১৫ জুলাই, ২০২৪। দিনভর সারা দেশে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর চলে ছাত্রলীগের ভয়াবহ নির্যাতন। সংঘাত-সংঘর্ষে পুরো বাংলাদেশ পরিণত হয় যুদ্ধক্ষেত্রে। এদিন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘আত্মস্বীকৃত রাজাকারদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের জবাব দিতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট।’ ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশ পেয়েই কি না কোটা সংস্কার আন্দোলনে একাত্ম হওয়া সারা দেশের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর অল আউট অ্যাকশনে যায় আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনটি। হেলমেট পরে নিরস্ত্র সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। তাদের ককটেল বিস্ফোরণ, লাঠি-রড-রামদার আঘাত আর অবৈধ বন্দুকের গুলিতে সারা দেশে প্রায় ৫ শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। আহতরা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে সেখানেও হামলা চালায় ছাত্রলীগ।
এদিন দুপুর ১২টা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, অধিভুক্ত সাত কলেজের কোটা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে জড়ো হন। বিকাল ৩টার দিকে কোটা আন্দোলনকারীরা বিজয় একাত্তর হলে ছাত্রলীগের আটকে রাখা শিক্ষার্থীদের আনার জন্য হলপাড়ায় মিছিল নিয়ে যান।
ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানের নির্দেশে এ সময় রড, হকিস্টিক, রামদা নিয়ে হামলা করে ছাত্রলীগ। শিক্ষার্থীরা হামলার পাল্টা জবাব দিলে শুরু হয় সংঘর্ষ। ছাত্রলীগের হামলার মুখে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে ভিসি চত্বর এলাকায় অবস্থান নেন। পরে ছাত্রলীগ ভিসি চত্বর এলাকায়ও হামলা চালায়। এ সময় দিগি¦দিক ছোটাছুটি করেন শিক্ষার্থীরা। বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী ভিসি চত্বরে দাঁড়িয়ে থাকা বাসের মধ্যে আশ্রয় নেন। তাদের বাস থেকে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে লাঠিপেটা করেন ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা।
এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বত্র কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সাত কলেজ, মহানগর শাখার নেতা-কর্মীদের মহড়া দিতে দেখা যায়। রাজু ভাস্কর্যে অবস্থানের পাশাপাশি মধুর ক্যান্টিনে তারা আলোচনা ও বৈঠক করেন।
এ হামলায় অর্ধশতাধিক নারী শিক্ষার্থী আহত হন। আহত হন বেশ কয়েকজন সাংবাদিক। ছাত্রলীগের ধাওয়ায় ঢাকা মেডিকেল ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা। বিকালে ঢাকা মেডিকেল ও শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে আহত শিক্ষার্থীদের ওপর পরপর কয়েক দফা হামলা করেন ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা। এ সময় অনবরত ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয় শহীদুল্লাহ হলের সামনে।
ঢাবির রাজু ভাস্কর্য, দোয়েল চত্বর, জিয়া হল, শহীদুল্লাহ হল, বিজয় একাত্তর হলে ছাত্রলীগের কর্মীরা কোটাবিরোধী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। বাংলাদেশ প্রতিদিনের সিনিয়র ফটো জার্নালিস্ট রোহেত রাজীবের ক্যামেরায় ধারণ করা ছাত্রলীগের লাঠির আঘাতে এক নারী শিক্ষার্থীর রক্তাক্ত ও আতঙ্কিত মুখের ছবি ভাইরাল হয় নেট দুনিয়ায়। এ ছাড়া ইডেন কলেজের ভিতরে ছাত্রলীগের হামলায় অনেক ছাত্রী আহত হন। ছাত্রীরা যেন আন্দোলনের যেতে না পারে সেজন্য কলেজের গেটে তালা মেরে দেওয়া হয়। তালা ভেঙে মিছিল নিয়ে ছাত্রীরা রাজু ভাস্কর্যের দিকে অগ্রসর হন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) শিক্ষার্থীদের মিছিল বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে রাজু ভাস্কর্যে এসে উপস্থিত হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর দুই দফায় হামলা চালায় ছাত্রলীগ। চবির সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফিকে তুলে নিয়ে যায় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দিয়ে ক্যাম্পাসজুড়ে মহড়া চালায় ছাত্রলীগ। মধ্যরাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা ধাওয়া দিয়ে ছাত্রলীগকে ক্যাম্পাস ছাড়া করে।
সন্ধ্যায় কুমিল্লার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা একত্র হয় জিলা স্কুল প্রাঙ্গণে। কুমিল্লা মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি নুর মোহাম্মদ সোহেলের নেতৃত্বে তাদের ধাওয়া দিয়ে জিলা স্কুল ভবনের বিভিন্ন কক্ষে ঢোকানো হয়। এরপর এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে নির্যাতন চালায়। এ ছাড়া ছাত্রলীগের হামলার ঘটনা ঘটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও অনেক ক্যাম্পাসে। এসব হামলার প্রতিবাদে ওইদিন রাতে পরদিন ১৬ জুলাইয়ের কর্মসূচি হিসেবে সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ-সমাবেশের ঘোষণা দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।