‘বেশনো আয নে চুন হেকায়েত মিকুনাদ আয জোদায়িহা শেকায়েত মিকুনাদ।’
অর্থ : শোনো! বাঁশি কী বলছে?
বাঁশি বিচ্ছেদের অভিযোগ করছে।
জগদ্বিখ্যাত সুফি কবি মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি তাঁর আধ্যাত্মিক গ্রন্থ মসনবিয়ে মানভি শুরু করেছেন এ দুটি চরণ দিয়ে। মসনবি শব্দটি আরবি মাসনা থেকে এসেছে। মাসনা মানে দুই। আর মসনবি মানে হলো দ্বিপদি বা দুই চরণবিশিষ্ট কবিতা। মানাভি শব্দটি এসেছে আরবি মানা থেকে। মানা মানে অন্তর্নিহিত তাৎপর্য। মানাভি মানে হলো গভীর অর্থপূর্ণ বা আধ্যাত্মিক। মসনবিয়ে মানাভি অর্থ দাঁড়ায় দ্বিপদি আধ্যাত্মিক শ্লোক বা দুই চরণবিশিষ্ট গভীর অর্থপূর্ণ কাব্য।
বেশনো- শোনো। এ কোনো সাধারণ শোনা নয়। মাথার পেছনের দুই কান দিয়ে শোনাকে ফারসিতে বলা হয় শেনিদান। আর মনের কান দিয়ে শোনাকে বলা হয় গুশ দাদান। এ দুই শোনার বাইরে তৃতীয় এক ধরনের শোনা আছে। বেশনো- মানে হলো হৃদয় দিয়ে শোনা। মনপ্রাণ উজাড় করে শোনা। বিভোর হয়ে শোনা। তন্ময় হয়ে শোনা। যে শোনায় শ্রোতার কানে আর কোনো শব্দ প্রবেশ করে না। মনে কোনো চিন্তা জাগে না। হৃদয়ে কোনো ভাবনা উঁকি দেয় না। এ অবস্থায় শ্রোতা নিজে শোনার অংশ হয়ে যায়। শোনার সর্বোচ্চ স্তর হলো, শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিয়ে শোনা। প্রতিটি লোমকূপের ছিদ্র দিয়ে শোনা। মুগ্ধ সুর, মনোহর গান, হৃদয়কাড়া বক্তৃতা কিংবা প্রেমময় কথা শোনার সময় মানুষ এই স্তরে উঠে যায়। তখন শ্রোতা নিজেই শোনায় পরিণত হয়। জ্ঞান-বুদ্ধি-শরীর-মন সবকিছু একাকার করে সে শোনে। নিজেকে উজাড় করে শোনে। নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে শোনে। নিজেকে মিটিয়ে দিয়ে শোনে। নিজেকে হটিয়ে দিয়ে শোনে। নিজেকে চূর্ণবিচূর্ণ করে সর্বস্ব দিয়ে শোনে। যতভাবে শোনা যায় ততভাবে শুনতে থাকে। শুনতে শুনতে কখন যে রাত ভোর হয়ে যায়, ভোর রাত হয়ে যায়, দিন মাস হয়ে যায়, মাস বছর হয়ে যায়, বছর যুগ হয়ে যায় নিজেও জানে না।
বেশনো- শোনো। এ কোনো সাধারণ শোনা নয়। আধ্যাত্মিক যাত্রার প্রথম পদক্ষেপ শোনা। মুরিদের প্রধান কাজ শোনা। বিনয়ের সিঁড়ি শোনা। অহংকারী কখনো শোনে না। জগতে কোনো অহংকারী আজ পর্যন্ত অলি হয়নি।
বেশনো- শোনো। এ কোনো সাধারণ শোনা নয়। কোরআনের প্রথম শব্দ ইকরা। পড়ো। আর রুমির আধ্যাত্মিক সফরের প্রথম সবক হলো বেশনো। শোনো। কাকে শুনবে? গুরুকে শুনবে। গুরু কে? গুরু হলেন মুহাম্মদ (সা.)। গুরু হলেন পীর। জিবরাইল ফেরেশতা নবীজিকে বলেছেন পড়ো। পড়া নবীর প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব। আর উম্মতের কর্তব্য শোনা। আল্লাহ বলেন, ‘তিনি সেই আল্লাহ, যিনি চিরজ্ঞানীদের একজনকে রসুল হিসেবে পাঠিয়েছেন। রসুলের দায়িত্ব হলো আয়াত তেলাওয়াত করে উম্মতকে শোনানো।’ (সুরা জুমা, আয়াত ২) শোনা মুরিদের বৈশিষ্ট্য। শুনতে শুনতে একসময় সে পড়ার যোগ্যতা অর্জন করে। নবীর কথা শোনার মাধ্যমে সে নায়েবে নবী হয়। আলেম হয়। পীরের কথা শোনার মাধ্যমে মুরিদ একসময় খলিফা হয়। সবার আগে তাকে শুনতে হবে। সাহাবিরা শুনে মুসলমান হয়েছেন। জগতের যত জ্ঞানী আছেন তারা সবাই শুনেছেন। এ শোনা এক নিরন্তর সিলসিলা। শোনা ছাড়া মুসলমান হওয়া যায় না। শোনা ছাড়া মুরিদ হওয়া যায় না। ছাত্রের জন্য শিক্ষককে শোনা গুরুত্বপূর্ণ। শুধু পাঠ্যবই ছাত্রকে পাস করাতে পারে না। সুরা আলে ইমরানে জ্ঞানীদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ বলেছেন, ‘জ্ঞানীরা ফরিয়াদ করে বলে, হে আল্লাহ! অবশ্যই আমরা একজন আহ্বানকারীর আহ্বান শুনেছি। তিনি বলেছেন, তোমাদের প্রতিপালকের প্রতি ইমান আনো। আমরা ইমান এনেছি।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত ১৯৩।) শোনা বিশ্বাসীদের বৈশিষ্ট্য। শোনা ক্ষমাপ্রাপ্তদের বৈশিষ্ট্য। কোরআনের ভাষায়, ‘জগতের বিশ্বাসী তাদের মোনাজাতে বলে, ওগো পরওয়ারদেগার! আমরা শুনেছি এবং মেনেছি। তুমি আমাদের ক্ষমা করে দাও।’ (সুরা বাকারাহ, আয়াত ২৮৫।) শোনা জান্নাতিদের বৈশিষ্ট্য। শোনা সফলকামদের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ বলেন, ‘বিশ্বাসীদের যখন নিজেদের মধ্যকার ফায়সালার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রসুলের দিকে ডাকা হয়, তারা বলে আমরা শুনেছি এবং মেনেছি। এরাই সফলকাম।’ (সুরা নূর, আয়াত ৫১)
বেশনো- শোনো। এ কোনো সাধারণ শোনা নয়। এ হলো মুরিদের প্রতি পীরের আদেশ। ইকরাও আদেশ। পড়ো। বেশনোও আদেশ। শোনো। শোনো মানে হলো মানো। কামেল পীরের হুকুম মানো। পীরের দেখানো পথে চলো। দৈনন্দিন কথাবার্তায় আমরাও শোনা শব্দটি এ অর্থে ব্যবহার করে থাকি। শিক্ষক ছাত্রদের বলেন, ‘আমার কথা শুনলে তোমরা পাস করবে।’ এখানে শোনা বলতে নির্দেশনা অনুসরণ বোঝানো হয়েছে। পিতা সন্তানকে বলেন, ‘আমার কথা শুনো।’ এখানে শোনা বলতে আনুগত্য বোঝানো হয়েছে। রুমিও শোনা বলতে পীরের আনুগত্য, অনুসরণ, মেনে চলা বুঝিয়েছেন।
লেখক : প্রিন্সিপাল, সেইফ এডুকেশন ইনস্টিটিউট