হাজার বছরের ঐতিহ্যে গড়া একটি শান্তিপ্রিয় জাতির আবাসভূমি বাংলাদেশ। এই দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও রাজনীতি সবই বিভিন্ন ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর সহাবস্থানের দৃষ্টান্ত। দীর্ঘকাল থেকে বাংলাদেশ ধর্ম-বর্ণ-গোত্রনির্বিশেষে সমান অধিকার, সহনশীলতা ও মানবিক মূল্যবোধের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে আসছে। বর্তমান বাংলাদেশে একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী জনগণের মধ্যে হিংসাত্মক কার্যকলাপ ও ভয়ংকর আচরণ চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের এই হিংসাত্মক আচরণকে এক কথায় ‘মব সন্ত্রাস’ বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। আজকাল বিভিন্ন স্থানে একটি বিশৃঙ্খল গোষ্ঠী জনতার আবেগ ও উত্তেজনাকে ব্যবহার করে সন্ত্রাসী আক্রমণে লিপ্ত হয়। অনেক সময় সামাজিক মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে অপ্রত্যাশিত ও বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করে। মুহূর্তেই জনতাকে উত্তেজিত করে সৃষ্টি করে ভয়ানক তাণ্ডব। তারা আইন নিজ হাতে তুলে নেয়। এসব ক্ষেত্রে বিচারবহির্ভূতভাবে বহু নিরীহ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। সম্পদ লুট হচ্ছে। মানসম্মান ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। অবৈধ ও পরিকল্পিত সমাবেশের কারণে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে। আইন ও বিচারব্যবস্থার প্রতি বাড়ছে অবজ্ঞা। ইসলাম এসব অপকর্মকে অবৈধ ও শান্তি-শৃঙ্খলার অন্তরায় হিসেবে ঘোষণা করেছে।
গুজব ছড়ানো : ইসলাম শান্তিপ্রিয় ধর্ম। সত্য, ন্যায় ও সুসংবাদ প্রচারে উৎসাহিত করে। গুজব ছড়ানো বা ভিত্তিহীন খবর রটানো কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। গুজব সমাজে বিশৃঙ্খলা, দ্বন্দ্ব ও ঘৃণার বিস্তার ঘটায়। যা ইসলামি মূল্যবোধের পরিপন্থি। পবিত্র কোরআনের বাণী, ‘হে মুমিনগণ! যদি কোনো পাপাচারী ব্যক্তি তোমাদের কাছে সংবাদ পরিবেশন করে, তাহলে তোমরা তা যাচাই করে নাও, যেন অজ্ঞতার বশে তোমরা কোনো সম্প্রদায়কে আঘাত না কর। তারপর নিজেদের কৃতকর্মের জন্য তোমাদের অনুতপ্ত হতে না হয়।’ (সুরা আল হুজরাত-৬)
আরেক আয়াতের ঘোষণা, ‘যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে, তাদের জন্য ইহ ও পরকালে রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি।’ (সুরা নূর-১৯)
রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘একজন ব্যক্তি মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য তা যথেষ্ট, সে যা কিছু শোনে তা-ই বলে বেড়ায়।’ (সহিহ মুসলিম)। গুজব ছড়ানো অবশ্যই সামাজিক ও ধর্মীয় অপরাধ। এই জঘন্য অপরাধ থেকে সবার বিরত থাকা উচিত। সঙ্গে গুজব ছড়ানোর সুযোগ হয় এমন সন্দেহজনক কথা, কাজ ও পরিস্থিতি এড়িয়ে চলাও ইসলামের নির্দেশনা। কথিত আছে, ‘সন্দেহের স্থানসমূহ থেকে দূরে থাক।’ রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি সন্দেহযুক্ত বিষয় থেকে দূরে থাকে, সে তার দীন ও সম্মানকে রক্ষা করে।’ (সহিহ বুখারি)
আরও অগণিত হাদিস প্রমাণ করে, মব সন্ত্রাস জঘন্য অপরাধ। মব সন্ত্রাসের ক্ষেত্র তৈরি করা এবং পরিস্থিতি সৃষ্টি করাও মারাত্মক অপরাধ। উভয় ধরনের অপরাধ নির্মূল হওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন সব অপরাধের যথাযথ বিচার হওয়া। আইন ও বিচার নিজ হাতে তুলে নেওয়া : মব সন্ত্রাস বা মব জাস্টিসের ভয়ংকর একটি রূপ হলো, তারা কোনো অন্যায়কারীকে নিজেদের শক্তি ও ক্ষমতা প্রয়োগ করে বিচারের পরিস্থিতি তৈরি করে। নিজেরাই গণপিটুনি, মারধর, লাঞ্ছনা, মাল-সম্পদ লুণ্ঠন ইত্যাদি অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। বিচারের নামে তারা চালাতে থাকে অমানবিক অবিচার। কোরআন-হাদিসের আলোকে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ও গুরুতর অপরাধ। মাল-সম্পদ লুট করা মহাপাপ। বিচার ও শাস্তি কার্যকর করার ক্ষমতা কেবল রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ এবং নির্দিষ্ট বিচারিক সংস্থার হাতেই ন্যস্ত। ইসলাম ধর্মে ভুক্তভোগীর জন্য প্রতিশোধ নেওয়ার অধিকার আছে। তবে তা রাষ্ট্রীয় বিচারব্যবস্থার অধীনে হতে হবে। এ ক্ষেত্রে ধৈর্যধারণের নির্দেশনাও রয়েছে। ইসলামি শরিয়তে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার বিধান আছে। অন্যায়ের প্রতিবাদ এবং বিচার এক বিষয় নয়। বিচার হলো, অন্যায়ের যথাযথ শাস্তি বিচারিক প্রক্রিয়ায় প্রয়োগ করা। আর অন্যায়ের প্রতিবাদের জন্য ইসলাম সাধ্যানুসারে তিনটি স্তর বর্ণনা করেছে। সাধ্য হলে বাহুবল দিয়ে প্রতিহত করবে, অন্যথায় মুখে বলবে, তা সম্ভব না হলে অন্তরে ঘৃণা করবে এবং শক্তি অর্জনের পরিকল্পনা করবে।’ (সহিহ মুসলিম)
অন্যায়ের প্রতিবাদের ক্ষেত্রে তিনটি স্তর নির্ধারণে মূলত কিছু কৌশল রয়েছে। বিশেষভাবে ফিতনা সৃষ্টি না করা একটি বিশেষ লক্ষ্য। মহান প্রভু ঘোষণা করেন, ‘আর ফিতনা হত্যার চেয়ে আরও গুরুতর।’ (সুরা আল-বাকারাহ-১৯১) অন্যায়ের প্রতিবাদ অন্যায়ভাবে নয়, বরং ন্যায়সংহতভাবে ও ন্যায়বিচারের মাধ্যমে হতে হবে। মব সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা প্রধান কাজ। আইন নিজ হাতে তুলে নেওয়া যেমন অপরাধ, ন্যায়বিচার পরিহার করা, মনগড়া রায় বানানো এবং স্বৈরাচারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা আরও বড় অন্যায় ও ধ্বংসাত্মক অপকর্ম। ন্যায়বিচার না থাকলে সমাজে বিশৃঙ্খলা ও শোষণ, নিপীড়ন বৃদ্ধি পায়। বিচারব্যবস্থার প্রতি জনগণ আস্থা হারায়। একপর্যায়ে তারা নিজ হাতে আইন তুলে নেয়।
লেখক : গবেষক, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বসুন্ধরা, ঢাকা