গাজীপুর মহানগরে টঙ্গীর খাঁ পাড়া সড়কে সিজন ড্রেসেস কারখানায় কাজ করতেন এক হাজার ২৬০ শ্রমিক-কর্মচারী। ২০২২ সালে প্রতিষ্ঠানটি থেকে তিন কোটি ৩৭ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি করা হয়। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের জেরে প্রতিষ্ঠানে প্রথম মন্দার ধাক্কা লাগে ২০২৩ সালে। ওই বছরের অক্টোবর থেকে পরের বছরের মার্চ পর্যন্ত কারখানায় তেমন কাজই ছিল না।
শ্রমিকদের ছাঁটাই না করে কর্তৃপক্ষ সাব-কন্ট্রাক্টে কিছু কাজ করে এটি চালু রাখে। তখন থেকেই প্রতিষ্ঠানে বিপর্যয় শুরু হয়। ২০২৪ সালের এপ্রিল থেকে অসংখ্য কার্যাদেশ আসতে থাকলেও অসহযোগিতা শুরু করে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। ৮ শতাংশের পরিবর্তে ঋণের কিস্তি দ্বিগুণ হারে কেটে নেওয়া শুরু করে ব্যাংকগুলো।
মালিকপক্ষের কোনো আবেদনেই সাড়া দেয়নি সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। এতে শ্রমিক মজুরি, গ্যাস-বিদ্যুত্ বিলসহ কারখানা পরিচালনার ব্যয় নির্বাহে তীব্র সংকটে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি। বকেয়া ও দেনা বাড়তে থাকলে কারখানায় শ্রমিক বিক্ষোভও দেখা দেয়। শ্রমিক অসন্তোষের কারণে ৪০ কোটি টাকার কার্যাদেশ বাতিল করে দেয় বিদেশি ক্রেতা।
বাধ্য হয়ে কারখানার কাপড় ও যন্ত্রাংশ বিক্রি করে শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ কারখানা কর্তৃপক্ষ। ৭০ কোটি টাকা বকেয়া ঋণের জন্য কারখানা কর্তৃপক্ষের নামে মামলা করে ব্যাংক। বাধ্য হয়ে গত জুলাইয়ে বন্ধ ঘোষণা করা হয় ‘সিজন ড্রেসেস’। তাতে কর্মহীন হয়ে পড়েন কারখানার শ্রমিক-কর্মচারীরা।
সিজন ড্রেসেস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাহাউদ্দিন চৌধুরী বাকের কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সফল ব্যবসায়ী ছিলাম।
ব্যাংক আগের নিয়মে টাকা নিলে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিত না। অর্ডার বাতিল হতো না। কারখানাও বন্ধ করতে হতো না। ঋণও বাড়ত না। শুধু ব্যাংকের অসহযোগিতায় তিলে তিলে গড়ে তোলা ২৮ বছরের পরিশ্রমের ফসল সিজন ড্রেসেস স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছি।’
কলকারখানা ও পরিদর্শন অধিদপ্তর এবং শিল্প পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, শুধু এই প্রতিষ্ঠান নয়, গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে গত ২৯ জুলাই পর্যন্ত গাজীপুরের ৭২টি কলকারখানা বন্ধ করে দিয়েছে নিজ নিজ কারখানা কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে ছয় মাসেই বন্ধ হয়েছে ২৯টি। বন্ধ কারখানাগুলোর মধ্যে রয়েছে বেক্সিমকোর ১৩টিসহ মাহমুদ জিন্স, ডার্ড কম্পোজিট, পলিকন লিমিটেড, টেক্সটিল ফ্যাশন, ক্লাসিক ফ্যাশন, লা-মুনি অ্যাপারেলসসহ বিজিএমইএভুক্ত বড় ২০ প্রতিষ্ঠানও। প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, কারখানা বন্ধ হওয়ায় জেলায় বেকার হয়েছেন প্রায় ৭৩ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী। তাঁদের অনেকে কাজ না পেয়ে পেশা পরিবর্তন করেছেন।
জানা গেছে, গত জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে বন্ধ হয়ে গেছে গাজীপুর মহানগরীর গাছার আরকেএম অ্যাপারেলস কারখানা। চাকরি হারিয়ে বেকার হন কারখানার ২৬০ শ্রমিক। কারখানার অপারেটর রংপুরের পীরগাছার শেফালী বেগমের (৪৮) গাছা সড়কের ভাড়া বাসায় গেলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঘরে স্বামী অসুস্থ। তিন সন্তানের সবাই লেখাপড়া করে। আমার আয়েই আগে সংসার চলত। এখন ঘরভাড়াসহ সংসার খরচ কোথা থেকে জোগাড় করব?’ তিনি জানান, কাজের জন্য ভোর থেকে এক কারখানা থেকে আরেক কারখানায় ছুটছেন। কোথাও লোক নিচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে বাসাবাড়ির ঝিয়ের কাজ খুঁজছেন।
বন্ধ হয়ে যাওয়া স্ট্যান্ডার্ড সিরামিকের ফোরম্যান সিরাজগঞ্জের চৌহালীর আসকর হোসেন বলেন, যে প্রতিষ্ঠান ছিল একসময় গর্বের, তা এখন এখন দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছয় মাস ঘুরে কোথাও চাকরি খুঁজে পাইনি। বাধ্য হয়ে সংসার চালাতে ভাড়ায় ইজি বাইক চালাচ্ছি। ইজি বাইকের জমার টাকা বাদ দিয়ে যা আয় হয় তাতেও সংসার চলছে না।
গত ফেব্রুয়ারিতে অর্থাভাবে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয় রপ্তানিমুখী বেক্সিমকো গ্রুপের ১৩টি পোশাক কারখানা। বেকার হন এসব কারখানার ২৮ হাজার ৫১৩ জন শ্রমিক। কারখানা খুলে দেওয়ার দাবিতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভও করেছেন শ্রমিকরা। গাজীপুর মহানগরের চক্রবর্তী এলাকায় ভাড়া থেকে ১৫ বছরের বেশি সময় বেক্সিমকোতে চাকরি করেছেন চুয়াডাঙ্গার মো. বিল্লাল হোসেন। তিনি বলেন, কারখানা চালু থাকায় সুখের সংসার ছিল। চাকরি হারিয়ে কষ্টে দিন পার করছি। ছয় মাস ধরে চেষ্টা করেও কোনো কারখানায় কাজ পাইনি। বাধ্য হয়ে গ্রামে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। চক্রবর্তী এলাকার বাসিন্দা ফয়েজ আহমেদ বলেন, এলাকার ৯০ শতাংশ স্থানীয় বাসিন্দার মূল আয় ছিল বাড়িভাড়া। বেক্সিমকোর ২৮ হাজার শ্রমিক এসব বাসাবাড়িতে ভাড়া থেকে চাকরি করতেন। শ্রমিকদের কারণে স্থানীয় হাটবাজার, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ সবই ছিল জমজমাট। এখন সবই স্থবির হয়ে পড়েছে। ব্যাংকঋণ নিয়ে তৈরি হাজার ঘরবাড়ি ফাঁকা পড়ে আছে। দোকান খুলে বসে থাকলেও ক্রেতা মিলছে না। অনেক শ্রমিক দোকান ও বাড়িভাড়া বাকি রেখেই চলে গেছেন গ্রামে।
জাতীয় গার্মেন্ট শ্রমিক জোট বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আশরাফুজ্জামান বলেন, চাকরি হারানো শ্রমিকদের খুব কমই অন্য কারখানায় চাকরি পেয়েছেন। প্রায় সব কারখানায় কার্যাদেশ কমে গেছে। নতুন নিয়োগ নেই বললেই চলে। তা ছাড়া প্রতিনিয়তই নতুন করে শ্রমিক ছাঁটাই করা হচ্ছে। বেকার পোশাক শ্রমিকরা চাকরি ছেড়ে অটোরিকশা চালনা, ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনাসহ বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হয়েছেন। নারী পোশাক শ্রমিকদের মধ্যেও অনেকে অন্যত্র গিয়ে পোশাক কারখানায় চাকরি নিয়েছেন। অনেকে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন। আবার অনেকে গাজীপুরে থেকে টেইলারিং, কাপড়ের দোকানসহ বিভিন্ন পেশার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। সব মিলিয়ে গাজীপুরে শ্রমিকপল্লীতে চলছে হাহাকার।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের গাজীপুর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গাজীপুরে ৪৩টি কারখানা বন্ধ হয় গত জানুয়ারিতে। বেক্সিমকোর ১৩টিসহ বাকি ২৯টি কারখানা বন্ধ করা হয়েছে গত ছয় মাসে। সব মিলিয়ে বেকার হয়েছেন ৭৩ হাজার ১০৩ জন শ্রমিক। বন্ধ কারখানাগুলোর বেশির ভাগই কাজ না থাকা, কার্যাদেশ বাতিল এবং আর্থিক সংকটে বন্ধ হয়েছে।
এই অধিদপ্তরের গাজীপুরের সহকারী মহাপরিদর্শক (সাধারণ) মো. রবিউল ইসলাম বাঁধন কালের কণ্ঠকে জানান, দেশের পোশাক কারখানাগুলো বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। অধিদপ্তর কারখানা বন্ধের সঠিক কারণ নির্ণয় ও কারখানা চালু করতে করণীয় বিষয়ে কাজ করছে।
গাজীপুর শিল্প পুলিশের পুলিশ সুপার আল মামুন শিকদার কালের কণ্ঠকে বলেন, মালিকানা পরিবর্তন, ব্যাংকঋণ রিশিডিউল না করা, কাজ না থাকা ইত্যাদি কারণে কারখানা বন্ধ হচ্ছে। তবে আর্থিক সংকটের কারণেই বন্ধ হচ্ছে বেশির ভাগ কারখানা।
সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল