মহান ভাষা আন্দোলনে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার যে সকল ভাষা সৈনিক অংশ নিয়েছিলেন তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন এ্যাডভোকেট ওসমান গনি। কিন্তু প্রচারবিমুখ এই মানুষটির মূল্যায়ন জেলার মানুষ তেমনভাবে দেখাননি। তাতেও তার কোনো আক্ষেপ নেই। তিনি চান দেশের সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রচলন করা হোক। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ভাষাসৈনিক এ্যাডভোকেট ওসমান গনি অসুস্থ্য অবস্থায় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফজলুল হক হলের ছাত্র ছিলেন। ছাত্র কেন্দ্রিক রাজনীতির কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল সকল আন্দোলনের সুঁতিকাগার।
১৯৫০ সালে আব্দুল মতিন সাহেবকে আহবায়ক করে 'ভাষা সংগ্রাম' কমিটি গঠন হয়। এর অন্যতম সদস্য ছিলেন গনি সাহেব। সারা দেশব্যাপী আন্দোলন ছড়িয়ে দেয়ার জন্য নেতা ও সদস্যদের জেলা ভাগ করে দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়। আর ওসমান গণির দায়িত্বে পড়ে রাজশাহী ও বগুড়া জেলা। প্রথমে রাজশাহী সরকারী কলেজে এসে তিনি দেখেন, তার আসার আগেই সেখানে ছাত্ররা সংগ্রামকে উজ্জিবিত করতে বিভিন্ন কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে। তৎকালীন নবাবগঞ্জ মহকুমার শিবগঞ্জের আদিনা ফজলুল হক কলেজে এসে ছাত্রদের নিয়ে সভা করেন তিনি এবং আন্দোলন সম্পর্কে সচেতন ও প্রতিহত করার কথা বলেন। এতে ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে ব্যাপক সারা পান তিনি। কিন্তু শিক্ষক ও কলেজের কমিটির কিছু লোক বাংলা হিন্দুদের ভাষা, উর্দু মুসলমানদের ভাষা উল্লেখ করে এর বিরোধিতা করেন। পরে সেখান থেকে বগুড়ায় গিয়ে কলেজে সভা করেন তিনি। সেখানেও ব্যাপক সারা পান এবং ঢাকায় ফিরে গিয়ে কমিটিতে রিপোর্ট প্রদান করেন।
১৯৫২'র ফেব্রুয়ারি মাসের আগে প্রধানমন্ত্রী নাকিমুদ্দিন ঢাকায় এসে পল্টন ময়দানে সভায় পূর্ব বাংলার ভাষার দাবী প্রত্যাখান করে উর্দু হবে রাষ্ট্র ভাষা বলে ঘোষণা করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে ছাত্র-ছাত্রীরা এবং সংগ্রামে কমিটির ডাকে ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘট, ৮ ফেব্রুুুয়ারি ঢাকার সকল স্কুল কলেজে ধর্মঘট এবং ২১ শে ফেব্রুয়ারি সারা দেশেব্যাপী স্কুল কলেজে ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়। শুধু ছাত্র নয়, সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটিও গঠন করা হয়। তখন ক্ষুদ্ধ হয়ে তৎকালীন প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে। কেউ বলে আইন ভঙ্গ করতে হবে, কেউ বলে আইন ভঙ্গ করা যাবেন। এই নিয়ে ২টি পক্ষ হয়ে যায়।
তিনি আরও জানান, আমতলায় ছাত্রদের নিয়ে সভা হয়, সভায় ছাত্ররা আইন ভঙ্গ করার পক্ষে মত প্রকাশ করে। এর পর গুলিবর্ষণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবুল বরকতসহ অনেকেই গুলিবিদ্ধ হন। অনেক ঘটনা ঘটে, তা সবার জানা। ২১শের সংগ্রাম কমিটির নেতা ও সদস্যদের, হল কমিটির নেতাদের ধরপাকর ও হয়রানি করা হয়। এ সময় তিনি কালী মন্দিরে আত্মগোপনে থেকে রাজশাহীতে চলে আসেন। সেখানে ও পুলিশ তাকে ধরার চেষ্টা করলে তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জের দাদনচকের আদিনায় চলে আসেন। এমনিভাবে পরে নিজ বাড়ি নারায়নপুরে এবং শেষে গ্রেফতার এড়াতে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আত্মগোপন করেন। পরে সরকারের সাথে আপস হলে হুলিয়া উঠান হয় এবং উর্দুর সঙ্গে বাংলাও অন্যতম ভাষা হিসেবে সম্মত হয়। এর পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিনে যান তিনি এবং অধ্যায়নে মনযোগ দিয়ে ১৯৫২ সালে বিএ পাস, ১৯৫৪ তে এম এ পাস ও ১৯৫৬ সালে ল' পাস করেন। বর্তমানে তিনি আইন পেশায় রয়েছেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার এই ভাষা সৈনিকের জন্ম ১৯৩০ সালের ৩১ ডিসেম্বর সদর উপজেলার নারায়পুরে গ্রামে। তার পিতার নাম মরহুম আইউব আলী এবং মাতার নাম মরহুমা হাজেরা খাতুন। তার স্বপ্ন আইনের শাসন, শোষনহীন, দাবীমুক্ত, অসম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। মোট কথা, পূর্ণ সোনার বাংলা গড়ে উঠুক, দেশের সর্বত্র বাংলা ভাষার ব্যবহার গড়ে উঠুক।
বিডি-প্রতিদিন/১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬/শরীফ