কী রে ছড়া?
অমন মন খারাপ করে আছিস কেন?
করব না! বাবা যে আমাকে বলল, তার নাম ভুলে যেতে?
ও মা! কেন! কেন! তুই নিশ্চয় বাবাকে জ্বালিয়েছিস।
কিচ্ছু জ্বালাইনি। আমি শুধু বাবাকে বলেছি, তুমি বিদেশি ছড়াকে কেন ডেকে আনলে? তুমি বুঝি আমাকে পছন্দ কর না?
ও! তুই তাহলে আমার বিরুদ্ধে বাবাকে বলতে গেছিলি! তোর সাথে কাট্টি। বিদেশি ছড়া গিয়ে বসে রইল কোণের তাকে। ওদিক থেকে বাইরেটা খুব সুন্দর দেখা যায়। বিদেশি ছড়ার মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল। ইচ্ছে করছে ছড়ার বিরুদ্ধে বাবাকে নালিশ দিতে। কিন্তু বাবা ঘুমোচ্ছে। আর ঘুমানোর সময় বাবাকে ডাকা মানে এত্তগুলান বকা শোনা। তাই চুপচাপ বসে রইল। আর জানালা দিয়ে দেখছে মেঘের দেশ থেকে আসা ঝমঝম, রিমঝিম, ঝিরিঝিরি, বর্ষা, শ্রাবণ, আষাঢ়, বৃষ্টি, টাপুর, টুপুরদের মজার খেলা।
ওই দেখো! দেখো!
বিদেশি ছড়ার মন খারাপ! চলো ওর কাছে যাই।
সবাই এসে জড়ো হলো জানালার পাশে।
কি গো বিদেশি ছড়া? তোমার মুখ অমন গোমড়া কেন?
ছড়ার সাথে আড়ি দিয়েছি।
সে কী! কেন! জানো না, বাবা আড়ি দেওয়া পছন্দ করে না?
সে যে বলল, বাবা আমাকে কেন এখানে এনেছে? আমি কি তোমাদের সঙ্গে থাকতে পারি না?
কেন পারবে না? আচ্ছা, চলো। ছড়ার সঙ্গে কথা বলি।
সবাই চলল ছড়ার কাছে। ছোট্ট ছড়া টুকুস টুকুস করে লাফিয়ে লাফিয়ে গাইছে-
কোথায় তুই ছিলিস?
খাবো একটা ইলিশ
ইলিশ কোথায় পাব?
চাঁদপুরেতে যাব।
ছড়ার ছড়া শুনে বিদেশি ছড়া তো রেগেমেগে কান্না করার মতো অবস্থা। বলল, দেখছ! দেখছ! ও কেমন করে আমাকে ইলিশ বানিয়ে খাবে বলছে?
দূর বোকা! ও তো নিজে নিজে ছড়া কাটছে।
এমন সময় পাশের কামরা থেকে বেরিয়ে এলো ছড়ার রাজা আর ছড়ার রানী।
কী হয়েছে! এত গ-গোল কীসের এখানে? রাজা গম্ভীর মুখে বললেন।
রাজা আর রানীকে দেখে সবাই জড়োসড়ো। আষাঢ় ভয়ে ভয়ে বলল, ছড়া আর বিদেশি ছড়া ঝগড়া করেছে।
রাজা বললেন, এখানে আড়ি দেওয়া নিষেধ। এটা বুঝি জানা নেই ওদের?
রানী বললেন, আচ্ছা, সবাই থামো। আমি ওদের মধ্যে আবার ভাব করিয়ে দিচ্ছি। দেখি সবাই সুন্দর করে বসে পড়ো।
রানীর কথামতো সবাই বসার ঘরে গোল হয়ে বসে পড়ল। যদিও ছড়া ও বিদেশি ছড়া গাল ফুলিয়ে রেখেছে এখনো। কিন্তু রানীর কথা না শুনে তো উপায় নেই! তারাও বসল।
রানী ছড়াদের ঝগড়ার কথা কিছুই বললেন না। বৃষ্টির কাছে জানতে চাইলেন,
বাইরে খুব ঘোরাঘুরি করলে তোমরা। আমরা সবাই তোমাদের গল্প শুনবো।
খুশিতে বৃষ্টির দল হাততালি দিয়ে বলল,
আমরা সেই গল্প করার জন্যই আসছিলাম। জানালার কাছে এসে শুনলাম ঝগড়া হয়েছে।
আহ! বৃষ্টি! তোমাদের বলেছি বাইরের গল্প শোনাতে। রানী একটু বিরক্ত হয়ে বললেন।
আমরা না সিনথিয়াকে দেখেছি। ও ঘাসেদের কথা বুঝতে পারে! ঘাসেরা জিগ্যেস করল, বৃষ্টি কবে আসবে? সে বলল, পরশু!
বৃষ্টি মিটমিটিয়ে হাসছিল ওদের কথা শুনে। রাজা বললেন, বৃষ্টি, তোমার মুখে দুষ্টুমি দেখছি। সিনথিয়া ঘাসকে কথা দিয়েছে। তুমি কিন্তু পরশু সত্যি সত্যি যাবে।
আর কী কী দেখলে? রানী জানতে চাইলেন,
শ্রাবণ বলল, গাছে গাছে নতুন পাতাগুলো হাসছে। আর বসন্তের বাতাসের দোলনায় চড়ে ফুলগুলো কী মজা করে দুলছে!
রিমঝিম বলল, সেগুনগাছের মন খারাপ।
রাজা বললেন, কেন? কেন? ওদের সব পাতা যে ঝরে পড়ে গেছে! পলাশ গাছে, শিমুল গাছে রঙের মেলা। আমগাছে নতুন মুকুট। পাশের মেহগনি গাছেও কচি পাতার হাসি। তাই সেগুনের মন খারাপ।
আষাঢ় তুমি গিয়ে সেগুনের মন ভালো করে দিও। রানী বললেন।
বর্ষাই তো ওকে সবচেয়ে বেশি সুন্দর রাখে! বৃষ্টির মতো ফুল ফোটায় ওর ডালে। কী সুন্দর লাগে তখন সেগুনকে!
রিমঝিম বলল, ছোট্ট অমি ছাদে গিয়ে বৃষ্টিকে জিগ্যেস করছে, বৃষ্টি তোমার বাড়ি কই? তুমি আমাদের ছাদে বেড়াতে এসেছ? তুমি হঠাৎ হঠাৎ কেন আসো? তুমি কী খাও? রিমঝিমের কথা শুনে ঘরের সবার সে কী হাসি! ছড়া রাগ ভুলে গেল। বিদেশি ছড়া ভুলে গেল অভিমান। তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে গাইতে লাগল,
এক যে আছে হাসির দেশ
সবকিছুতে হাসি।
হাসছ কেন? বললে বলে,
হাসতে ভালোবাসি।
হাসছে সবাই। হাসির চোটে
কাঁপছে বাড়িঘর।
হাসির দেশে হাসতে হবে
কী বিরক্তিকর!
পাশের কামরা থেকে গম্ভীর শব্দ আসলো।
বসার ঘরে অমন হৈ চৈ করছে কে রে? চুপচুপ! রাজা সবাইকে থামিয়ে দিলেন। বাবার ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। চেঁচামেচি করলে সবাইকে যার যার তাকে গিয়ে ঘুমোতে হবে। আস্তে আস্তে বলো।
রাজার কথায় সবাই চুপ করল। রানী বললেন, আর কী কী দেখলে?
বৃষ্টি ফিসফিসিয়ে বলল,
নুহাশ পল্লীতে গিয়েছিলাম শুটিং দেখতে। বাবুর্চি রান্না করছিল ইলিশ ভাজা আর খিচুড়ি। যেই আমি রুমঝুম করে পাতায় পাতায়, পুকুরের জলে, ঘাসের বিছানায় নাচতে লাগলাম! হুমায়ূন আহমেদ শুটিং বাদ দিয়ে দলবল নিয়ে আমার সঙ্গে ভিজতে ভিজতে, নাচতে নাচতে গেলেন পুকুরপাড়ে। পুকুরের ওদিক থেকে একদল ব্যাঙ বেরিয়ে এলো। অবাক হয়ে তাদের নাচ দেখলো। এরপর ওরাও থপথপ লাফিয়ে নাচতে শুরু করল। কী মজাটাই না হলো!
ইস! তোমরা বাইরে গিয়ে কতই না আনন্দ করো! রানী মন খারাপ করে বললেন।
ওমা! রানী আপনি কী কথা বললেন! আমরা তো শুধু দুটো মাস আনন্দ করি। আপনি আর রাজা মশাই তো সারা বছর ঘুরে বেড়ান। কত দেশ ঘোরেন! পাখি হয়ে গান করেন। নদী হয়ে ভেসে বেড়ান। ঝরনা হয়ে নামেন। পাহাড় হয়ে আকাশের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। সাগরের ওপারের সূর্যকে ছুঁয়ে আসতে পারেন। কতে ঘুরে বেড়াতে পারেন!
আষাঢ়ের কথায় রানীর মন ভীষণ ভালো হয়ে গেলো। আষাঢ় সত্যি বলেছে।
আচ্ছা, আর কী দেখলে বলো এবার।
আষাঢ় গম্ভীর হয়ে বলল, বাবা কাঁদছিল। তার মার জন্য।
পুরো ঘরটা ভীষণ রকম নীরব হয়ে গেল আষাঢ়ের কথা শুনে। বাবা হাসিখুশি মানুষ। সারাক্ষণ বন্ধুবান্ধব নিয়ে হাসিঠাট্টা করেন। কখনো কাঁদতে দেখেনি কেউ। আষাঢ় বলল,
যখন বৃষ্টি ঝুমঝুম করে রাস্তায় পিছলিয়ে, ঘরের চালা বেয়ে, পুকুরে শব্দ তুলে খইয়ের মতো ফুটছিল, তখন বাবা ওদিকে তাকিয়ে কাঁদছিল। বাবা-মা বৃষ্টিকে পছন্দ করতেন। আষাঢ়ের কথায় সবার চোখ জল ছলছল। তখনই পাশের কামরা থেকে বাবা আসলেন। বললেন, কী হচ্ছে এখানে? এত গল্প! ঘুমাতে হবে না? যাও সবাই। যার যার তাকে গিয়ে ঘুমাও।
বাবার কথামতো সবাই যে যার জায়গায় ফিরে যাচ্ছিল।
এমন সময় ছড়া বলল, আচ্ছা বাবা কেন বললেন তার নাম ভুলে যেতে!
রানী ছোট্ট ছড়াকে আদর করে দিয়ে বললেন,
বাবার নাম কী ভোলা যায়? এমনিই বলেছেন।
এই রাজ্যে আমরা রাজা-রানী হলেও আমাদের রাজা হলেন বাবা। তুই কী সত্যি সত্যি বাবার নাম ভুলে যাবি ছড়া?
কক্ষনো না। ছড়া দুপাশে মাথা দুলিয়ে বলে।
তাহলে বাবার পুরো নামটা বল তো দেখি?
ছড়া মিষ্টি হেসে বলল,
আমীরুল ইসলাম। এবার চোখমুখে দুষ্টুমি ফুটিয়ে বলল,
আরও একটা নাম আছে।
কী নাম? রানীর মুখেও হাসি।
লাজুক হেসে ছড়া বলল, টুলু।