মঙ্গলবার, ১ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

কথা দিয়ে না রাখা কবিরা গুনাহ

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

কথা দিয়ে না রাখা কবিরা গুনাহ

জীবন চলার পথে প্রতিনিয়ত আমরা একে অন্যকে যেসব প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি এসব প্রতিশ্রুতি এবং ওয়াদা রক্ষা করা একান্ত কর্তব্য। ব্যবসা-বাণিজ্য ও ব্যক্তিগত লেনদেনের ক্ষেত্রেও ওয়াদা রক্ষা অপরিহার্য। এ ব্যাপারে সামন্যতম শৈথিল্য প্রদর্শনও দুনিয়া-আখিরাতে বিপদের কারণ হতে পারে। কথা দিয়ে কথা রাখার নাম প্রতিশ্রুতি বা ওয়াদা রক্ষা। আর ওয়াদা রক্ষা মানব জাতির একটি বিশেষ গুণ। এ গুণই হলো মনুষ্যত্বের পরিচায়ক। ওয়াদা পালন মানুষকে আত্মবিশ্বাসী করে। যার কাছে যত বেশি ওয়াদা পালনের গুরুত্ব থাকবে, সে তত বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠবে মানুষের মাঝে। ওয়াদা ভঙ্গের ফলে রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তি পর্যায়ে পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতি ঘটে। নবীজি (সা.) প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারীকে মুনাফেক হিসেবে অবহিত করেছেন। ইসলামী শরিয়তে ওয়াদা ভঙ্গ করাকে কবিরা গুনাহ বলা হয়। সুতরাং ওয়াদা ভঙ্গ করে কোনো মুসলমান পরিপূর্ণ ইমানদার হতে পারবে না। সমাজও তাকে সম্মানের চোখে দেখবে না। তাই আমাদের কথা রক্ষায় সচেতন হওয়া উচিত। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা ওয়াদা রক্ষা কর। ওয়াদা রক্ষার ব্যাপারে তোমাদের প্রশ্ন করা হবে।’ সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৩৩।

আরও বলেন, ‘নিজ প্রতিজ্ঞা পালনে আল্লাহ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর কে আছে?’ সুরা তওবা, আয়াত ১১১। অন্যত্র বলেন, ‘হে ইমানদাররা! তোমরা কেন এমন কথা বল যা কাজে পরিণত কর না, এটা আল্লাহর কাছে অত্যন্ত জঘন্য ও ঘৃণিত কাজ যে তোমরা বল এমন কথা যা করবে না।’ সুরা সাফ, আয়াত ২-৩।

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আবু হাসমা (রা.) বলেন, ‘নবুয়ত প্রাপ্তির আগে আমি নবী করিম (সা.)-এর কাছ থেকে কিছু জিনিস খরিদ করেছিলাম, যার কিছু মূল্য পরিশোধ আমার ওপর বাকি রয়ে গিয়েছিল। আমি তাঁকে কথা দিলাম যে তা এই স্থানে নিয়ে আসছি। কিন্তু আমি সেই প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে গেলাম। তিন দিন পরে আমার স্মরণ হলো। এসে দেখলাম তিনি উক্ত স্থানেই আছেন। এরপর নবীজি শুধু এতটুকুই বললেন, তুমি আমাকে তো কষ্টে ফেলেছিলে, আমি তিন দিন ধরে এই স্থানে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি!’ আবু দাউদ।

নবী-রসুলরা ছিলেন ওয়াদা রক্ষাকারী সত্যনিষ্ঠ মহামানব। হজরত ইসমাইল (আ.) সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘এ কিতাবে স্মরণ কর ইসমাইলের কথা। সে ছিল ওয়াদা রক্ষাকারী সত্যনিষ্ঠ নবী এবং রসুল।’ সুরা মারিয়াম, আয়াত ৫৪। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘চারটি স্বভাব যার মধ্যে থাকবে সে খাঁটি মুনাফেক এবং যার মধ্যে এর একটা থাকবে তার মধ্যে মুনাফেকির একটি স্বভাব থাকবে যে পর্যন্ত না সে তা পরিহার করে। স্বভাবগুলো হলো- ১. যখন তার কাছে কিছু আমানত রাখা হয় তাতে সে খেয়ানত করে। ২. সে যখন কথা বলে মিথ্যা বলে। ৩. যখন ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করে এবং ৪. যখন কারও সঙ্গে ঝগড়া করে তখন সে অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করে।’ বুখারি, মুসলিম, আবু দাউদ। হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) বলেছেন, ‘ধ্বংস তার জন্য! ধ্বংস তার জন্য! ধ্বংস তার জন্য! যে ওয়াদা করল এরপর তা রক্ষা করল না।’ মুজামুল আওসাত, তারিখে দিমাশক। হজরত হুজাইফা বিন ইয়ামেন নবীজির একজন প্রসিদ্ধ ও বিশ্বস্ত সাহাবি। যখন তিনি এবং তাঁর বাবা মুসলমান হয়ে মদিনায় আসছিলেন তখন পথিমধ্যে আবু জাহেলের বাহিনীর সঙ্গে দেখা হয়। সে সময় আবু জাহেল তার বাহিনী নিয়ে রসুল (সা.)-এর সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাচ্ছিল। তারা হুজাইফা (রা.)-এর বাবাকে আটক করে জিজ্ঞাসা করল, তোমরা যাচ্ছ কোথায়? তারা বললেন, রসুল (সা.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে মদিনায় যাচ্ছি। এ কথা শুনে আবু জাহেল বলল, তাহলে তো তোমাদের ছেড়ে দেওয়া যাবে না। কারণ তোমরা গিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে। তারা বললেন, আমরা তো কেবল তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। আমরা তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করব না। আমরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করব না। আবু জাহেল তাকে বলল, তাহলে আমার সঙ্গে ওয়াদা কর মদিনায় গিয়ে তোমরা লড়াইয়ে লিপ্ত হবে না। তখন তিনি এ ওয়াদা করলেন। তখন আবু জাহেল তাদের ছেড়ে দিল। হজরত হুজাইফা যখন মদিনা মুনাওয়ারায় পৌঁছলেন তখন দেখতে পেলেন রসুল (সা.) মদিনা থেকে যুদ্ধের জন্য বদর প্রান্তরে রওনা হয়েছেন। পথিমধ্যে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে যায়। হজরত হুজাইফা (রা.) যখন রসুল (সা.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন তখন আবু জাহেলের সঙ্গে কৃত ওয়াদার কথা উল্লেখ করলেন। রসুল (সা.) জবাবে বললেন, তুমি আবু জাহেলের সঙ্গে ওয়াদা করে এসেছ যে শুধু আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য আসবে এবং আমার সঙ্গে আবু জাহেলের বিরুদ্ধে লড়বে না। কাজেই তোমাকে আমি যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি প্রদান করতে পারব না।’ ওয়াদা রক্ষার ব্যাপারে যেই নবীর এত গুরুত্ব ছিল তাঁর উম্মতের আজ বড়ই করুণ অবস্থা। তাই আসুন! আমরা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ওয়াদা রক্ষার চর্চা করি। কখনো যদি মনে হয় এ কথাটি আমার রাখা সম্ভব হবে না তাহলে তার কাছ থেকে বিনয়ের সঙ্গে সময় নিয়ে বলবে, ভাই, আমাকে আরও কিছু সময় দিন। ইনশা আল্লাহ আপনার পাওনা পরিশোধ করব বা কাজটি সম্পন্ন করব। এটি হলো মুসলমানের চরিত্র। আর মুনাফেকির চরিত্র হলো পালিয়ে বেড়ানো, মোবইল বন্ধ রাখা, আরেকজনকে দিয়ে মোবাইল রিসিভ করানো। আফসোস! মুসলমান সমাজে মুনাফেকি আচরণই বেশি হচ্ছে। হে আল্লাহ! আমাদের ক্ষমা করুন এবং ওয়াদা রক্ষাকারী হিসেবে কবুল করুন।

 

লেখক : চেয়ারম্যান বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি পীর সাহেব, আউলিয়ানগর।

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর