পার্বত্যাঞ্চলে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রতিটি ঘরে ঘরে গড়ে উঠা কোমর তাঁত শিল্প এখন হুমকির পথে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকের অভাব, বাজারজাত করণের অসুবিধা এবং সুতার দাম বেড়ে যাওয়ায পাহাড়িরা পূর্ব-পুরুষদের এই আদি এই পেশা ছাড়ছেন।
যুগের পর যুগ পাহাড়ি মেয়েরা কোমর তাঁতে কাপড় বুনে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়ে আসছে। বিগত সময়ে সরকার এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে তিন পার্বত্য জেলায় ১৬টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করে। কিন্ত সরকারি অনুদান বন্ধ হওয়ায় গত বছর থেকে এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোও বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়াও তিন পার্বত্য জেলার ৮টি কুটির শিল্প বিক্রয় কেন্দ্রও এক বছর ধরে বন্ধ। ফলে উপজাতীয় নারীরা তাদের উৎপাদিত এসব কাপড় বিক্রি করতে পারছে না।
অপর দিকে দিনের পর দিন বেড়েই চলছে সুতার দাম। বাড়ছে উৎপাদিত কাপড়ের মূল্য। এই খাতে সরকারেরও কোন বরাদ্দ নেই। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে কোমর তাঁত শিল্প একটি বড় ধরনের শিল্পে পরিণত হতে পারে। এ শিল্পটি পাল্টে দিতে পারে পাহাড়ি নারীদের জীবন চিত্রও।
পাহাড়িরা আদিকাল থেকেই তাদের নিজস্ব তৈরি কোমর তাঁতের কাপড় পরিধান করে আসছিল। কোমর তাঁতের কাপড় তৈরি করা পাহাড়ি মেয়েদের ঐতিহ্যগত শৈল্পিক কাজ। তিন পার্বত্য জেলায় বসবাসরত চাকমা, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, ত্রিপুরা, বম, খুমী, লুসাই, পাংখোয়া, চাক, খেয়াং এবং মুরুং উপজাতিরা তাদের নিজস্ব আলাদা বৈচিত্রময় পোষাক পরিধান করে আসছে। তাদের এ পোষাক দেখেই কোন গোত্রের উপজাতি তা সহজেই চিনতে পারা যায়। তবে পুরুষদের নিজস্ব জাতিসত্ত্বার আলাদা কোন পোষাক নেই, তাই পুরুষদের দেখে তার গোত্র চেনা মুসকিল।
কোমর তাঁতে তৈরিকৃত পোষাক পাহাড়ি রমনীদের ঐতিহ্যগত বৈচিত্র এনে দেয়। পার্বত্যাঞ্চলে পাহাড়িদের প্রতিটি ঘরে ঘরে কোমর তাঁতে বুনা কাপড় তৈরি হলেও প্রয়োজনীয় পুঁজি বিনিয়োগ, সরকারি পৃষ্ঠপোষাকতা, উন্নত প্রযুক্তির শিল্প সহায়তা, বাজারজাত ও উদ্যোক্তার অভাবসহ নানামুখী সমস্যার কারণে এ শিল্পটি প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারছে না।
অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন রকম ক্ষুদ্র শিল্প কারখানা স্থাপন হওয়ার কথা থাকলেও সঠিক পরিকল্পনা ও কার্যকর উদ্যোগের অভাবে সেটি হয়ে ওঠেনি। বান্দরবান পার্বত্য জেলায় বসবাসরত পাহাড়ি বাঙালি জনগোষ্ঠীর জীবনে বিদ্যমান স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীগুলো বিভিন্ন দেশ থেকে এই দেশে এসে যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসছে পার্বত্য প্রত্যন্ত অঞ্চলেগুলোতে। এ কারণে গড়ে উঠেছে তাদের স্বতন্ত্র জীবনধারা।
প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর জীবনধারা ও সংস্কৃতি ভিন্নতর। সাধারণত এই জীবন বৈচিত্র্যের সাথে সমতা রেখে গড়ে উঠেছে এখানকার ক্ষুদ্র ও কুটি শিল্প। বর্ণাঢ্য এসব শিল্প সামগ্রীর দেশে-বিদেশেও কদর বেড়েছে ব্যাপকহারে। কিন্তু এ শিল্পের উন্নয়নে সরকারি পরিকল্পনা এবং পর্যাপ্ত সহযোগিতা না থাকায় সাফল্যের মুখ দেখছে না। ফলে পাহাড়ি মেয়েদের বুনা এই কোমর তাঁত শিল্প বাজারজাত হচ্ছে না।
বান্দরবান জেলার পর্যটন স্পট শৈলপ্রপাতে উপজাতী বম মেয়েরা নিজ উদ্যোগে একটি অস্থায়ী বাজার গড়ে তুলেছে। জেলা কুটির শিল্প সংস্থার মতে বান্দরবানে ১০ হাজার পাহাড়ি মেয়ে কাপড় বুনছে। তারা তৈরি করছে থামি (পরণের কাপড়), গামছা, কম্বল, রুমাল, চাদরসহ বিভিন্ন রকমারী জামা কাপড়। এক্ষেত্রে উপজাতী বম ও ত্রিপুরারা অনেকটা এগিয়ে রয়েছে। বম ও ত্রিপুরা উপজাতিদের কোন মেয়েই ঘরে বসে নেই। প্রত্যেক পরিবারে মহিলা সদস্যরা কোমর তাঁতে কাপড় বুনে থাকে।
বম অধ্যুষিত ফারুক পাড়ার ভাননুম বম জানিয়েছেন, তার পরিবারের তিনি ও ২ কন্যাসহ তিন মহিলা সদস্যই তাঁতে কাপড় বুনেন। তারা উৎপাদিত এসব কাপড় পর্যটন স্পট শৈলপ্রপাতে নিয়ে বিক্রি করে। এ শিল্পের জন্য তারা সরকারি কিংবা বেসরকারি কোন সংস্থার সহযোগিতা পান না বলে তিনি জানান।
তার মতে, এই শিল্পে নারীদের আর্থিকভাবে সহযোগিতা করা হলে বান্দরবানে কোমর তাঁত শিল্প প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেতে পারে। তিনি এ কোমর তাঁতকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্প হিসেবে গড়ে তুলতে সরকারি উদ্যোগ কামনা করেছেন।
বিডি প্রতিদিন/২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮/হিমেল