রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের বন্দুকের সামনে যেভাবে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তা দেখে স্তম্ভিত হয়ে যায় পুরো বিশ্ব। তাঁর মৃত্যুতে পাল্টে যায় আন্দোলনের গতিপথ। আবু সাঈদের মৃত্যুতে কেঁপে ওঠে শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী মসনদ।
আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও তাদের সমর্থকদের হামলায় ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই আবু সাঈদের পাশাপাশি সারা দেশে আরও পাঁচজন শহীদ হন। আহত হন অসংখ্য ছাত্র-জনতা। জেলায় জেলায় সংঘর্ষ, বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে সারা দেশ। দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক-মহাসড়ক ও রেলপথ অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। বগুড়ায় আওয়ামী লীগের অফিসে আগুন দেয় আন্দোলনকারীরা। একদিকে সমগ্র দেশের ছাত্র-জনতা আর অন্যদিকে আওয়ামী সরকার, তাদের সমর্থক গোষ্ঠী এবং প্রশাসন। স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরাও এদিন আন্দোলনে যোগ দেয়।
নিষিদ্ধ ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজু ভাস্কর্যের সামনে আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘আন্দোলন যাবে, আন্দোলন আসবে। কিন্তু ছাত্রলীগ আছে, ছাত্রলীগ থাকবে। সবকিছু মনে রাখা হবে। সবকিছুর জবাব দেওয়া হবে।’ আন্দোলনের নামে ধ্বংসাত্মক কাজ কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ার করেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। ওইদিন আন্দোলনে ঢাকায় শহীদ হন নিউমার্কেট এলাকার হকার মো. শাহজাহান এবং নীলফামারীর যুবক সবুজ আলী। চট্টগ্রামে শহীদ হন চট্টগ্রাম কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ও কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ওয়াসিম আকরাম, এমইএস কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ফয়সাল আহমদ শান্ত এবং স্থানীয় ফার্নিচার দোকানের কর্মচারী মোহাম্মদ ফারুক। ১৬ জুলাই মধ্যরাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়করা পরদিন ১৭ জুলাইয়ের কর্মসূচি হিসেবে সারা দেশে কফিন মিছিল এবং গায়েবানা জানাজা কর্মসূচি ঘোষণা করে।
অবস্থা বেগতিক দেখে এবং আন্দোলন দমাতে সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে শেখ হাসিনা সরকার। শিক্ষার্থীদের অবিলম্বে হল ত্যাগের নির্দেশ জারি করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সারা দেশে মোতায়েন করে বর্ডার গার্ড। এর আগে দুপুর ৩টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বিভিন্ন হল থেকে আন্দোলনকারীরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জড়ো হতে থাকেন। ঢাবি ছাড়াও অধিভুক্ত সাত কলেজ এবং আশপাশের পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা শহীদ মিনারে জড়ো হন। বহিরাগত সন্ত্রাসীদের সঙ্গে নিয়ে সেখানে তাদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায় ছাত্রলীগ। আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ করে ছাত্রলীগের ছোড়া ককটেল ও বোমার আঘাতে আহত হন অনেক শিক্ষার্থী। আন্দোলনকারী এবং ছাত্রলীগের মধ্যে কয়েক দফা ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকা দখলে নেয় আন্দোলনকারীরা। ছাত্রলীগ পিছু হটে।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর ‘রাজাকার’ বক্তব্য প্রত্যাহার, কোটা সংস্কার এবং ছাত্রলীগের হামলার বিচার দাবিতে বিকাল সাড়ে ৩টায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। অবরোধে অংশ নেয় বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রায় ৮ হাজার শিক্ষক-শিক্ষার্থী।
হলের তালা ভেঙে আন্দোলনে নামে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষার্থীরা। ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে রাবির বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের আবাসিক হল- বঙ্গবন্ধু হলে আগুন লাগিয়ে দেয়।
এদিকে, শহীদ আবু সাঈদের আত্মত্যাগের এ দিনটিতে স্মরণীয় করে রাখতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি)-সহ বিভিন্ন সংগঠন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বেরোবিতে আজ পালিত হবে আবু সাঈদের শাহাদাতবার্ষিকী ও ‘জুলাই শহীদ দিবস’।