কুড়িগ্রামের রৌমারী ও রাজীবপুর উপজেলায় ২০১৫-১৬ অর্থবছরের টিআর (গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ) এবং কাবিটা (কাজের বিনিময়ে টাকা) কর্মসূচির আওতায় ৬২৮টি প্রকল্পের অধীনে বরাদ্দ ছিল এক কোটি ৯৩ লাখ টাকা। প্রতিটি প্রকল্পেই সোলার প্যানেল সরবরাহের নিয়ম ছিল। এসব প্রকল্পে সোলার প্যানেল সরবরাহ করা হয় ৮০ লাখ টাকার। বাকি এক কোটি ১২ টাকা টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে।
কারণ, প্রকল্পের বরাদ্দ করা টাকায় যে সোলার প্যানেল স্থাপন করা হয়েছে সেই একই সোলার প্যানেল বাজারে কিনতে পাওয়া যায় বরাদ্দের তিন ভাগের এক ভাগ টাকায়। সরেজমিন অনুসন্ধান ও প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
জানা গেছে, বর্তমান সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে প্রত্যন্ত ও দুর্গম এলাকার ঘরে ঘরে সৌরবিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে টিআর ও কাবিটা প্রকল্পের টাকায় সোলার প্যানেল স্থাপনের নির্দেশ দেয়। নিয়ম অনুসারে টিআর ও কাবিটা প্রকল্পের সভাপতি বরাদ্দ করা টাকায় সোলার প্যানেল স্থাপন করবেন। সেটা যথানিয়মে বাস্তবায়ন হয়েছে কি না তা তদারকি করবেন উপজেলা প্রশাসন। কিন্তু ওই দুই উপজেলায় ঘটেছে এর উল্টো। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) প্রকল্পগুলোর কোনো তদারকি করেননি।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, রৌমারীতে ৩৯১ প্রকল্পের অধীনে এক কোটি ২৯ লাখ এবং রাজীবপুরে ২৩৭টি প্রকল্পে ৬৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এতে সর্বনিম্ন ১৮ হাজার ৪০০ টাকা থেকে ৫৮ হাজার ১০০ টাকা এবং কাবিটার সর্বোচ্চ ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত প্রকল্প রয়েছে। বসতবাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মসজিদে সোলার প্যানেল স্থাপনের জন্য ওই সব প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পের অধীনে সোলার প্যানেল সরবরাহ করেছে আরডিএ ও রহিম আফরোজ নামের দুটি সংস্থা।
অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্পের বরাদ্দ করা টাকার চেয়ে অনেক কম দামের সোলার প্যানেল স্থাপন করা হয়েছে। বরাদ্দ করা টাকার চেয়ে কম দামের সোলার দেওয়ার কারণে প্রথমে তা নিতে অস্বীকৃতি জানায় প্রকল্প সভাপতিরা। কিন্তু টাকা ফেরত যাবে এমন ভয় দেখিয়ে তা নিতে বাধ্য করা হয়। ইমান আলী নামের এক প্রকল্প সভাপতি অভিযোগ করেন, বরাদ্দ করা টাকা আমাদের দেবে আমরা সোলার কিনে স্থাপন করব। কিন্তু এখানে সই দিতে আমাদের বাধ্য করা হয়েছে। আমার প্রকল্পের বরাদ্দ হলো ১৮ হাজার ৪০০ টাকা, সেখানে তারা যে ৩০ ওয়াটের সোলার প্যানেলসহ ব্যাটারি স্থাপন করে দিয়েছে বাজারে তার দাম ছয় হাজার টাকা।
বাঘমারা গ্রামের মোহাম্মদ আলী নামের এক প্রকল্প সভাপতি অভিযোগ করেন, আমার নামে প্রকল্পে বরাদ্দ ৫০ হাজার টাকা। সেখানে তারা দিয়েছে ১৮ হাজার টাকা দামের সোলার প্যানেল।
রাজীবপুরের আব্দুর রশীদ সরদার নামের এক প্রকল্প সভাপতি বলেন, আমার ৮০ হাজার প্রকল্পে দেয়া হয়েছে ১৩০ ওয়াটের সোলার প্যানেল আর ১৩০ এমপিআর ব্যাটারি, যা বাজারে কিনতে পাওয়া যায় ২৭ হাজার টাকায়। সেখানে আমার নামের প্রকল্পের বরাদ্দের ৮০ হাজার টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদ জুনে শেষ হলেও কম দামের সোলার দেওয়ার কারণে কোনো সভাপতিই শুরুতে তা নেননি। পরে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে সবাইকে তা নিতে বাধ্য করে প্রশাসন। এভাবেই সবাইকে ঠকানো হয়েছে। আমরা এ দুর্নীতির তদন্ত দাবি করছি।
দাঁতভাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নুর মোহাম্মদ ডন অভিযোগ করেন, টিআর, কাবিখা প্রকল্পগুলোর মেয়াদ শেষ হওয়ার কারণে কাগজে-কলমে বাস্তবায়ন দেখিয়ে সব প্রকল্পের বরাদ্দ করা টাকা ইউএনওর ব্যাংক হিসাবে রাখা হয়, যা পরে আমাদের গছিয়ে দেওয়া হয়। এতে আরডিএ নামের সোলার প্যানেল কোম্পানি রাজীবপুরে আর রহিম আফরোজ নামের কোম্পানি রৌমারীতে ওই সোলার প্যানেল সরবরাহ করে।
রৌমারী ও রাজীবপুর দুই উপজেলার দায়িত্বে থাকা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এখানে আমার একার কিছুই করার নেই। মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দিয়ে ওই দুই সোলার কোম্পানির প্রতিনিধিকে পাঠিয়েছে সোলার সরবরাহের জন্য। সোলার প্যানেল স্থাপন করে প্রকল্পের বরাদ্দ করা টাকা তুলে নিয়েছে তারা। তবে বরাদ্দের টাকার বিপরীতে যেসব সোলার প্যানেল স্থাপন করা হয়েছে, বাজারে তার দাম অনেক কম। এমন অভিযোগ আমার কাছে করেছে প্রায় সব প্রকল্প সভাপতিই। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের কড়া নির্দেশ থাকায় আমি কিছু করতে পারছি না।
রৌমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন তালুকদার ও রাজীবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন মাহমুদ জানান, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশের বাইরে গিয়ে আমরা কোনো কিছু করতে পারি না। কারণ মন্ত্রণালয়ের দেয়া চিঠিতে কত টাকার প্রকল্পে কত ওয়াটের সোলার প্যানেল স্থাপন করতে হবে তা উল্লেখ রয়েছে।
আরডিএ সংস্থার রাজীবপুর উপজেলা ব্যবস্থাপক রবিউল আলম জাহাঙ্গীর এবং রহিম আফরোজ রৌমারী উপজেলা শাখার ব্যবস্থাপক আইয়ুব আলী জানান, কোম্পানি আমাদের যেভাবে নির্দেশ দিয়েছে সেভাবেই আমরা কাজ করেছি।
এ প্রসঙ্গে মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য রুহুল আমিন। তিনি বলেন, সোলার কম্পানি মন্ত্রণালয়ের সচিবদের ম্যানেজ করেই ওই বাণিজ্যে নেমেছে। কেননা বাজারে যে সোলার দাম ছয় হাজার টাকা, সেই একই সোলারের দাম নেওয়া হয়েছে ১৮ হাজার টাকা। এই বিষয়টি আমি বারবার ইউএনও ও পিআইওকে বলেছি। কিন্তু তারাও কোনো ব্যবস্থা নেননি।
বিডি প্রতিদিন/২৯ নভেম্বর, ২০১৬/ফারজানা