তিস্তার চরের সাহিদাকে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় ১১ বছর বয়সে বিয়ে দেন তার বাবা। বিয়ের প্রথম বছরেই তিনি জন্ম দেন একটি কন্যা সন্তান, পরের বছরে আরেকটি। সর্বশেষ এক মাস আগে জন্ম দেন ৩য় পুত্র সন্তানটি। শিশু বয়সে বিয়ে, একের পর এক সন্তান জন্ম দেয়ার কারণে অপুষ্টি আর রোগে সাহিদার এখন কাহিল অবস্থা।
সর্বশেষ যে শিশুটির জন্ম হয়েছে তার ওজনে অনেক কম। এখন মস্তিষ্কে বিকৃতি দেখা দিয়েছে সাহিদার। কাউকে কিছু না বলে কোলের সন্তান নিয়ে বেরিয়ে যায় এদিক-ওদিক। আবার মাঝে মাঝে ভালো আচরণ করে। শিশু বয়সে বিয়ে দিয়ে ভুল করেছেন তা স্বীকার করেন তার পিতা সাইয়েদ আলী।
সে জানায়, শুধু তার মেয়ে নয়, নাতিটিও ভুগছে নানা রোগে। ব্র্যাকের স্ব্যাস্থকর্মী কোহিনুর জানান, সাহিদা ও তার সন্তান উভয়ে ভুগছে অপুষ্টিতে। তিস্তার চরের চরনাজিরদহ গ্রামের দরিদ্র পরিবারের কন্যা আনিছার বিয়ে হয় ১২ বছর বয়সে। বিয়ের দেড় বছরের মাথায় একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। কিন্তু সন্তানটি প্রতিবন্ধী। পরের বছর আরেকটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। গর্ভকালীন আনিছা অপুষ্টিতে ভোগার কারণে তার সর্বশেষ জন্ম নেয়া শিশুটির ওজন অনেক কম হয়েছে। মা ও শিশু উভয়েই এখন রোগাক্রান্ত।
একই গ্রামের মিনারা বেগমের বিয়ে হয় ১২ বছর বয়সে, এখন তার বয়স ১৮ বছর। বর্তমানে সে ৪ সন্তানের জননী। সর্বশেষ একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছে সে। সে অপুষ্টির শিকার হওয়ায় তার নবজাতকের অনেক কম ওজন হয়েছে। একই গ্রামের আরিফা (২১), বিলকিছ (২০), রোকসানা (১৭), মরিয়ম (১৮), নুরুন্নাহার (১৭), দুলালীসহ (২০) অনেকে গর্ভকালীন অপুষ্টির শিকার হওয়ায় অনেক কম ওজনের সন্তান জন্ম দিয়েছে তারা।
লালমনিরহাট সদর উপজেলার রাজপুর ইউনিয়নের নাজিরদহ গ্রামের ব্র্যাক স্বাস্থ্যকর্মী রেহেনা বেগম জানান, চলতি বছরের জানুয়ারিতে জন্ম নেয়া ১৪ শিশুর মধ্যে ২ জন, ফেব্রুয়ারিতে জন্ম নেয়া ৯ শিশুর মধ্যে ৩ জন, মার্চে জন্ম নেয়া ৯ শিশুর মধ্যে ১ জন শিশু কম ওজনে জন্মায়। এপ্রিলে ৪ ও মে মাসে ৭ শিশু জন্ম নেয়, এরা সবাই স্বাভাবিক ওজনের। জুন মাসে জন্ম নেয়া ৯ শিশুর মধ্যে ৫ জন, জুলাই মাসে ১৬ জনের মধ্যে ৬ শিশু কম ওজন নিয়ে জন্মায় এবং আগস্টে ১২ জন, সেপ্টেম্বরে ৯ জন জন্ম নেয়া শিশুরা ছিল স্বাভাবিক ওজনের আর নভেম্বরে জন্ম নেয়া ১৭ শিশুর মধ্যে ৮জনই কম ওজনে জন্মায়।
চিকিৎসক ও বেসরকারি সংস্থার পুষ্টি বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিস্তা নদীতে জেগে উঠা ছোট-বড় ৬৩টি চর রয়েছে। চরাঞ্চলের নাজুক যোগাযোগ, শিক্ষা-স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং প্রশাসনের উদাসীনতার কারণে এসব এলাকায় কাজি ও জন প্রতিনিধিদের সহায়তায় প্রতিনিয়ত হচ্ছে বাল্যবিয়ে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোনোর আগেই বসতে হচ্ছে বিয়ের পিঁড়িতে। বছর ঘুরতে না ঘুরতে গর্ভধারণ করে নিজের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে দরিদ্র পরিবারের কিশোরীরা।
জেলা মহিলা ও শিশুবিষয়ক কর্মকর্তা আসমা ইয়াসমীন জানান, বাল্যবিয়ে একটি সামাজিক ব্যধিতে পরিণত হয়েছে। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে অ্যাডভোকেসি সভা, সেমিনার, উঠান বৈঠকসহ ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে প্রতিরোধের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এ জেলায় বাল্যবিয়ের হার কত এ পরিসংখ্যান তার দফতরে নেই।
লালমনিরহাট সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. আজমল হক জানান, বাল্যবিয়ের শিকার মায়েরা নিজেরাই অপুষ্টি ও স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ভোগে। এ ছাড়া গর্ভকালীন ২ হাজার ৫শর উপরে ক্যালোরিযুক্ত খাবার খেতে না পারায় তারা কম ওজনের শিশু জন্ম দিচ্ছে। জন্ম নেয়া শিশুরা মায়ের বুকের দুধ ঠিকমতো না পাওয়ায় তারাও অপুষ্টির শিকার হয়ে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে।
ব্র্যাক স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সেবা কেন্দ্রের ম্যানেজার একরামুল হক জানান, তার জেলার ২১ ভাগ মা ওজনে কম শিশুর জন্ম দিচ্ছে। এর কারণ হিসেবে তিনি জানান, দরিদ্র এ এলাকার অধিকাংশ মা অপুষ্টির শিকার।
বিডি-প্রতিদিন/ ০৮ ডিসেম্বর ১৫/ সালাহ উদ্দীন