বৃহস্পতিবার, ৯ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

ওয়াদা রক্ষার বিষয়ে কী বলেছে কোরআন

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

ওয়াদা রক্ষার বিষয়ে কী বলেছে কোরআন

আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘ওহে সব লোক যারা ইমান এনেছ! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস কর না। তবে পরস্পরের রাজি-খুশির মাধ্যমে ব্যবসা করাতে দোষ নেই।’ (সূরা নিসা : ২৯)। ব্যবসা একটি মহান পেশা। রিজিকের খোঁজে ব্যবসা করা বড় ইবাদতও বটে। অনেক নবীই ব্যবসার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। ব্যবসার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে লেনদেনের বিষয়টি। লেনদেন ছাড়া ব্যবসা তো কল্পনাও করা যায় না। ব্যক্তিজীবনেও লেনদেনের জালে বন্দী অধিকাংশ মানুষ। লেনদেন ওয়াদামাফিক হলে কোনো সমস্যা নেই। বিপত্তি তখনই বাধে, যখন কথামতো লেনদেন হয় না। সম্পর্কের অবনতি থেকে শুরু করে খুন-রাহাজানিসহ বড় ধরনের অঘটনও ঘটে যায় ওয়াদা রক্ষা না করার কারণে। তাই ব্যবসা এবং ব্যক্তিগত

লেনদেনের ক্ষেত্রে ওয়াদা রক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, সততা যেমন ব্যবসার মূলধন, তেমনি ওয়াদা রক্ষাও ইমানের মূলধন।  মুমিন চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ওয়াদা রক্ষা করা। ওয়াদা রক্ষা করা পবিত্র কোরআনের নির্দেশ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমার সঙ্গে করা ওয়াদা তোমরা পূর্ণ কর। আমিও তোমাদের সঙ্গে করা ওয়াদা পূর্ণ করব। আর আমাকেই ভয় কর।’ (সূরা বাকারা : ৪০)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আল্লাহ এবং পরস্পরের সঙ্গে করা ওয়াদা পূর্ণ কর। আর আল্লাহকে সাক্ষী রেখে কৃত ওয়াদা ভঙ্গ কর না।’ (সূরা নাহল : ৯১)। নবী-রসুলরা ছিলেন ওয়াদা রক্ষাকারী সত্যনিষ্ঠ মহামানব। হজরত ইসমাইল (আ.) সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘এ কিতাবে স্মরণ কর ইসমাইলের কথা। সে ছিল ওয়াদা রক্ষাকারী সত্যনিষ্ঠ নবী এবং রসুল।’ (সূরা মারয়াম : ৫৪)। আবদুল্লাহ ইবনে হাসমা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবুওয়তের আগে আমি রসুল (সা.) থেকে কিছু দ্রব্য ক্রয় করি এবং বলি আপনি এখানে দাঁড়ান আমি টাকা নিয়ে আসছি। বাড়িতে গিয়ে আমি রসুল (সা.)-এর কথা ভুলে গেলাম। তিন দিন পর মনে হওয়া মাত্রই ওই স্থানে গিয়ে দেখি হুজুর (সা.) দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি আমাকে দেখে শুধু বললেন, তুমি আমাকে খুব কষ্ট দিয়ে ফেললে। আমি তিন দিন পর্যন্ত তোমার জন্য এখানে অপেক্ষা করছি।’ (সুনানে আবু দাউদ : ৪৯৯৬)। পবিত্র কোরআনের অসংখ্য আয়াতে ওয়াদা রক্ষাকারীর প্রশংসা ও মর্যাদা বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘প্রকৃত মোত্তাকীরা যখন ওয়াদা করে, তখন তা রক্ষা করে।’ (সূরা বাকারা : ১৭৭)। ‘হ্যাঁ! কেউ যদি ওয়াদা রক্ষা করে এবং আল্লাহকে ভয় করে, তবে সে জেনে রাখুক, আল্লাহ এমন খোদাভিরুদের ভালোবাসেন।’ (সূরা আলে ইমরান : ৭৬)। ওয়াদা রক্ষা না করা কবিরা গুনাহ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘ওয়াদা রক্ষা না করার অপরাধে আমি বনি ইসরাইল সম্প্রদায়কে অভিশপ্ত জাতিতে পরিণত করেছি। আর তাদের অন্তরগুলোকে করে দিয়েছি কঠিন।’ (সূরা মায়েদা : ১৩।) ‘তিনি তাদের অন্তরে মুনাফিকি স্থায়ী করে দিলেন তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ার দিন পর্যন্ত। কারণ তারা আল্লাহর সঙ্গে কৃত ওয়াদা রক্ষা করেনি বরং মিথ্যাচার করেছে।’ (সূরা তাওবা : ৭৭)। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) বলেছেন, ‘মুনাফিকের চিহ্ন তিনটি। যখন কথা বলে মিথ্যা বলে, ওয়াদা করলে খেলাফ করে এবং আমানত রাখলে খেয়ানত করে।’ (বুখারি : ৩৩)। জীবন চলার পথে প্রতিনিয়ত আমরা একে অন্যকে যেসব প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি এসব প্রতিশ্রুতি এবং ওয়াদা রক্ষা করা একান্ত কর্তব্য। ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ব্যক্তিগত লেনদেনের ক্ষেত্রেও ওয়াদা রক্ষা অপরিহার্য। এ ব্যাপারে সামন্যতম শৈথিল্য প্রদর্শনও দুনিয়া-আখিরাতে বিপদের কারণ হতে পারে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা ওয়াদা রক্ষা কর। ওয়াদা রক্ষার ব্যাপারে তোমাদের প্রশ্ন করা হবে।’ (সূরা বনি ইসরাইল : ৩৩)। হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) বলেছেন, ‘ধ্বংস তার জন্য! ধ্বংস তার জন্য! ধ্বংস তার জন্য! যে ওয়াদা করল অতঃপর তা রক্ষা করল না।’ (মু’জামুল আওসাত : ৩৬৪৮, তারিখে দিমাশক : ৫৬১১৯)। তাই আসুন! আমরা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ওয়াদা রক্ষা করার চর্চা করি। কখনো যদি মনে হয়, এ কথাটি আমার রাখা সম্ভব হবে না তাহলে তার কাছ থেকে বিনয়ের সঙ্গে সময় নিয়ে বলবে, ভাই আমাকে আরও কিছু সময় দিন। ইনশাআল্লাহ আপনার পাওনা পরিশোধ করব বা কাজটি সম্পন্ন করব। এটি হলো মুসলমানের চরিত্র। আর মুনাফিকের চরিত্র হলো পালিয়ে বেড়ানো, মোবাইল বন্ধ রাখা, আরেকজনকে দিয়ে মোবাইল রিসিভ করানো। আফসোস মুসলমান সমাজে মুনাফেকি আচরণই বেশি হচ্ছে। হে আল্লাহ! আমাদের ক্ষমা করুন এবং ওয়াদা রক্ষাকারী হিসেবে কবুল করুন। আমিন।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসিসরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর