সোমবার, ৬ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

আল কোরআন সুন্নাহর আলোকে শবেবরাত

মুফতি মাও. মুহাম্মদ এহছানুল হক মোজাদ্দেদী

আল কোরআন সুন্নাহর আলোকে শবেবরাত

আগামী ৯ এপ্রিল বৃহস্পতিবার পবিত্র শবেবরাত। পবিত্র শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে ‘শবেবারাত’ বলা হয়। শবেবরাত কথাটি ফারসি। শব মানে রাত, বরাত মানে মুক্তি; শবেবরাত অর্থ মুক্তির রজনী। ‘শবেবরাত’-এর আরবি হলো ‘লাইলাতুল বারাত’। হাদিস শরিফে যাকে ‘নিসফ শাবান’ বা শাবান মাসের মধ্য রজনী বলা হয়েছে। তবে বিশ্ব মুসলমানের কাছে এ রাত ‘শবেবরাত’ নামেই বেশি পরিচিত। শবেবরাত সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হা-মিম! শপথ! উজ্জ্বল কিতাবের। নিশ্চয়ই আমি তা নাজিল করেছি এক বরকতময় রাতে। নিশ্চয় আমি ছিলাম সতর্ককারী। (সূরা দুখান, আয়াত : ১-৩)। এ আয়াতের তাফসির সম্পর্কে বরেণ্য মুফাসসির আল্লামা শেখ আহমদ ছাভী (রহ.) বলেন, ওই বরকতময় রজনী হচ্ছে অর্ধ শাবানের রাত। বিশিষ্ট তাবেয়ি হজরত ইকরামা (রা.) এবং অন্য তাফসিরকারকদের মতও এটাই যে, সেই বরকতময় রাত হলো মধ্য শাবান তথা শবেবরাত।’ (তাফসিরে ছাভী, খন্ড ৪, পৃষ্ঠা ৪০)।

আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতি (রহ.) এ আয়াতের তাফসিরে বলেন, ‘আর বরকতময় রাত হলো লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান বা শাবানের মধ্য রাত তথা শবেবরাত। কেননা এ রাতে উম্মুল কিতাব কোরআন শরিফ সপ্তম আসমান থেকে দুনিয়ার আসমানে তথা প্রথম আসমানে নাজিল হয়েছে।’ (তাফসিরে জালালাইন, পৃষ্ঠা ৪১০)।

ইমাম আবু জাফর আত-তাবারি (রহ.) বলেন, ‘তাবেয়ি হজরত ইকরামা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মধ্য শাবানের রাতে বছরের সব ব্যাপার চূড়ান্ত করা হয়, জীবিত ও মৃতদের তালিকা লেখা হয় এবং হাজীদের তালিকা তৈরি করা হয়। এ তালিকা থেকে পরবর্তীতে একজনও কমবেশি হয় না।’ (তাফসিরে তাবারি, খন্ড ১০, পৃষ্ঠা ২২)। ইমাম কুরতুবি (রা.) বলেন, ‘এ রাতের চারটি নাম আছে- লাইলাতুম মুবারাকা, লাইলাতুল বারাআত, লাইলাতুছ্ ছাক, লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান।’ (তাফসিরে কুরতুবি, খন্ড ১৬, পৃষ্ঠা ১২৬)। ইমাম বাগাভি (রহ.) লিখেন, ‘নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ শবেবরাতের রাতে সব বিষয়ের চূড়ান্ত ফয়সালা করেন এবং শবেকদরের রাতে তা সংশ্লিষ্ট দায়িত্ববান ফেরেশতাদের কাছে ন্যস্ত করেন।’ (তাফসিরে বাগাভি, খন্ড ৭, পৃষ্ঠা ২২৮)। শবেবরাতের ফজিলত ও আমল সম্পর্কে সহিহ হাদিস শরিফেও অনেক বর্ণনা এসেছে। আম্মাজান হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, একবার রসুলুল্লাহ (সা.) নামাজে দাঁড়ালেন এবং এত দীর্ঘ সেজদা করলেন যে আমার ধারণা হলো, তিনি ওফাত পেয়েছেন। আমি তাঁর পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম, তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল; তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করে আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আয়েশা! তোমার কি এ আশঙ্কা হয়েছে? আমি উত্তরে বললাম, ইয়া রসুলুল্লাহ (সা.)! আপনার দীর্ঘ সেজদা দেখে আমার আশঙ্কা হয়েছিল, না জানি আপনি ওফাত পেয়েছেন? নবীজি (সা.) বললেন, তুমি কি জান এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও আল্লাহর রসুলই ভালো জানেন। তখন নবীজি (সা.) বললেন, এটা হলো অর্ধ শাবানের রাত; এ রাতে আল্লাহতায়ালা তাঁর বান্দাদের প্রতি মনোযোগ দেন; ক্ষমাপ্রার্থীদের ক্ষমা করেন, অনুগ্রহ প্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন। আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের তাদের অবস্থাতেই ছেড়ে দেন। (শুআবুল ইমান, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৩৮২)। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে আরও বর্ণিত হয়েছে, নবীজি (সা.) এ রাতে মদিনার কবরস্থান ‘জান্নাতুল বাকি’তে এসে মৃতদের জন্য দোয়া ও ইস্তেগফার করতেন। প্রিয়নবী (সা.) তাঁকে বলেছেন, এ রাতে বনি কালবের ভেড়া বকরির পশমের সংখ্যার পরিমাণের চেয়েও বেশিসংখ্যক গুনাহগারকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। (তিরমিজি শরিফ, হাদিস নম্বর : ৭৩৯)।

একদিন প্রিয়নবী (সা.) আম্মাজান আয়েশা (রা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আয়েশা! শাবান মাসের মধ্য রাতের মর্যাদা ও ফজিলত সম্পর্কে তুমি কী জান? তিনি আরজ করলেন, ইয়া রসুলাল্লাহ (সা.) শাবান মাসের মধ্য রাতের মর্যাদা কী? আল্লাহর হাবিব (সা.) উত্তরে বললেন, আগামী এক বছরে কতজন আদম সন্তান ভূমিষ্ঠ হবে এবং কতজন আদম সন্তান মৃত্যুবরণ করবে তা এ রাতে লিপিবদ্ধ করা হয়। আর এ রাতে তাদের আমল মহান আল্লাহর দরবারে উপস্থাপন করা হয় এবং তাদের রিজিক অবতীর্ণ কিংবা নির্ধারণ করা হয়। (ফাজায়েলুল আওকাত, হাদিস নম্বর ২৬)। হজরত আবু মূসা আশয়ারী (রা.) রসুলে কারীম (সা.) থেকে বর্ণনা করেন। রসুলেপাক (সা.) এরশাদ ফরমান- মধ্য শাবানের রাতে আল্লাহপাক রহমত নিয়ে আবির্ভূত হন এবং তার সব বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু মুশরিক বা শত্রুতাপোষণকারী ব্যক্তিকে ক্ষমা করেন না। (ইবনে মাজাহ, হাদিস নম্বর ১৩৮৯)। হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ১৪ শাবান দিবাগত রাত যখন আসে তখন তোমরা এ রাতটি ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাও এবং দিনের বেলায় রোজা রাখ; কেননা, এদিন সূর্যাস্তের পর আল্লাহতায়ালা দুনিয়ার আসমানে  রহমত নিয়ে অবতরণ করেন এবং আহ্বান করেন; কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছ কি? আমি ক্ষমা করব; কোনো রিজিকপ্রার্থী আছ কি? আমি রিজিক দেব; আছ কি কোনো বিপদগ্রস্ত? আমি উদ্ধার করব। এভাবে ভোর পর্যন্ত আল্লাহতায়ালা মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করে আহ্বান করতে থাকেন। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৩৮৪)। তবে, মুশরিক, হিংসা পোষণকারী, সর্বদা ব্যভিচারকারী, পিতা-মাতার অবাধ্য, মদ্যপানকারী, হারাম মাল ভক্ষণকারী, এতিমের সম্পদ আত্মসাৎকারী ক্ষমা পাবে না। তাদের তওবা করতে হবে।

লেখক : খতিব, মনিপুর বাইতুর রওশন (মাইকওয়ালা) জামে মসজিদ, মিরপুর, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর