জামালপুর জেলা কারাগারের জেলারসহ কারারক্ষীদের জিম্মি করে কারা ফটক ভেঙে বন্দিদের পালানোর চেষ্টায় ব্যাপক গোলাগুলি ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।
বৃহস্পতিবার (৮ আগস্ট) দুপুর ১টা থেকে জেলা কারাগারে এই বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে। বিদ্রোহের ঘটনায় ছয় কারাবন্দির মৃত্যু হয়েছে এবং আহত হয়েছেন জেলারসহ অন্তত ১৯ জন।
নিহতরা হলেন আরমান, রায়হান, শ্যামল, ফজলে রাব্বি বাবু, জসিম ও রাহাত। নিহত সবার বাড়ি জামালপুর সদর উপজেলায়।
জামালপুর জেলা কারাগার সূত্রে জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গ্রেফতারকৃতদের সরকার মুক্তি দেয়। এর সূত্র ধরে বৃহস্পতিবার দুপুর দেড়টার দিকে বন্দিদের মধ্যে ৩০ থেকে ৪০ জন বন্দি তাদের মুক্তির দাবিতে বিদ্রোহ শুরু করে। এতে বন্দিরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে মারামারি করে। এর মধ্যে বিদ্রোহী গ্রুপের বন্দিরা কারাগার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য জেলারের কাছে এসে কারা ফটকের চাবি চায়। এ সময় জেলার আবু ফাত্তাহ কয়েদিদের চাবি দিতে না চাইলে সাথে সাথে তার উপর হামলা করে তাকে জিম্মি করে কারাগারের ভেতরের ফটক ভেঙে বের হওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কারাক্ষীরা গুলি এবং টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। মুহুর্মুহু গুলির শব্দে পার্শ্ববর্তী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সহ শহরজুুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় দুই ঘণ্টা থেমে থেমে ব্যাপক গোলাগুলি হয়। গোলাগুলির এক পর্যায়ে কারাগারের অভ্যন্তরে জেলারের অফিস কক্ষ, বিভিন্ন ওয়ার্ড এবং কারা হাসপাতালে অগ্নিসংযোগ করে বন্দিরা। আগুনের ধোঁয়ায় পুরো কারাগার এলাকা ছেয়ে যায়।
এ সময় বিদ্রোহী বন্দিরা বাকী কারারক্ষীদের উপরও হামলা করে তাদের জিম্মি করে ফেলে। কারাগারে হট্টগোল এবং গুলির শব্দ পেয়ে কারাগারের ঠিক পাশেই অস্থায়ী ক্যাম্পে থাকা সেনাবাহিনী এগিয়ে এসে কারাগারের চারপাশ ঘিরে ফেলে। এ সময় কারাগারের ভেতর থেকে বন্দিরা ‘আমাদের বাঁচান’ বলে তাদের আর্তনাদের শব্দ পাওয়া যায়। পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে কারাগারের দেয়ালের উপর দিয়ে পানি ছিটিয়ে আগুন নেভানো চেষ্টা করে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা এ সময় মাইকিং করে কয়েদিদের শান্ত থাকা ও পালিয়ে না যাওয়ার জন্য আহ্বান জানায়।
এদিকে, বিদ্রোহী বন্দিদের হাতে দুই ঘণ্টা বন্দি থাকার পর বেশ কয়েকজন বন্দির সহযোগিতায় জেলার আবু ফাত্তাহ আহত অবস্থায় বন্দিদশা থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়। পরে সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশ এবং ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। বিকাল থেকে সন্ধ্যার পর কারাগারে বিদ্রোহী বন্দিদের কাছে জিম্মি থাকা ৩ নারীসহ ১৩ কারারক্ষীকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। এর মধ্যে রুকনুজ্জামান (৫০), সাদেক আলী (৪৫) ও জাহিদুল ইসলাম (৪১) নামে তিন কারারক্ষী বন্দিদের হামলায় গুরুতর আহত হয়েছেন এবং একজন গুলিবিদ্ধ থাকায় তাকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
জামালপুর কারাগারের জেলার আবু ফাত্তাহ জানান, কারাবন্দিদের মধ্যে যারা বিদ্রোহে অংশ নেয়নি তাদের জিম্মি করে ও নিজেদের মধ্যে মারামারির ঘটনায় পাঁচ বন্দি ঘটনাস্থলে নিহত হয় এবং হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও একজন বন্দির মৃত্যু হয়। বিদ্রোহের প্রায় ১০ ঘণ্টা পর মধ্য রাতে জামালপুর জেলা কারাগারের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে কর্তৃপক্ষ। বিদ্রোহের ঘটনায় জেলারসহ ১৩ কারারক্ষী ও পাঁচ জন বন্দি আহত হয়। আহতদের বেশ কয়েকজন কারারক্ষীকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয় এবং বাকীদের হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তবে আহতদের মধ্যে তিন কারারক্ষীর অবস্থা আশঙ্কাজনক। এর মধ্যে একজনকে ইতোমধ্যেই ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। এছাড়াও নিহতদের মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য জামালপুর জেনারেল হাসপাতাল মর্গে প্রেরণ করা হয়েছে। কারাগার ও মর্গের বাইরে বন্দিদের স্বজন এবং পরিবারের সদস্যরা উৎকণ্ঠা নিয়ে ভিড় জমিয়েছে।
জেলার আরও বলেন, ময়নাতদন্ত ছাড়া বন্দিদের মৃত্যু কারণ এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না এবং ময়নাতদন্ত ছাড়া পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তরও সম্ভব নয়। এই কারাগারে ৬৬৯ জন কারাবন্দি ছিল, তবে কোনো রাজনৈতিক বা জঙ্গী আসামি বন্দি নেই। বিদ্রোহের ঘটনায় কয়েদিদের কেউ পালাতে পারেনি।
বিডি-প্রতিদিন/বাজিত