯৭)। সুফি কাওয়ালি, চলচ্চিত্রের নেপথ্য সংগীত, সিনেমার গানে সার্থক সুরারোপ তাঁকে দিয়েছে অশেষ সুখ্যাতি। কাচ্চি বিরিয়ানি পায়া আর ঝাল গোশ্ত পেলেই গপাগপ খেয়ে ফেলতেন। তা সত্ত্বেও বিধাতা নুসরতের কণ্ঠ-ঐশ্বর্যকে আমৃত্যু অটুট রেখে দিয়েছিলেন।
তাঁর মনটা ছিল খুবই সাদা। যা অনুভব করতেন বলে ফেলতেন। চিত্রতারকা ঐশ্বরিয়া রায়কে দেখে বিস্ময়বিমূঢ় নুসরত বলেন, ‘আপনি এত সুন্দর! সব কাজ ফেলে তাকিয়ে থাকার ইচ্ছা জাগে।’ মাধুরী দীক্ষিতের সশব্দ হাসিকে তিনি মনরাঙানো ঐশ্বরিক সুরধ্বনি বলে অভিহিত করেছিলেন। গানের বাণীকে নুসরত ফতেহ আলি খান নিজের আত্মার বাণী করে নেওয়ার অনুপম ক্ষমতা রাখতেন। দুঃখের গান গাইতে গাইতে তিনি কাঁদতেন। তাঁর ক্রন্দনসিক্ত গান শ্রোতাদের মনে করিয়ে দেয় রোমান্টিক ইংরেজ কবি শেলির উপলব্ধি- ‘মধুরতম গীত সেগুলো, যেগুলোয় থাকে বেদনায় মোড়া চিন্তার ফলন।’ ভারতীয় ছবি ‘ধড়কন’-এ গাওয়া নুসরতের ‘দুলহে কা সেহরা’ আর ‘খামোশি’ ছবিতে কিশোর কুমারের গাওয়া ‘ও শাম কুছ আজিব থি’, শুনে আমার কেবলই মনে হয়, একেই বলা যায় শেলির মধুরতম গীত। দুলহে কা সেহরা রেকর্ডিংয়ে সমস্যা হয়েছিল। গানটি টেক্ করার মাঝপথে নিজের মেয়ের কথা ভেবে চার চারবার কান্নায় ভেঙে পড়েন নুসরত। পঞ্চম টেক্ ‘ওকে’ হয়েছে।
তেজস্বী রানী : বাংলাদেশ বেতারের প্রাক্তন মহাপরিচালক এম এন মুস্তাফার মুখে কলকাতা নগরীর সংগীতকলাবিষয়ক অনেক গল্প শুনেছি। তিনি জানান, ‘গানের রাজধানী ছিল লাখনো নগরী, কলকাতা ছিল ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী। তাই লাখনোর গানের রানীরা (মানে নাচ-গানে পারদর্শী বাঈজী) তহবিলকেন্দ্রিক সুখসন্ধানে কলকাতায় ভিড় জমাতেন। রানীদের কেউ কেউ ছিলেন ভয়ানক রূপাঢ্য। এঁদের মধ্যে ছিলেন বাঈজী গওহরজান। রটনা আছে গওহরজানের গাত্রবর্ণ এতটাই স্বচ্ছ ছিল যে তিনি পান চিবিয়ে রস যে খাচ্ছেন তা তাঁর গলা দেখে বোঝা যেত। বিস্তর আয় তাঁকে দিয়েছে বিলাসী জীবন। চলাফেরা করতেন ৪-ঘোড়ায় টানা গাড়িতে। সরকারি নিয়ম ছিল নাগরিকরা ২-ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করবেন। একবার গওহরজানের গাড়ি আটকায় ট্রাফিক পুলিশ সার্জেন্ট। বলে, ৪-ঘোড়ার গাড়িতে চড়বেন শুধু লাট সাহেব (গভর্নর)। আপনি নেমে যান। যেখানে যাবার হেঁটে যেতে হবে আপনাকে। গওহরজান বলেন, ‘ডাকো তোমার লাট সাহেবকে। উনি নিজে এসে আমায় মিনতি করলে তবে নামব। তার আগে কখনো নয়।
বিফল সাধনা : গান গেয়ে নাম কামানোর বাসনা ছিল আমাদের মেস-জীবনের সখা মুরাদ মনোয়ারের। বিশেষ এক ঘটনার মুখোমুখি হয়ে তিনি সংগীতসাধনায় ইতি টেনেছেন। কিন্তু ‘ঘটনাটি কী’ সেটা তিনি খোলাসা করেননি। আমরা যা অনুমান করি তা সম্ভবত স্মার্ট যুবক সগীর মুন্সীর মামলার মতোই।
সগীর গানের তালিম নেয় আর তার প্রতিভার স্তর নিরীক্ষণ পর্যায়ে নানাজনকে গেয়ে শোনায়। যিনি-ই শোনেন তিনিই মন্তব্য করেন, ‘থামলে তো ভালোই লাগে’। হতোদ্যম হয় না সগীর। সাধনা চলতেই থাকে। লন্ডনপ্রবাসী চাচা দেশে এলে তাঁর সামনে সংগীত পরিবেশন করল সগীর। চাচার মন্তব্য : তোর গান শুনে সালাউদ্দিনের কথা মনে পড়ে গেল।
‘সালাউদ্দিন!’ বিস্মিত সগীর বলে, ‘উনি তো ফুটবল স্টার। গায়ক মনে করছেন কেন?
চাচা বলেন, সো হোয়াট? তুইও তো মনে করছিস তুই গায়ক।
লেখক : সাংবাদিক