শনিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

তিন মাসের লকডাউনের বিকল্প নেই

আমসাআ আমিন

করোনাভাইরাসে বৈশ্বিক সম্ভাব্য মৃত্যুর সংখ্যা হিসাব করাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো যুদ্ধ-বিগ্রহে, কোনো মহামারীতে বা কোনো দুর্যোগে এত কম সময়ে এত প্রাণহানির নজির নেই। ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশের, স্বাস্থ্যসেবায় অরক্ষিত গ্রামদেশের এবং আমাদের লাখ লাখ বস্তিবাসীর কথা ভাবলে গা শিউরে ওঠে। বিশেষ করে যখন ছুটির আমেজে, জীবিকার চাপে ও বাস্তব পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক দূরত্ব, কোয়ারেন্টাইন ইত্যাদি কার্যকর সম্ভব হচ্ছে না, তখন আতঙ্কিত না হয়ে পারা যায় না। তার ওপর এখন শুরু হলো কমিউনিটি ট্রান্সমিশন অর্থাৎ করোনাভাইরাসের সামাজিক সংক্রমণ। সার্বিক মেডিকেল বিষয়গুলোয় আমাদের অনেক দুর্বলতা আছে। ফলে বর্তমান সামাজিক সংক্রমণ পর্যায়ে আক্রান্ত সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এ পর্যায়ে মানুষকে ঘরে থাকতে বাধ্য করে সংক্রমণ প্রতিরোধই শ্রেষ্ঠ কৌশল। কিন্তু প্রচার খুব কাজে লাগছে না। দৈনন্দিন রোজগারের আশা ও ত্রাণ পাওয়ার জন্য তারা বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছেন। সুতরাং কঠোরভাবে টোটাল মানে একেবারে টোটাল লকডাউন নিশ্চিত করার বিকল্প নেই এবং তা ৯০ দিনের জন্যই করতে হবে, অল্প অল্প করে লকডাউন কার্যকর হবে না। অনেক দেশ লম্বা মেয়াদেই সফলভাবে লকডাইন করেছে। সহজ বিকল্প মনে হলেও ধাপে ধাপে ছুটি দেওয়ার কৌশল লকডাউনের মতো কার্যকর হতে পারে না এবং হচ্ছেও না। তবে অনেকেই বলছেন, বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে লকডাউন সফল করা যাবে না। তারা বলছেন, গরিবরা না খেয়ে মরবে। কিন্তু আমরা তো এখন নিম্নমধ্যম, প্রায়-মধ্যম আয়ের দেশ। কথাটা অত মিথ্যা নয়। তাহলে আমরা কেন তাদের খাওয়াতে পারব না? রাজনৈতিক, নীতিনৈতিক ও শক্তিশালী সদিচ্ছা নিয়ে আমাদের সম্পদ ও সামর্থ্য এক করতে পারলে এ সমস্যার সমাধান হতে পারে। আমাদের প্রয়োজন ৪০-৫০% মানুষের ঘরে ঘরে আট-দশ দিন করে করে নয়-দশবারে ধাপে ধাপে ৯০ দিনের প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য পৌঁছে দেওয়া। নেতাদের মাধ্যমে অবশ্যই নয়, রাজনীতির সময় এটা নয়। অনেকেই ন্যক্কারজনকভাবে আত্মপ্রচারের জন্য গণজমায়েত করাচ্ছেন, ভিডিও করে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এতে কমিউনিটি সংক্রমণ অবশ্যই বাড়বে, তাই এসব জোরালোভাবে নিষিদ্ধ করা দরকার।

তিন মাসের লকডাউনের আর্থিক প্রয়োজনের মোটামুটি একটা হিসাব দাঁড় করানো যায় : ধরুন অর্ধেক জনসংখ্যা অর্থাৎ ৯ কোটি মানুষ % ১ কেজি চাল/ডাল % ৯০ দিন = ৮১০ কোটি কেজি % ৫০ টাকা=৪০ হাজার ৫০০ কোটি+লবণ, তেল, আলু, ডাল, হলুদ, মরিচ ইত্যাদি এবং পরিবহন ও ভলানটিয়ার খরচ আরও ৪০ হাজার ৫০০ কোটি = মোট ৮১ হাজার কোটি টাকা মাত্র প্রয়োজন!!! বেশি বেশি করে ধরা, কিছু কম হবে এবং এ টাকা তো আছে। কত টাকা যাচ্ছে প্রণোদনা, লুটপাট, অর্থ পাচার, ঋণখেলাপি, মেগাচুরি/বড়-ছোট চুরি, চাল-গম চুরি ইত্যাদিতে? হুমকি-ধমকিতে যে কাজ হবে না তা বোঝাই গেছে। সুতরাং সেনাদের দায়িত্ব দিলে সরবরাহ ও বিতরণে দুর্নীতি সহজেই বন্ধ করা যাবে। এজন্য সামরিক, আধাসামরিক ও ভলানটিয়ার বাহিনী তৈরি করে ইউনিয়ন/ওয়ার্ড পর্যন্ত তাদের নিয়োজিত করতে হবে। লকডাউন এবং সরবরাহ ও বিতরণের প্রস্তুতিসহ পুরো দায়িত্ব তাদের হাতে দিতে হবে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সুধীজনদের সহায়তা তারা নিতে পারেন। গাড়ি নিয়ে বিতরণ-টিম বাড়ি বাড়ি গিয়ে ত্রাণ পৌঁছে দেবে। এভাবেই লকডাউন শত না হলেও ৯০ ভাগ সফল হবে, সংক্রমণ হ্রাস পাবে এবং অবশ্যই মানুষ খেয়ে-পরে বাঁচবে। সব জিওসি, বিজিবি, আনসার, এয়ার এরিয়া/বেজ ও নৌ এরিয়া/বেজ কমান্ডাররা অবশ্যই সফলভাবে এ গুরুদায়িত্ব পালন করতে পারবেন। সব ক্ষমতা সরকারের হাতেই থাকবে, এ কাজগুলোর মূল পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন ও মনিটরিং সরকারই করবে। তবে আঞ্চলিক/বিভাগীয় ও স্থানীয় মবিলাইজেশন ও বাস্তবায়ন জিওসিদের কর্তৃত্বাধীন রাখতে হবে। তারা সরকারের কাছে দায়ী থাকবেন। বিষয়টা কোনোভাবেই সামরিক বাহিনীর হাতে দেশের শাসনভার তুলে দেওয়া নয়। দুর্যোগকালীন এ ব্যবস্থা ছাড়া আমার ধারণা, প্রচলিত গতানুগতিক ব্যবস্থা সফল হবে না। কারণ মন্ত্রণালয় ও সিভিল প্রশাসন করোনার মতো ক্ষিপ্র গতিতে কমিউনিটি সংক্রমণের আগে আগে চলতে এত দিন পারেননি, এখনো পারবেন না। অথচ করোনা প্রতিরোধ অপারেশন চালাতে হবে দেশব্যাপী, ২৪ ঘণ্টা সাত দিন। একটু ঢিলামিতেই অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকবে, দেখতে দেখতে মৃতের সংখ্যা রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে পারে এবং অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে যাবে। এজন্যই আমি অনেক দিন থেকে বলে আসছি- জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে, সবাইকে জানিয়ে, বুঝিয়ে, সঙ্গে নিয়ে, অংশীজন করে নিয়ে, একটি বাস্তবসম্মত স্ট্রাটেজিক/লজিস্টিক পরিকল্পনা করা এবং তার সুদক্ষ বাস্তবায়ন করা। জনবল কম হলে অবসরপ্রাপ্তদের ডাকুন। করোনাযুদ্ধের জন্য ‘জাতীয় কাউন্সিল’ করে, অপারেশন রুম করে, সামরিক স্টাইলে পুরো যুদ্ধটা নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করা সময়ের প্রয়োজন। নতুবা অবাঞ্ছিত রাজনৈতিকীকরণ ও তর্ক-বিতর্ক এড়ানো যাবে না, দুর্যোগ মোকাবিলায় অযথা মানুষের মনোবল দুর্বল হয়ে যেতে পারে। তাই অগণিত মানুষের জীবন বাঁচানোর তাগিদে সরকারকে হাত জোড় করে অনুরোধ করছি, প্রস্তাবটি সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করুন। আর একটি বিষয় বলব, সোশ্যাল মিডিয়া খুবই সক্রিয়। তারা যে শুধু আতঙ্ক ছড়াচ্ছে তা নয়, অনেক ভালো পরামর্শও সেখান থেকে পাওয়া যেতে পারে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের সোশ্যাল মিডিয়া সেল শুধু আতঙ্কের খোঁজ না করে গঠনমূলক পরামর্শগুলোর খোঁজ নিয়ে সরকারের গোচরে আনতে পারেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে জানাতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের গভর্নর এন্ড্রু কুয়োমো প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন, সহায়তা চেয়েছিলেন। তিনি শোনেননি। আজ নিউইয়র্ক করোনার বৈশ্বিক এপিসেন্টার, লাখো মানুষকে ইতিমধ্যে জান দিতে হয়েছে। ট্রাম্প কি এর দায় এড়াতে পারবেন? আমাদের এখনো এক ফোড়নে কাজ হতে পারে, পরে শত ফোড়নেও তা হবে না। দায় কার ঘাড়ে পড়বে? তার চেয়েও বড় কথা- শত সহস্র মানুষের জীবনের কথা ভাবা, সঠিক উদ্যোগটি নেওয়া এবং দ্রুত।

লেখক : মেজর জেনারেল ও রাষ্ট্রদূত (অব.) এবং নৈতিক সমাজ, বাংলাদেশের প্রবক্তা।

সর্বশেষ খবর