ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের জন্য এখন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ ছাড়া আরপিও সংশোধন নিয়ে রাজনৈতিক মহলেও চলেছে ব্যাপক আলোচনা।
ইসির কর্মকর্তারা বলছেন, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের অনেক সুপারিশই ইসির বিবেচনায় রয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত কোন কোন সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়, তার ভিত্তিতে আরপিও চূড়ান্ত করবে ইসি। সেজন্য চলতি মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করবে কমিশন। যদিও আরপিও সংশোধনীর একটি খসড়াও তৈরি করা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন যেসব সুপারিশ করেছে, তার বাস্তবায়ন নিয়ে গত ৮ জুলাই জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ও নির্বাচন কমিশনের মধ্যে বৈঠক হয়।
এরপর গত বৃহস্পতিবার আরপিও সংশোধনের সুপারিশসহ একগুচ্ছ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের বৈঠক হয়েছে। সিইসি ও নির্বাচন কমিশনাররা আরপিও নিয়ে একাধিক সুপারিশ আরও পর্যালোচনা করে তা চূড়ান্ত করবেন।
নির্বাচন কমিশনার আবদুর রহমানেল মাছউদ শনিবার বলেন, আরপিও নিয়ে কমিশনে পর্যালোচনা চলছে। সংস্কার কমিশনের যেসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করা যায়, সবকিছু আমরা রাখতে রাজি আছি। ঐকমত্য কমিশনের মতামত প্রাধান্য দিচ্ছি আমরা। ইতোমধ্যে ‘না’ ভোট ফেরানো এবং ‘না’ ভোটের সংখ্যা বেশি হলে নতুন নির্বাচন আয়োজন, এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ কটি আসনে মনোনয়নপত্র নিতে পারবেন, প্রার্থীর যোগ্যতা-অযোগ্যতা ও হলফনামার মতো বিষয়ে দলগুলো ঐকমত্য রয়েছে। ইসি আবদুর রহমানেল মাছউদ বলেন, কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন যেসব সুপারিশ দিয়েছে, তাতে জনমতের প্রতিফলন থাকা দরকার এবং ঐকমত্যের বিষয়টি ইসি বিবেচনায় নিচ্ছে।
ভোটের দিন ছাড়াও নির্বাচনের যে কোনো পর্যায়ে বলপ্রয়োগ, চাপ সৃষ্টি, অপকর্মের প্রমাণ পেলে কেবল কেন্দ্র নয়, পুরো নির্বাচনি এলাকার ভোট কার্যক্রম বন্ধের ক্ষমতা ইসির হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার সুপারিশ আছে।
আরপিও নিয়ে যত আলোচনা
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশের আলোকে নির্বাচন কমিশন আরপিও সংশোধনীর জন্য যেসব বিষয়ে আলোচনা করছে তা হলো- আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিদ্যমান সংজ্ঞায় পুলিশ বাহিনী, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন, আনসার বাহিনী, ব্যাটালিয়ন আনসার, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড, বিএনসিসির নাম রয়েছে। এখন সশস্ত্র বাহিনী বা প্রতিরক্ষা কর্ম বিভাগের নাম যুক্তের বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে। রিটার্নিং অফিসারের কাছে সরাসরি মনোনয়নপত্র জমার পাশাপাশি অনলাইনে জমার ব্যবস্থা করা নিয়ে সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পাশাপাশি ইসিও তা নিয়ে আলোচনা করছে। সংসদে প্রার্থী হতে ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা রাখার সুপারিশ রয়েছে সংস্কার কমিশনের। তা নিয়ে ইসিও আলোচনা করছে। বর্তমানে প্রার্থী হতে কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা লাগে না, স্বশিক্ষিত ব্যক্তিও ভোটে প্রার্থী হতে পারেন। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা রাখায় তা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়।
এদিকে একজনের সর্বোচ্চ দুটি আসনে নির্বাচন করার প্রস্তাব রাখতে চায় ইসি। অবশ্য সংস্কার কমিশন কেবল একটি আসনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব রেখেছে। বর্তমানে তিন আসনে ভোট করার সুযোগ রয়েছে। প্রার্থীকে অন্তত ‘না’ ভোটের সঙ্গে যাতে লড়াই করতে হয় সে সুপারিশ করা হয়েছে সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে। কোনো আসনে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের পর একক প্রার্থী থাকলে তাকে না ভোটের সঙ্গে লড়তে হবে। আবার কোনো আসনে না ভোট সবার চেয়ে বেশি পড়লে; আবার নির্বাচন হতে হবে এমন বিষয় আরপিওতে রাখা না রাখা নিয়ে ইসি পর্যালোচনা করছে।
প্রবাসীদের জন্য তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা সূচক পোস্টাল ভোটিং ব্যবস্থা বিবেচনায় রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভোটারকে অনলাইন নিবন্ধনের মাধ্যমে আগ্রহের কথা জানাতে হবে। ভোটের প্রচারে বিলবোর্ড সংযোজন করা হয়েছে। নতুন আচরণবিধিতে বিষয়টি যুক্ত করেছে ইসি। সে আলোকে আরপিওতে যুক্ত করার খসড়া প্রস্তাব করতে যাচ্ছে ইসি।
ভোট সামনে রেখে নির্বাচনি আইন, বিধি, প্রবিধি ও নীতিমালা প্রণয়ন, পরিমার্জন, পরিবর্ধন সম্পর্কিত কার্যাবলি সম্পাদন এবং ইলেকটোরাল ইনকোয়ারি কমিটির তদারকির দায়িত্বে রয়েছেন নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ। তিনি বলেন, সংশোধিত আরপিওতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীকে যুক্ত করা হবে। তবে প্রার্থীদের প্রচারণা ইসি করে দেওয়ার প্রস্তাবের সঙ্গে অর্থ সংস্থানের বিষয় রয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের যে সংলাপ চলছে, তাতে ‘না’ ভোটের বিষয়টি এখনো আলোচনা হয়নি। এ ক্ষেত্রে ঐকমত্য হলে তা বিবেচনায় নেবে ইসি। ইসি মাছউদ বলেন, ভোটে অনিয়ম হলে আইন সাপেক্ষে পুরো আসনের কার্যক্রম বন্ধের সুপারিশ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভোটের দিনের পরিবর্তে ‘নির্বাচন’ শব্দটি প্রতিস্থাপনের বিষয়টি হবে। তাতে আগের মতো ক্ষমতা পাবে ইসি। তিনি বলেন, হলফনামার মিথ্যা তথ্য নিয়ে দুই ধরনের বিষয় রয়েছে। ঋণখেলাপি হলে তা যোগ্যতা-অযোগ্যতার সঙ্গে সম্পৃক্ত। আর সম্পদের তথ্যে গরমিল থাকলে তা নিয়ে প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা হবে।
ইসি আবদুর রহমানেল মাছউদ বলেন, ‘আমরা এখন অপেক্ষা করছি, ঐকমত্যের ভিত্তিতে যেসব বিষয় আসবে, সেগুলো এখানে সংযুক্ত করব। এজন্য টাইমও দিয়েছি। আরেকটু দেখে চূড়ান্ত করব।’ জুলাইয়ের মধ্যে ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্ত হলে ইসির জন্য সুবিধা হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।