লেখাটা শুরু করছি একটা মর্মন্তুদ সংবাদ শিরোনাম দিয়ে। ‘দুই দিনে সারা দেশে পানিতে ডুবে ৩০ জনের মৃত্যু’। ১০ জুন এক প্রভাবশালী গণমাধ্যমে এ সংবাদ প্রকাশ হয়েছিল। খবরের উপস্থাপনাবাক্যে লেখা হয়-ঈদের পরের দুই দিন (রবি ও সোমবার) বিভিন্ন সময় এসব ঘটনা ঘটে। নিহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই শিশু। ১৭ জুন আরেক পত্রিকায় ‘ছুটিতে পানিতে ডুবে মৃত্যুর লম্বা মিছিল’, শিরোনামে ছাপা সংবাদে বলা হয়, স্থানীয় হাসপাতাল ও পুলিশ সূত্র মোট ৭৮ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করেছে। বুক ভাঙা কয়েকটা খবর ছিল এরকম-
ঈদের তৃতীয় দিন ৯ জুন দুপুরে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের কলাতলী সায়মন বিচ পয়েন্ট এলাকায় গোসলে নেমে শাহীনুর রহমান (৬০) এবং তাঁর ছেলে সিফাত (২০) মারা যান। তাঁরা রাজশাহী থেকে কক্সবাজার ভ্রমণে গিয়েছিলেন।
মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার জায়ফরনগর ইউনিয়নের হামিদপুর গ্রামে মেয়েকে সাঁতার শেখাতে গিয়ে ৯ জুন দুপুরে পুকুরে ডুবে বাবা-মেয়ের মৃত্যু হয়। তাঁরা হলেন হামিদপুর গ্রামের ইটভাটা ব্যবসায়ী বাবুল আহমদ (৬০) ও তাঁর মেয়ে হালিমা মোহাম্মদ (১৭)। হালিমা ঢাকার ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্রী। এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় তার অংশ নেওয়ার কথা ছিল।
চট্টগ্রামের পটিয়ায় পুকুরে ডুবে চাচা-ভাতিজার মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। ৯ জুন দুপুরে স্থানীয় একটি পুকুরে ডুবে তাঁরা মারা যান। নিহত ব্যক্তিরা হলেন পটিয়া উপজেলার আশিয়া ইউনিয়নের মধ্যম বাথুয়া ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা বজল আহমদের ছেলে মোহাম্মদ নাছির (৫৫) ও তাঁর ভাতিজা মোহাম্মদ আইরিয়ান (১৫)।
দিনাজপুরের চিরিরবন্দরে পরিবারের সঙ্গে ঈদ উদ্যাপন করতে গিয়ে বাড়ির পাশে পুকুরে ডুবে তিন বছর বয়সি এক শিশু ও সদর উপজেলার আত্রাই নদীর রাবার ড্যামে গোসলে নেমে এক কিশোরের মৃত্যু হয়েছে। ৮ জুন দুপুরে এসব মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরে নানার বাড়ি বেড়াতে গিয়ে পানিতে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। ৮ জুন দুপুরে উপজেলার বুধন্তী পশ্চিমপাড়ায় এ ঘটনা ঘটে। মারা যাওয়া শিশুরা হলো চান্দুরা এলাকার মোশাররফের ছেলে রাফি (৭) এবং একই এলাকার রহিম মিয়ার মেয়ে নাদিরা (৮)।
কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলায় বাড়ির পাশের পুকুরের পানিতে ডুবে হোসাইন নামের ১৬ মাস বয়সি এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। নিহত শিশু হোসাইন ওই এলাকার রফিকুল ইসলামের ছেলে। খেলতে খেলতে কখন সে পুকুরে গড়িয়ে পড়েছে, বড়রা খেয়াল করেনি। যখন খোঁজ পড়ে, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলায় পুকুরের পানিতে ডুবে দুই ভাইবোনের মৃত্যু হয়েছে। তারা সম্পর্কে আপন খালাতো ভাইবোন। ৯ জুন বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে উপজেলার চরজুবিলী ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর চরমহিউদ্দিন গ্রামের আলাউদ্দিনের বাড়িতে এ ঘটনা ঘটে। নিহত শিশুরা হলো একই ইউনিয়নের চর মহিউদ্দিন গ্রামের মো. জিহাদের মেয়ে ফারিয়া আক্তার (৪) ও কুমিল্লার লাকসামের বাসিন্দা মো. রকির ছেলে মো. তাহাসিন (৫)।
কুড়িগ্রামের রৌমারীতে চাচার সঙ্গে মাছ ধরতে গিয়ে ওয়ায়েস কারনি (৫) নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। সে প্রথম শ্রেণিতে পড়ত। ৯ জুন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে উপজেলা সদরের চান্দারচর এলাকার সীমান্তসংলগ্ন অলেকুড়া নামক স্থানে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
কত স্নেহের বন্ধনেও অসচেতনতা কিংবা সামান্য অসাবধানতায় মর্মান্তিকভাবে পানিতে ডুবে মৃত্যু ঘটতে পারে-তা পাঠকের উপলব্ধির চেষ্টা হিসেবেই বুকে মোচড় দেওয়া এই পূর্বপ্রকাশিত সংবাদ তুলে ধরলাম। এক-একটা পরিবারের বুকভাঙা কান্নার এসব খবর একজন পাঠকের না পড়াটা বা না শোনাই স্বাভাবিক। দেশে সারা বছরে পানিতে ডুবে মৃত্যুর হিসাব শুনলে যে কেউ শিউরে উঠবে। এ থেকে মুক্তির উপায় অন্বেষণই এ রচনার উদ্দেশ্য।
নদীমাতৃক বাংলাদেশ। প্রাকৃতিক কারণ, ভারতের পানি আগ্রাসন, প্রভাবশালীদের দখলদূষণের রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি মোকাবিলা করে, আজও দেশজুড়ে অসংখ্য নদনদী, খালবিল, পুকুর-ডোবা জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে। কৃষি এবং গ্রামীণ গৃহস্থালির প্রাণ এগুলো। এ ছাড়া বৃহত্তর পরিসরে নৌপরিবহন ও দেশবিদেশে বাণিজ্য বিস্তারে নদী-সাগরের বিকল্প নেই।
খালবিল, হাওর-বাঁওড়, নদনদী, পুকুর-ডোবা যেমন মাঠে শস্যদানায় পুষ্টি জোগাচ্ছে, তেমনি কিছু প্রাণসংহারও করছে। কখনো হড়কা বান-বন্যায়, কখনো অসচেতনাজনিত অনভিপ্রেত দুর্ঘটনায়। কদিন আগেই, ওই ঈদের ছুটির সময় বিদেশের এক জলপর্যটন ভ্রমণে নৌকা উল্টে দেশের একজন পাইলট এবং একজন বড় ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়েছে। ভাবা যায়, যে লোকটা সারা পৃথিবীর আকাশ দাপিয়ে উড়োজাহাজ চালিয়ে বেড়ান, তিনি পানিতে ডুবে মারা গেলেন! এই মৃত্যু প্রতিরোধের উপায় নিয়ে ভাবতে হবে। কী করণীয় তার সম্ভাব্য দিকগুলো নিয়ে আলাপ এখানে।
প্রতিটি মানুষের সাঁতার শেখা বাধ্যতামূলক করতে হবে। প্রতিটি শিশুকে সাঁতার শেখাতে হবে। এ দায়িত্ব নিতে হবে রাষ্ট্রকে। সরকারের কিছু পদক্ষেপ নেওয়া আছে, সংশ্লিষ্ট বিভাগ সেগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করবে।
কারণ দেশে জনসংখ্যার একটা বড় অংশ এখনো অশিক্ষিত, অসচেতন ও দরিদ্র। ছেলেমেয়েদের সাঁতার শেখা না-শেখা নিয়ে ভাবার সময় তাদের নেই। কোনো মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে গেলেও এক বেলা কেঁদে, চোখের পানি মুছে তাদের ফের কাজে লাগতে হয়। এই শ্রেণির শিশুদের সাঁতার শেখানোর দায়িত্ব নিতে হবে পাড়া-মহল্লা-গ্রাম থেকে শুরু করে উপজেলা-জেলা পর্যায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ, জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় প্রশাসনকে। উপযুক্ত মৌসুমে, ন্যূনতম পাঁচ বছর বয়সি শিশুদের সাঁতার প্রশিক্ষণ শিবির পরিচালনা করতে হবে। উদ্যমী তরুণ ও যুব নেতৃত্বকে উপযুক্ত পারিতোষিক দিয়ে এ ক্ষেত্রে দায়িত্ব গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। প্রতিটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একজন সাঁতার প্রশিক্ষক নিয়োগ এবং ন্যূনতম আবশ্যক আয়তনের নিরাপদ-গভীরতার সুইমিং পুল করা যেতে পারে। চুরি-জোচ্চুরির প্রকল্প হতে না দিলে পর্যায়ক্রমে এগুলোর নির্মাণ ও নিরাপত্তাবেষ্টনী নির্মাণব্যয় বহন সরকারের জন্য বিরাট গুরুভাব হবে না। উপজেলা-জেলা-বিভাগ সব পর্যায়ের ক্রীড়া সংস্থাকে নিয়মিত সাঁতার প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু রাখতে বাধ্য করতে হবে। রাজধানী থেকে শুরু করে সব শহরের ছোটবড় বেসরকারি স্কুল-কলেজগুলোকে শিক্ষার্থীদের সাঁতার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখতে বাধ্যতা জারি করতে হবে। শিক্ষা-বাণিজ্যে নিয়োজিত উদ্যোক্তাদের অধিকাংশই, অভিভাবকদের পকেট কেটে এবং শিক্ষক ও কর্মচারীদের যতটা সম্ভব বঞ্চিত করে দ্রুত আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছেন বলে বিস্তর অভিযোগ ওঠে। এরা স্থানীয় সরকারি বা বেসরকারি সুইমিং পুলগুলোর সঙ্গে চুক্তি করে পালাক্রমে সব শিক্ষার্থীকে সাঁতার শেখাবেন। বাবা-মার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা ও বিনিয়োগ এবং শিক্ষকদের লাগাতার প্রচেষ্টায় সারা দুনিয়ার লেখাপড়া শিখিয়ে নাসা, গুগলে চাকরি বা চাঁদ-মঙ্গলে যাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করা ছেলেমেয়ে পুকুর-ডোবায় ডুবে মরে যাওয়ার থেকে গ্লানিকর আর কি হতে পারে? পুত্রতুল্য এক মহামেধাবী প্রকৌশলী তরুণের সাঁতার শেখা হয়নি। তাঁর বিয়ে হয়েছে বরিশালে। নৌপথে শ্বশুরবাড়ি যেতে তিনি দ্বিধাগ্রস্ত। তাঁর এই দ্বিধা উৎকণ্ঠা রূপে সংক্রমিত হয় মা-বাবাসহ গোট পরিবারে। কী বিড়ম্বনা ভাবুন তো! ভয়-সংকোচ-জড়তার এ শিকল ভাঙতে হবে।
বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পরিচালিত দেশের সব সুইমিং পুল কর্তৃপক্ষ সপ্তাহে অন্তত এক দিন বিনা মূল্যে শিশু-কিশোরদের সাঁতার শেখানোর কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে।
এখন থেকে নিয়ম করুন-সাঁতার না জানা কেউ সরকারি উচ্চবিদ্যালয়, কলেজ, মেডিকেল-ইঞ্জিনিয়ারিংসহ কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন করতে পারবে না। কোনো পর্যায়ের সরকারি চাকরিতে প্রার্থী হতে পারবে না। জন্মসনদের মতো সাঁতার শেখার সনদও জমা দিতে হবে। বিদেশ গমনেচ্ছুদের ক্ষেত্রেও একই বাধ্যতা বহাল রাখতে হবে। এতে সব মহল থেকে সচেতনতা ও প্রচেষ্টার সাড়া মিলতে পারে।
মানুষ মূলত শক্তের ভক্ত। করোনা মহামারির সময় তাদের রোগমুক্ত ও বাঁচিয়ে রাখার জন্য গৃহবন্দি করে রাখতে হয়েছিল। লকডাউন ভেঙে বেরোনো মানুষদের কোথাও পিটিয়ে ঘরে ঢোকাতে হয়েছে। কী বিচিত্র!
সাঁতার শেখার ব্যাপারেও তেমন কঠোর ব্যবস্থাই নিতে হবে। পরিবার ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি, শিশু-কিশোরীদের সাঁতারে দক্ষ করে তোলা এবং এসবের অনুকূলে জাতীয় নীতিমালা প্রণয়ন ও বিনিয়োগ এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। চাই সমষ্টির আন্তরিক সম্মিলিত প্রচেষ্টা। সামনেই বর্ষা মৌসুম। হাজা-মজা ডোবা-জলাশয়ও থইথই পানিতে ভরে উঠবে। শিশুদের নিয়ে এ সময় অভিভাবকদের বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে। না হলে সেই চলতি বিজ্ঞাপনের ভাষায়-‘একটি দুর্ঘটনা, হয়ে উঠতে পারে সারা জীবনের কান্না।’ আমাদের ছোটবেলায়, পাঠ্যবইতে ব্রজেন দাশের ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার গল্প পড়েছিলাম। সে অর্ধশতাব্দীরও আগের কথা। তারপর সাঁতারের বিশ্বমঞ্চে আমাদের অর্জনের অবস্থান কী? কিছু নেই। এদের পেছনে রাষ্ট্রের যে বিনিয়োগ তার পাশাপাশি দেশের শিশু-কিশোর, যুব নরনারীদের সংকটকালে বেঁচে থাকার মতো সাঁতারটুকু শেখান। ভেসে থেকে ন্যূনতম শ্বাসপ্রশ্বাসটা চালিয়ে যেতে শেখান। ‘নতুন বাংলাদেশ’ এই কাজটি শিরোধার্য করুক। ক্রীড়া উপদেষ্টা জুলাই বিপ্লবের বীর যোদ্ধা। তরুণ তুর্কি এই যুবক অনুধাবন করুন বিষয়টির গুরুত্ব। না হলে ‘বাবু তোমার ষোলো আনাই মিছে’ হয়ে যাওয়া হতভাগ্যদের মিছিল দিনদিন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকবে যে।
যারা সাঁতার জানে, তাদেরও সাঁতার কাটতে হবে জানা জলে, নিরাপদ এলাকায়। আগে দেখে নিতে হবে আবহাওয়া এবং পানির অবস্থা। সাঁতারের সময় সাঁতার জানা আরও কেউ সঙ্গে থাকা নিরাপদ। সাগরে নামতে সাঁতার জানা ব্যক্তিরও জোয়ার-ভাটা, স্রোতের অবস্থা সম্পর্কে স্থানীয় অবহিত মহলসহ পেশাদার পর্যটন সহায়কদের পরামর্শ গ্রহণ নিরাপদ। অজানা পানিতে ঝাঁপ দেওয়া বিপজ্জনক।
দেশখ্যাত বসুন্ধরা গ্রুপের সামাজিক সংগঠন শুভসংঘ বুধবার নেত্রকোনায় সাঁতার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসচেতনতা বিষয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করে। সেখানে শিশু-কিশোরদের সাঁতার শেখানোর প্রয়োজনীয়তার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করে সমাজের সচেতন-সামর্থ্যবান শ্রেণিকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান হয়। শুভসংঘ সারা দেশেই পর্যায়ক্রমে এমন আয়োজন করবে আশা করি। আহ্বান জানাই-দেশের সব বড় শিল্প-বাণিজ্য গ্রুপ এই শুভ কল্যাণকর্মে এগিয়ে আসুক। আজকের শিশু, আগামী দিনের নাগরিকদের আত্মরক্ষায় সক্ষম, সুস্থ ও স্বাস্থ্যবান করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অবশ্যই আপনাদেরও দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে। যা আপনারা এড়িয়ে গেলে তা হবে চরম দায়িত্বহীনতা।
লেখক : ডেপুটি এডিটর, বাংলাদেশ প্রতিদিন