মানুষের অন্যান্য রিপুর মধ্য হতে ক্রোধ একটি অন্যতম রিপু। যা আল্লাহতায়ালা মানুষকে দান করেছেন তাদের প্রয়োজনে উপযুক্ত স্থানে ব্যবহার করার জন্য। তিনি রাগকে অন্যায় বা অনুপযুক্ত স্থানে ব্যবহার না করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। মানুষের মতো অন্য প্রাণীদেরও রাগ করার ক্ষমতা দিয়েছেন। তারা প্রয়োজনে শুধু রাগ প্রকাশ করে, নিষ্প্রয়োজনে রাগ করা থেকে বিরত থাকে। যেমন— উপমা হিসেবে আমরা সাঁপকে দেখতে পাই। সে যদিও বাহ্যিকভাবে মানুষের ক্ষতিকারক প্রাণী; কিন্তু সে ওই সময় পর্যন্ত মানুষের ক্ষতির জন্য ক্রোধ প্রকাশ করে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে মানুষ থেকে বিপদের আশঙ্কা না করে। সে ক্রোধকে হজম করার চেষ্টা করে। অনন্যোপায় হয়ে এক সময় মানুষকে দংশন করে। যদিও এই ক্ষতিকারক প্রাণীটি মানুষের অনেক খেদমত করে। যেহেতু সব প্রাণীকে আল্লাহতায়ালা মানব জাতির খেদমতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। অনুরূপভাবে একটি উট, যার আছে বিশাল দেহ, এই বিশাল দেহবিশিষ্ট প্রাণীটিকে ছোট্ট একটি শিশু তার লাগাম ধরে অনেক দূর নিয়ে যায়, ক্ষণিকের জন্যও সে প্রতিবাদ করে না। উটটি চরম ধৈর্যের পরিচয় দেয়। কোনো ধরনের রাগ বা ক্রোধ প্রকাশ করে না। অথচ আল্লাহপাক এ বিশাল আকৃতির প্রাণীকেও রাগ করার ক্ষমতা দিয়েছেন। শিশুটি যদি না বুঝে কোনো বিপজ্জনক গর্তের দিকে নিয়ে যেতে চায়, তখন উটটি লাগামকে শিশুটির হাত থেকে হ্যাঁচকা টান মেরে নিয়ে নেয়। পরে আর কখনো এই শিশুর অনুসরণ করে না। এখানে উটটির জন্য এমন আচরণ করাই প্রয়োজন। সৃষ্টির সেরা মানুষকেও আল্লাহপাক ক্রোধ প্রকাশ করার ক্ষমতা দিয়েছেন। যা দ্বারা নিজেদের আত্মমর্যাদা রক্ষা করবে এবং নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করবে। কখনো অন্যের ক্ষতি করবে না বা ক্ষতি করার চেষ্টাও করবে না। যদি কখনো কোনো কারণে রাগের পরিমাণ বেড়ে যায়, সঙ্গে সঙ্গে বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে নেবে কিংবা বিনা অজুতে থাকলে অজু করে নিবে বা মাটির তৈরি মানুষ মাটির দিকে তাকাবে। এসব পন্থা অবলম্বন করার কারণে অনেক সময় রাগ শীতল হয়ে যায়। পবিত্র কোরআনে রাগকে হজম করার প্রতি তাগিদ প্রদান করা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, যারা সচ্ছলতায় ও অভাবের সময় ব্যয় করে, যারা নিজেদের রাগকে সংবরণ করে আর মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে, বস্তুত আল্লাহতায়ালা সৎ কর্মশীলদেরই ভালোবাসেন। (সূরা আলে-ইমরান : ১৩৪)। আল্লাহতায়ালা রাগের প্রবৃত্তিকে অগ্নি থেকে সৃষ্টি করে তা মানুষের মাঝে প্রবিষ্ট করে দিয়েছেন। যে আগুনের প্রভাব সুপ্ত অবস্থায় প্রতিটি মানুষের মাঝেই বিরাজমান। মানুষ এই অগ্নি মিশ্রিত রাগকে নিয়েই সমাজে বিচরণ করে। সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা করে। কিন্তু আল্লাহ প্রদত্ত এই রাগকে অনেক সময় মানুষ শয়তানের ধোঁকায় পড়ে সঠিকভাবে ব্যবহার বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। শয়তানের কুমন্ত্রণায় প্ররোচিত হয়ে মারামারি, হানাহানি ও ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হয়। পরিণামে তারা সারাজীবন দুঃখের অনলে জ্বলতে থাকে। বলতে থাকে হায় হায়! আমি একি করলাম। এমন না করলে কি ক্ষতি
হতো? ইত্যাদি প্রলাপ বকতে থাকে। কারণ রাগের শুরু হয় পাগলামি দিয়ে। পরিণামে হয় লজ্জা ও আক্ষেপ। এ রাগের কারণেই পৃথিবীতে বহু অঘটন ঘটেছে। বহু সুন্দর সৃষ্টি, শিল্পকর্ম ও সাজানো-গোছানো সংসার ধ্বংস হয়েছে। মানুষ যখন শয়তানের প্ররোচনায় প্রচণ্ডভাবে রাগান্বিত হয়, তখন তাদের সারা শরীর আগুনের মতো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। চেহারা লালরূপ ধারণ করে, যেন চেহারা থেকে অগ্নস্ফুুিলিঙ্গ ছিটকে পড়বে। পরিণামে যারা হার্টের রোগী তাদের হার্ট অ্যাটাক হয়। যাদের হাই প্রেসার আছে তাদের প্রেসার বেড়ে যায়। ফলে ক্ষতি যা হওয়ার তাই হয়। এ ছাড়াও রাগের কারণে আরও বহুবিধ ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। বিশেষ করে রাগ মানুষের সঠিক চিন্তা-চেতনাকে ভোঁতা করে দেয়। পবিত্র মাহে রমজানের রোজা, রাগ বা ক্রোধকে দমন করার ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। মানুষের অনিয়ন্ত্রিত জীবনকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। পবিত্র সিয়াম-সাধনা যেন রাগকে দমন করার মহৌষধ। মানুষ যখন লাগাতার দীর্ঘ একটি মাস আল্লাহপাকের হুকুম আদায় করার জন্য সিয়াম সাধনা পালন করে তখন কুদরতিভাবে মানুষের ভিতরে উত্তেজনার স্নায়ুকোষগুলো ধীরে ধীরে শীতল হতে থাকে। মানুষের মাঝে ভাবগাম্ভীর্যতা সৃষ্টি হয়। এখন মানুষটি আর আগের মতো রাগ করে না বা উত্তেজিত হয় না। সে সমাজে সভ্য-ভদ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। সিয়াম সাধনাই পারে একজন ব্যক্তিকে ধৈর্যশীল, সভ্য-ভদ্র বানাতে। তাই আদর্শবান মানুষ হতে হলে আমাদের অবশ্যই আল্লাহতায়ালার বিধানাবলী পালন করতে হবে। বিশেষ করে পবিত্র রমজানের হক আদায় করে ইবাদত বন্দেগিতে নিজেদের লিপ্ত রাখতে হবে। তাহলে ইনশা আল্লাহ আমরা সিয়াম সাধনার পূর্ণ বরকত পাব। আমার আজকের লেখাটি শেষ করব হজরত লুকমান হাকীম আ. তার ছেলেকে যে উপদেশ দিয়েছিলেন তা দিয়ে। তিনি ছেলেকে উপদেশ দিয়েছিলেন, এক. তুমি কারও উপকার করলে তা গোপন রাখবে। দুই. তোমার ওপর যদি কেউ জুলুম করে তা গোপন রাখবে, কারও কাছে প্রকাশ করবে না।
তিন. মৃত্যুকে কখনো ভুলবে না। চার. আল্লাহতায়ালাকে কখনো ভুলবে না। মৃত্যুর পর আল্লাহতায়ালার সঙ্গে সাক্ষাতের আশা রাখবে। পাঁচ. দিলকে সব সময় হেফাজত রাখবে। ছয়. পেটকে হারাম থেকে হেফাজত রাখবে । সাত. জবানের হেফাজত করবে। আট. চোখের হেফাজত করবে। (সূত্র : মাওয়ায়েজে আফরিকী, পৃষ্ঠা-৩৮)। আমরা যদি হজরতের এ আটটি উপদেশ মোতাবেক নিজেদের জীবন গড়ি, তাহলে আমরাও কাঙ্ক্ষিত সফলতা পাব ইনশা আল্লাহ। আমিন।লেখক : মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও খতিব, বারিধারা, ঢাকা।