শনিবার, ৪ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

ভারতের নতুন নাগরিকত্ব আইন

মেজর মো. আখতারুজ্জামান (অব.)

ভারতের নতুন নাগরিকত্ব আইন

বাংলাদেশের নাগরিক যারা মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের নাগরিকত্ব অর্জন করেছে, তারা কিন্তু সবাই একসময় অখ- ভারতবর্ষের নাগরিক ছিল। তাই বলা যায়, ভারত সব বাংলাদেশির পিতৃভূমি। সময়ের প্রয়োজনে এবং নিজেদের আলাদা বৈশিষ্ট্য ও নতুন জাতীয়তাবাদের উন্মেষে ঐতিহাসিক এক পটভূমিকায় ভারত থেকে আলাদা হয়ে ক্রম বিবর্তনে নতুন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু বৃহত্তর আঙ্গিকে এ উপমহাদেশের সবাই অবশ্যই ভারতীয়। ভারতের উৎপত্তি বা এর আদি যদি খোঁজা হয় তাহলে দেখতে পাওয়া যাবে- ১. (ইন্ডিয়া) India : এটি ভারতের ইংরেজি নাম, Herodotus (খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতক)-এর সময় থেকে গ্রিক শব্দ India থেকে উদ্ভূত হয়ে ল্যাটিন, পার্সিয়ান ভাষার মধ্য দিয়ে বিকাশ লাভ করেছে। India বলতে Indus river (সংস্কৃত, সিন্ধু নদ)-এর তীরবর্তী এবং পেছনের এলাকা নির্দেশ করা হতো। অ্যাংলো-সেকসনদের কাছে India শব্দটি পরিচিত ছিল এবং রাজা আলফ্রেডের Orosius অনুবাদে শব্দটি পাওয়া যায়। Middle English-এ ফরাসি প্রভাবে শব্দটি Ynde বা Inde-তে পরিণত হয়, যা Early Modern English-এ Indie- হিসেবে প্রবেশ করে। বর্তমান ওহফরধ নামটি ১৭ শতক থেকে প্রচলিত।

২. ভারত : এ নামটি বিভিন্ন প্রাচীন সংস্কৃত পুরাণ থেকে এসেছে। যেমন, বায়ুপুরাণে নামটি পাওয়া যায়। ভারত মূলত দেবতা ‘অগ্নি’র একটি নাম। ঋগে¦দে ভারতী হিসেবে এখানকার অধিবাসীদের বিশেষ করে যারা দশ-রাজার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল বোঝানো হয়েছে। মহাভারতে ভরতের রাজ্যকে বলা হয় ভারতবর্ষ। ভগবত-পুরাণে ভারত শব্দটি জাত ভারতের নাম থেকে এসেছে বলে বর্ণিত। ইংরেজিতে ইন্ডিয়া (India) কথাটি সিন্ধু নদের আদি ফারসি নাম হিন্দু থেকে। প্রাচীন গ্রিকরা ভারতীয়দের বলত ইন্দোই বা ‘ইন্দাস’ (সিন্ধু) নদী অববাহিকার অধিবাসী। ‘ইন্দাস’ নাম থেকেই ‘ইন্ডিয়া’ নামটির উৎপত্তি। সিন্ধু/হিন্দু নদের অববাহিকায় যারা বাস করত তাদের হিন্দু বলা হতো। হিন্দু বলতে কোনো ধর্মের অনুসারী বোঝাত না। অর্থাৎ সমস্ত ভারতে বসবাসকারীদের হিন্দু বলা হতো। সেদিক দিয়ে দেখলে ভারতে বসবাসকারী মুসলিমও একজন হিন্দু যেমন ইংল্যান্ডে বসবাসকারীকে ব্রিটিশ বলা হয়। সূত্র : উইকিপিডিয়া।

পুরনো লিপি থেকে জানা যায়, ভারতবর্ষ নামটির পরিচিতির আগে ভারত জম্বুদ্বীপ নামেই পরিচিত ছিল। সূর্যসিদ্ধান্তের লেখায় পাওয়া জম্বুদ্বীপ। আক্ষরিক অর্থ ধরলে এর মানে হলো জামগাছে ভরা দ্বীপ কিন্তু সনাতন সৃষ্টিতত্ত্ব (মানে হিন্দু বৌদ্ধ কিংবা জৈন) অনুযায়ী জম্বুদ্বীপ মানে হলো ‘সাধারণ মানুষের বাসস্থান’। দার্শনিকভাবে এটা ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ নাম হতে পারত। পুরাণ অনুযায়ী এ জায়গা নয়টি পর্বত ও আটটি বর্ষ নিয়ে তৈরি। বৌদ্ধলিপি মহাবংশ অনুযায়ী অশোকপুত্র মাহিন্দা (পরে যার নাম হয় মহেন্দ্র) অনুরাধাপুরের (সিংহল) অধিপতি দেবনমপিয় তিস্যের কাছে নিজেকে জম্বুদ্বীপ থেকে আসছেন বলেই জানিয়েছিলেন। আর অশোকের সাম্রাজ্যের বিস্তারে উত্তর-পূর্ব আর তামিলনাড়ু ছাড়া মোটামুটি পুরো দেশটাই ঢুকে যায়। এ ছাড়া উত্তরপ্রদেশের হস্তীনাপুরে জৈন তীর্থ জম্বুদ্বীপের স্থাপত্যশৈলীতেও জম্বুদ্বীপের মোটামুটি একটা গাঠনিক ধারণা মেলে।

অখ- ভারত অর্থাৎ মিয়ানমার, বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, নেপাল, তিব্বত, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানকে ভারতবর্ষ বলা হয়। ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই ভারতবর্ষ বিভিন্ন সময়ে বিভক্ত ছিল। আবার বিভিন্ন চৌকস শাসকের দক্ষতায় ঐক্যবদ্ধও ছিল। সম্রাট অশোক উত্তর-পূর্ব ভারত ও তামিলনাড়– ছাড়া ভারতকে প্রথমে ঐক্যবদ্ধ করেন। ভারতবর্ষ সর্বশেষ বিভক্ত হয় ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে। ইংরেজদের ষড়যন্ত্রে এবং কায়েমি স্বার্থে ধর্মের জিকির তুলে মুসলমানদের আলাদা রাষ্ট্রের দাবিতে ভারতবর্ষকে বিভক্ত করা হয়। কিন্তু তার পরও বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠী ভারতেই থেকে যায় তাদেরই আদিনিবাসে অর্থাৎ সাবেক ভারতবর্ষে। আজকে ভারতবর্ষের তথা অখ- ভারতের অস্তিত্ব নেই এবং ভারতবর্ষ বিভিন্ন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে কিন্তু ভারত তার আদি অবস্থানটি ধরে রেখেই নিজেদের একচ্ছত্র ভারতীয় পরিচয়ে আখ্যায়িত করছে। যার পরিষ্কার মানে হলো ভারত ভারতবর্ষের আদিবাসীদের দেশ বলে স্বীকার করে নিয়ে সেখানে ভারতবর্ষের মানুষদের নিরাপদ আবাসভূমির গ্যারান্টি দিয়ে ভারতের সংবিধানে স্বীকৃতি দিয়েছে যেখান থেকে ভারত সরে আসতে পারে না।

এটি ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে, বিগত এক হাজার বছরেরও বেশি সময় ভারতবর্ষ শাসিত হয়েছে মুসলমান শাসকদের দ্বারা কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এও সত্য যে, মুসলমান শাসকের অনেকেই ভারতের সন্তান ছিলেন না। তারাও ইংরেজ বেনিয়াদের মতো বিদেশি ছিলেন কিন্তু পার্থক্য ছিল এই যে, অনেক মুসলমান শাসক ভারতে স্থায়ীভাবে থেকে যান। ভারতের মুসলমান শাসক বিদেশি হলেও ভারতের মুসলমান জনগোষ্ঠীর ৯৯% ভাগ ভারতবর্ষের মাটির আদি সন্তান। বিশেষ করে বাংলাদেশের ১০০ ভাগ নাগরিকই এ দেশের মাটির আদি সন্তান। বাংলাদেশের সব নাগরিক বৃহৎ জাতিগোষ্ঠী হিসেবে যদিও ভারতীয় ছিল কিন্তু তাদের আলাদা ঐতিহাসিক পরিচয় ছিল ধর্মবর্ণনির্বিশেষে সবাই বাঙালি। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হওয়ার পরে রাষ্ট্রীয় পরিচয়ে বাংলাদেশি হিসেবে নতুন পরিচিতি লাভ করে। কিন্তু বৃহত্তর পরিবেশে ও আঙ্গিকে কিন্তু তারা ভারতীয় রয়েই যায়। যেমন গোপালগঞ্জ আলাদা জেলা হওয়ার পরও বৃহত্তর ফরিদপুরবাসী বলতে কুণ্ঠাবোধ করে না তেমনি আন্তর্জাতিক পরিম-লে ভারতীয় পরিচয়টিও খুবই সংগত কারণে দাবি করা যায় যদিও তাতে অনেকের আপত্তিও থাকে। কিন্তু বাস্তবতা প্রকৃতপক্ষে ভিন্ন। আজকে বাংলাদেশের সব নাগরিক ১০০ ভাগ বাংলাদেশি এবং সেই সঙ্গে বাঙালিও। উপমহাদেশের ঐতিহ্য এবং ভারতে বিপুলসংখ্যক বাংলা ভাষীর অবস্থান থাকায় মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অনেকে ভারতের সঙ্গে অধিকতর নিকটতম সম্পর্ক তৈরি করতে অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। অনেক মানুষ বাংলাদেশি বা বাঙালি পরিচয়ে ভারতে যেতে, থাকতে, যোগাযোগ রাখতে এবং এমনকি বসবাস করতে অনেক বেশি পছন্দ করেন। বৈধ বা অবৈধ যেভাবেই তারা ভারতে বসবাস করুন না কেন ভারত বাঙালি তথা বাংলাদেশিদের সে যে ধর্মেরই হোক না কেন কখনোই নৈতিক কারণে বিতাড়িত করতে পারে না এবং পারবেও না। বাঙালিদের আদিভূমি ভারত, সেই ভারত থেকে যারাই আলাদা হোন না কেন বা অন্য কোনো রাষ্ট্রের নাগরিক হোন না কেন তাদের ভারতীয় নাগরিক অধিকার কখনই ভারত সরকার অস্বীকার করতে পারবে না। ভারতের কোটির চেয়ে বেশি নাগরিক বিশ্বের বিভিন্ন দেশেরও নাগরিক। তাহলে ভারত তাদের ভারতের নাগরিক হিসেবে অস্বীকার করলে ওইসব দ্বৈত নাগরিক কখনই মেনে নেবেন না। তাই স্পষ্টভাবে বলা যায়, ভারতের হিন্দু বৌদ্ধ, মুসলমান, খ্রিস্টান বা অন্য যে কোনো ধর্মাবলম্বী হোন না কেন, তারা সবাই ভারতীয়। বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ ভারত থেকে আগত। বাংলাদেশ তাদের নতুন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্র আলাদাভাবে বাংলাদেশিদের থাকার অধিকার নিশ্চিত করেছে। এ দেশ থেকে যেমন কেউ বা কোনো শক্তি তার কোনো নাগরিককে জোর করে বের করে দিতে পারবে না; তেমনি কোনো ভারতীয়, চাইনিজ, বার্মিজ, আমেরিকান, ইউরোপিয়ান বা আরবীয়কে কোনো শক্তি বাংলাদেশে জোর করে ঢোকাতে পারবে না।

বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্রের সংবিধান, আইনকানুন, বিধিবিধান ও নিয়মকানুন মেনে পৃথিবীর যে কোনো দেশের নাগরিক যেমন বাংলাদেশে সইচ্ছায় আসতে পারেন, থাকতে পারেন, কাজ করতে পারেন এবং এমনকি নাগরিকত্ব নিতে পারেন। কিন্তু কোনো দেশের সরকার বা কোনো শক্তি জোর করে বাংলাদেশে কোনো মানুষকে প্রবেশ করাতে পারে না। তা বাংলাদেশের জনগণ কখনোই মেনে নেব না এবং কোনো মূল্যেই মেনে নিতে পারে না।

ভারত যেহেতু ভারতবর্ষের আদি অবস্থান ধরে রাখতে ভারত নামে সংবিধানস্বীকৃত একটি দেশ তাই তারা তাদের দেশ থেকে ভারতবর্ষের একজন মানুষকেও, হোক মুসলমান বা হিন্দু বা খ্রিস্টান বা অন্য যে কোনো ধর্মের, বিশ্বাসের বা আদর্শের, কোনো অবস্থাতেই বের করে দিতে পারে না। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের, হোক মুসলমান বা হিন্দু বা অন্য কোনো ধর্মের কিন্তু ভারতবর্ষের আদি নাগরিক হিসেবে তাদের মৌলিক অধিকার রয়েছে ভারতে বসবাস করার এবং ভারতের নাগরিকত্বলাভের। তাই বাংলাদেশের আপামর জনগণ ভারত সরকারের এনআরসি ও এনএএ আইনের তীব্র প্রতিবাদ ও বিরোধিতা করে। এ আইনের ধুয়ো তুলে ভারত যদি একজন বাঙালিকেও, হোক হিন্দু বা মুসলমান, তাকে বাংলাদেশের ভিতরে ঢোকানোর চেষ্টা করে তবে তা হবে অন্যায়। এ অন্যায় প্রতিরোধে প্রয়োজনে বাংলাদেশের জনগণ সীমান্ত পাহারা দেবে- এ অবস্থান থেকে একচুলও নড়া যাবে না।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য।

সর্বশেষ খবর