নারী এবং নিরাপত্তা শব্দ দুটি যেন আমাদের সমাজে ক্রমশ বিপরীতমুখী শব্দ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে চলেছে। রাষ্ট্র যেন নারীকে নিরাপত্তা না দেওয়ার পণ করেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমাজ বা রাষ্ট্রের আচরণে মনে হয় নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি সমাজের কাছে বেশ অপাঙ্ক্তেয়। নারীর আবার নিরাপত্তা হতে পারে এই ভাবনা ভেবে কেউ তার জীবনের সময় নষ্ট করতে রাজি নয়। বরং নারীকে ভোগ্যপণ্য ভাবার ক্ষেত্রে যে কুৎসিত আনন্দ পাওয়া যায় তাই অনেকের স্বর্গসুখ সম মনে হয়। সমাজ জীবনের এমন একটি জায়গা পাওয়া যাবে না যেখানে নারী নিরাপদ, যেখানে নারীকে যৌন হয়রানির শিকার হতে হয় না। একজন নারীকে জন্মের পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রতিনিয়ত ভাবতে হয় তার নিরাপত্তার কথা। তাকে প্রতিনিয়ত আতঙ্কে দিন কাটাতে হয়।
নিঃসন্দেহে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী কঠিন সময় পার করছে মানবজাতি। করোনা নামক মহামারী বাতাসের সঙ্গে ছড়িয়ে নিভিয়ে দিচ্ছে মানবসভ্যতার আলো, মানুষ যখন প্রতিটি মুহূর্তে মৃত্যুর প্রহর গুনছে ঠিক এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতিও থামিয়ে দিতে পারেনি ধর্ষক নামক দানবদের। এমন বিভীষিকাময় মুহূর্তেও তাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি সমাজ। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী চলতি এ বছরে জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত দেশে ৮৮৯ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছে ৪১ জন। সেই হিসাবে চলতি বছর প্রতি মাসে গড়ে ১১১ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। করোনার মতো ভয়াবহ ভাইরাস পৃথিবীর অনেক কিছুর গতিপথ বদলে দিলেও বদলাতে পারেনি ধর্ষকদের আচরণ। সম্প্রতি সংস্থাটির দেওয়া এ পরিসংখ্যান থেকে আরও জানা যায়, দেশে ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সহিংসতা দিন দিন বাড়ছে। ২০১৯ সালে এক হাজার ৪১৩ নারী ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৭৬ জন। আর আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ১০ নারী। এবার আসা যাক নারীরা যেই গণপরিবহনে যাতায়াত করেন সেখানে তারা কতটুকু নিরাপদ। যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৯ সালে গণপরিবহনে ৫২টি ঘটনায় ৫৯ জন নারী ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, সড়কপথে ৪৪টি, রেলপথে ৪টি ও নৌপথে ৪টি যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ১৬টি ধর্ষণ, ১২টি গণধর্ষণ, ৯টি ধর্ষণের চেষ্টা ও ১৫টি যৌন হয়রানির ঘটনা রয়েছে। সর্বশেষ দেখে নেই নারী কর্মস্থলে কতটুকু নিরাপদ। জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম কর্তৃক পরিচালনা করা একটি জরিপ অনুযায়ী প্রায় সব নারী কর্মস্থলে কোনো না কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হন। তবে সমাজের এমন ভয়াবহ ও বীভৎস রূপ কিন্তু সমাজের বেশির ভাগ মানুষের মন গলাতে পারেনি বরং আমরা দেখতে পাই এদের হয়ে দালালি এবং গলাবাজি করে যাচ্ছে বিভিন্ন কথা বলে। কখনো বলা হচ্ছে পর্দা না করার কারণে ধর্ষণ বাড়ছে, কখনো বলা হচ্ছে নারীর একা চলাফেরার কারণে ধর্ষণ বাড়ছে, কখনো বলা হচ্ছে নারীর রাতের বেলা চলাফেরার কারণে ধর্ষণ বাড়ছে। এদের কুৎসিত ও নোংরা কথা শুনলে মনে হবে নারী হয়ে জন্মানোটাই যেন নারীর আজন্ম পাপ। এবার আলোকপাত করা যাক ধর্ষণকে জায়েজ করার পক্ষে যেসব যুক্তি দেওয়া হয় সেইগুলোর দিকে। একটি বলা হয় পর্দা না করার কারণে ধর্ষণ বাড়ছে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী আগস্ট মাস পর্যন্ত দেশে ধর্ষণের বীভৎসতার শিকার হয়েছে ৩২৪ জন শিশু। এদের মধ্যে দলগত ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪৯ জন শিশু, ধর্ষণের পর মেরে ফেলা হয় ১৮ জন শিশুকে এবং ৭ জন শিশু ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করে। যদি পর্দা না করাই হতো ধর্ষণের কারণ তাহলে তো শিশু ধর্ষণ হওয়ারই কথা নয়। পাঁচ বছরের শিশুরাও যেখানে ধর্ষণের লোলুপ থাবা থেকে রক্ষা পায় না সেখানে পর্দার কথা বলা ধর্ষণকে জায়েজ করার অপচেষ্টা ছাড়া আর কিই বা হতে পারে?
আরেকটি বলা হয় নারীর একা চলা ফেরার কারণে ধর্ষণ বাড়ছে। অথচ টাঙ্গাইলে এক নারী তার স্বামীকে নিয়ে কালিহাতীতে বাবার বাড়ি থেকে মির্জাপুর কর্মস্থলে ফিরছিলেন। কালিহাতী বাস টার্মিনালে পৌঁছানোর পর ওই মহিলার স্বামীকে কে মারপিট করে এবং তার মোবাইল ফোন ও নগদ টাকা ছিনিয়ে নেয় এবং ওই নারীর স্বামীকে আটকে রেখে নারীকে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে সারা রাত গণধর্ষণ করে। এমনকি সম্প্রতি সময়ে স্বামীর সঙ্গে এমসি কলেজে ঘুরতে এসে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক গৃহবধূ। এমন আরও অসংখ্য উদাহরণ আমরা প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললেই হরহামেশা দেখি। খুব সহজেই বোঝা যায় নারী একা নাকি সঙ্গীসহ সেটি ধর্ষণের সঙ্গে বিন্দুমাত্র সংশ্লিষ্টতা নেই। এই ধরনের যুক্তি দিয়ে সমাজে ধর্ষণের এক ধরনের বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।সর্বশেষ আসুন দেখি নারীর রাতের বেলা চলাফেরার কারণে ধর্ষণ বাড়ছে এই ধরনের কথার ভিত্তি কী? রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায় এক গৃহবধূর ঘরে ঢুকে তাকে ধর্ষণ করেছেন এক ব্যক্তি। ওই গৃহবধূর চিৎকারে আশপাশের লোকজন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ধরে স্থানীয় কাউন্সিলরের কাছে নিয়ে যান। কিন্তু কাউন্সিলর তাকে ছেড়ে দেন। এ নিয়ে ক্ষোভে ওই গৃহবধূ আত্মহত্যা করেছেন। আরেকটি ঘটনায় দেখা যায় খাগড়াছড়ি গালাবাড়ি ইউনিয়নে গভীর রাতে ঘরে ঢুকে নয়জনের একটি দল এক পাহাড়ি নারীকে ধর্ষণ করে। দুর্বৃত্তরা ঘরের দরজা ভেঙে প্রবেশ করে ওই নারীর বাবা-মাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে তাকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। এমন আরও অসংখ্য উদাহরণ প্রমাণ করে এসব ধর্ষণের শিকার হওয়া নারীরা কোথাও চলাফেরা করেননি বরং তারা নিজেদের গৃহে অবস্থান করছিলেন। কিন্তু সেই গৃহের প্রাচীর তাদের ধর্ষকের করাল থাবা থেকে রক্ষা করতে পারেনি। দ্বিধাহীনভাবে বলা যায়, যে বা যারা বিভিন্ন অজুহাত তথা পর্দা না করার কারণে, একা চলাচলের কারণে, রাতে চলাচল প্রভৃতি বলে ধর্ষণকে জায়েজ করার চেষ্টা করেন তারা প্রকৃত পক্ষে ধর্ষককে সহযোগিতা করেন। তারা চিন্তা-চেতনায় ধর্ষণকে লালন করেন। এরা সমাজের বিষফোঁড়া। এদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে।
পরিশেষে বলা যায়, নারীর নিরাপত্তা নারীর অধিকার। এই অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে প্রতিটি নারীকে অবশ্যই শামিল হতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না অধিকার কেউ দেয় না, অধিকার আদায় করে নিতে হয়। তাই রাষ্ট্রের কাছ থেকে নারীদের তার নিরাপত্তার অধিকার আদায় করে নিতে হবে।
লেখক : শিক্ষক, আইন বিভাগ, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়।