পরিবার পরিজন ছেড়ে দীর্ঘ ৫৭ বছর ধরে বাংলাদেশে জনসেবা দিয়ে যাওয়া ব্রিটিশ নাগরিক লুসি হেলেন ফ্রান্সিস হল্টের ভিসা ফি মওকুফ করেছে সরকার। একই সাথে আগামী ১৫ বছরের জন্য তাকে মাল্টিপল ভিসা দিয়েছে বাংলাদেশ। গত পহেলা ফেব্রুয়ারি স্বরাস্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব (বহিরাগমন-২) মনিরা হক স্বাক্ষরিত এক আদেশে এই তথ্য জানা গেছে। ফি মওকুফ করে ১৫ বছরের জন্য ভিসার মেয়াদ বাড়ানোয় সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন ব্রিটিশ নাগরিক লুসি হল্ট।
লুসি বলেন, প্রতি বছর ভিসা নবায়নের জন্য ৩৮ হাজার টাকা খরচ হতো তার। ওই অংক যোগান দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। বাংলাদেশ সরকার ফি মওকুফ সহ ১৫ বছরের জন্য মাল্টিপল ভিসা দেওয়ায় তিনি আনন্দিত। তার অনেক দিনের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। এখন দ্বৈত নাগরিকত্ব পেলে এই দেশে চিরস্থায়ীভাবে থেকে যেতে পারবেন তিনি।
৫৭ বছর আগে অক্সফোর্ড মিশনের একজন কর্মী হিসেবে বাংলাদেশে এসেছিলেন ব্রিটিশ নাগরিক লুসি হল্ট। সেবার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন মানুষের প্রতি। মুক্তিযুদ্ধের সময় জীবনের মায়া ত্যাগ করে যুদ্ধাহতদের সেবা করেছেন তিনি। দেশ স্বাধীনের পরও তিনি বাংলাদেশ ছেড়ে যাননি। ভালো বেসেছেন এখানকার মানুষকে। এখানকার মানুষের ভালোবাসা তাকে ভীষণ ভাবে আকৃষ্ট করেছে। তাই মৃত্যুর পরও বাংলাদেশের মাটিতে সমাধিস্থ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন লুসি।
প্রতি বছর ভিসা নবায়ন ফি দেওয়ার সামর্থ না থাকায় ফি মওকুফ ভিসা নবায়ন এবং বাংলাদেশী নাগরিকত্বের দাবি জানিয়েছিলেন লুসি। বরিশাল জেলা প্রশাসন থেকে গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে লুসির এই আবেদন পররাস্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। তবে এটা পররাস্ট্র মন্ত্রনালয়ের আওতাভূক্ত না হওয়ায় কোনো সাড়া মেলেনি।
সব শেষ গত ডিসেম্বরে জেলা প্রশাসন থেকে নতুন করে আবার লুসির আবেদন পাঠানো হয় স্বরাস্ট্র মন্ত্রণালয়ে। এর কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ফি মওকুফ সহ লুসি হল্টকে ১৫ বছরের জন্য অগ্রীম মাল্টিপল ভিসা দেয় সরকার।
বরিশালের জেলা প্রশাসক মো. হাবিবুর রহমান জানান, লুসি হল্টের আবেদনের প্রেক্ষিতে সরকার ফি মওকুফ সহ আগামী ১৫ বছরের জন্য তার ভিসা নবায়ন করেছে। নাগরিকত্বের আবেদনও সরকার বিবেচনা করছে বলে তিনি জানান।
১৯৩০ সালের ১৬ ডিসেম্বর যুক্তরাজ্যের সেন্ট হ্যালেন্সে জন্মগ্রহণ করা লুসির বাবার নাম জন হল্ট এবং মা ফ্রান্সিস হল্ট। ১৯৬০ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে আসেন লুসি। যোগ দেন বরিশাল অক্সফোর্ড মিশনে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় যশোরের ফাতেমা হাসপাতালে সেবা দিয়েছেন তিনি। ওই সময় ব্রিটেনে মায়ের কাছে চিঠি লিখে লুসি জানিয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানীরা স্বাধীন হতে চাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধে বাঙালীরা বঙ্গবন্ধুর মতো একজন যোগ্য নেতা পেয়েছেন। বাঙালীরা পশ্চিম পাকিস্তানের শোষন চায় না। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বপক্ষে জনমত গড়ে তোলেন লুসি। মায়ের মৃত্যুর পর চিঠিটি আবার লুসির কাছে ফেরত পাঠায় তার বোন।
লুসির মতে, বঙ্গবন্ধুর অনুপ্রেরনা ছিল তার সহধর্মীনি। তাই দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি উপহার পাঠিয়েছিলেন বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছাকে। এর জবাবে ১৯৭৩ সালের ২০ জানুয়ারী বঙ্গবন্ধুর ছোট কন্যা রেহানা শেখের নিজের তাহের লেখা একটি চিঠি পেয়েছিলেন লুসি।
মিশনের কর্মজীবন থেকে ২০০৪ সালে অবসরে যাওয়া লুসি এখন দুঃস্থ শিশুদের মানসিক বিকাশ ও ইংরেজী শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি শিশুদের জন্য তহবিল সংগ্রহ করছেন।
বিডি প্রতিদিন/এ মজুমদার