নেদারল্যান্ডসের ভগেনিংগেন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক কাতরিন আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন প্রতিষ্ঠানটির ‘লুমেন’ নামের এক ভবনে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক ও গবেষকরা। তারা আগামীর কৃষি বিবর্তন নিয়ে কথা বলছিলেন। বলছি বছর পাঁচ আগের কথা। সেখানে তরুণ শিক্ষক ও গবেষক ক্রিস্টিন বলেছিলেন, ‘আগামীর কৃষি নিয়ন্ত্রণ করবে ন্যানো টেকনোলজি।’ তিনি ব্যাখ্যা করছিলেন, ন্যানো টেকনোলজি সম্পর্কে। ন্যানো টেকনোলজি হচ্ছে পদার্থের এক ন্যানোমিটার (১ ন্যানোমিটার=এক মিটারের এক বিলিয়ন ভাগ) মাত্রার কণাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ ও কাজে লাগানোর বিজ্ঞান। এটি এমন একটি আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, যেখানে বস্তু বা উপাদানকে অত্যন্ত ক্ষুদ্র আকারে, ন্যানোস্কেলে (১ থেকে ১০০ ন্যানোমিটার) পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করে তা দিয়ে কার্যকর উপাদান, যন্ত্র বা পদ্ধতি তৈরি করা হয়। এখানে এক ন্যানোমিটার (হস) মানে এক মিটারের এক বিলিয়ন ভাগের এক ভাগ। ক্রিস্টিন উদাহরণ দিয়ে বলেন, একটি মানুষের চুলের প্রস্থ প্রায় ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ ন্যানোমিটার। ন্যানো প্রযুক্তিতে বিভিন্ন পদার্থকে ন্যানোস্কেলে তৈরি করে তাদের গঠন ও বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করা যায়, যার ফলে নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক সুবিধা পাওয়া সম্ভব হচ্ছে। ন্যানো প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে উদ্ভাবন সম্ভব হয়েছে এমন সব পণ্য ও প্রক্রিয়া, যা খুবই কার্যকরী ও পরিবেশসম্মত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ন্যানো কীটনাশক, বায়ো-সেন্সর, স্মার্ট ডেলিভারি সিস্টেমের পাশাপাশি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো ন্যানো ফার্টিলাইজার। ন্যানো ফার্টিলাইজার একটি অত্যাধুনিক সার, যা প্রচলিত ইউরিয়া বা অন্যান্য সার থেকে আকারে অনেক ক্ষুদ্র, কিন্তু কার্যকারিতায় বহুগুণ বেশি। এটি মাটিতে প্রয়োগের পর ধীরে ধীরে গাছের প্রয়োজন অনুযায়ী পুষ্টি সরবরাহ করে। এর ফলে গাছ দ্রুত শোষণ করতে পারে, অপচয় কম হয়, এবং ফলন হয় বেশি। আমাদের কৃষক যেভাবে ছিটিয়ে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করেন, তার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই অপচয় হয়ে যায়। কিছু বাষ্প আকারে উড়ে গিয়ে বায়ুদূষণ ঘটায়, কিছু আবার জমির পানিতে মিশে পরিবেশের ক্ষতি করে। এতে শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতিই নয়, বরং জমির উর্বরতা ও পরিবেশের ওপরও বিরূপ প্রভাব পড়ে। আশঙ্কার বিষয় হলো, এই অপচয় ঠেকাতে এখনো কার্যকর কোনো বিকল্প পুরোপুরি চালু করা যায়নি।
আমি বহু দিন ধরেই চেষ্টা করে আসছি আমদানিনির্ভর সারের অপচয় ঠেকাতে কৃষককে নানা রকম প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে। ২০০৭ সালে ভিয়েতনামে দেখেছি তারা ‘থ্রি আর’ নীতি অনুসরণ করে। ‘থ্রি আর’ বলতে ভিয়েতনামে সাধারণত ‘রিডিউস, রিফিউজ, রিসাইকেল’ এই তিনটি বিষয়কে বোঝায়। ভিয়েতনাম এই থ্রি আর নীতি অনুসরণ করে পরিবেশ সুরক্ষার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এর আওতায় ইউরিয়ার ব্যবহার সীমিত করতে তারা অনুশীলন করত লিফ কালার চার্ট ও গুটি ইউরিয়ার। এসব নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন তৈরি করেছি।
ভর্তুকি মূল্যে কৃষককে সার দেওয়া হয় বলে রাষ্ট্রের একটা বিশাল পরিমাণ খরচ চলে যায় সার আমদানিতে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি ও ডিএপি মিলিয়ে মোট ৪৭ লাখ টন সার আমদানি হয়েছে। এ পরিমাণ সারের কাস্টম শুল্কায়িত মূল্য ২৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। তার মধ্যে ১৬ লাখ ২৩ হাজার টন ইউরিয়া আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৭ হাজার ১৬৯ কোটি টাকা। এ সমস্যা দূর করতে বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের বহুমুখী গবেষণার একটি ফল হচ্ছে ন্যানো সার।
গবেষকদের কথা মতে, ন্যানো সার কৃষিতে নতুন এক বিপ্লবের সূচনা করতে যাচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ন্যানো ফার্টিলাইজারের ব্যবহার রয়েছে। এখন বাংলাদেশেও দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে ‘ন্যানো ইউরিয়া’ তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জাভেদ হোসেন খান এ কাজটি সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন। গত এপ্রিলে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে অধ্যাপক ড. জাভেদ হোসেন খানের কার্যক্রম দেখে এসেছি। যশোরের বাঘমারা মোড়ে ১৫ কাঠা জমিতে ন্যানো ইউরিয়া ব্যবহার করে ধান চাষের মাঠে দাঁড়িয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি জানান, ন্যানো সারের পলিমারাইজড পুষ্টি উপাদানগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয়, যা ধীরে ধীরে গাছে পৌঁছায় এবং দীর্ঘ সময় ধরে কার্যকর থাকে। এতে সারের খরচ কমে যায়, ফসল উৎপাদন বাড়ে এবং মাটি ও পরিবেশ থাকে সুরক্ষিত। সাধারণ সারের মতো এটি হাতে মিশিয়ে বা এলোমেলোভাবে ছিটাতে হয় না। প্রচলিত সারের দানার আকার ও ওজনের ভিন্নতার কারণে খেতের বিভিন্ন জায়গায় পুষ্টি সুষমভাবে না পৌঁছানোর যে সমস্যা রয়েছে, ন্যানো সারে সেই ঝুঁকি নেই। এতে একরকম ‘প্রিসিশন ফার্টিলাইজেশন’ নিশ্চিত হয়। সরকার যেখানে প্রতি কেজি ইউরিয়া আমদানি করে ৯০-৯২ টাকা এবং তা কৃষকদের কাছে বিক্রি করে ২৭ টাকায়, সেখানে প্রতি কেজির জন্য গড়ে ৬৫ টাকার ভর্তুকি দিতে হয়। প্রতি বছর আমদানিতে ব্যয় হয় হাজার হাজার কোটি টাকা। ২০২৩ সালে দেশে ১৬ দশমিক ২৩ লাখ টন ইউরিয়া আমদানিতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৭ হাজার ১৭০ কোটি টাকা। কিন্তু ড. জাভেদের উদ্ভাবিত ন্যানো ইউরিয়া ব্যবহার করলে প্রতি বিঘা জমিতে যেখানে ইউরিয়ার খরচ হতো ৪ হাজার ২০০ টাকা, এখন তা হবে মাত্র ২৩০ টাকা! অর্থাৎ খরচ কমবে প্রায় ৮০-৯০ শতাংশ।
ড. জাভেদ বলছিলেন, যদিও দেশে সার ব্যবস্থাপনা নিয়ে আইন ও নীতিমালা রয়েছে, ন্যানো সারের বিষয়ে এখনো আলাদা কোনো নীতিমালা নেই। ফলে এর ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। কৃষকের কাছে এই প্রযুক্তির সুফল তুলে ধরতে চাই সুনির্দিষ্ট কৌশল ও প্রশিক্ষণ। তা না হলে এই সম্ভাবনাময় উদ্ভাবন মাঠে গিয়ে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। গবেষকের দাবি, এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে বেশ কয়েকটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে তার এ উদ্ভাবন এবং মার্কিন জৈব সার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কোলাবায়োর সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। এ চুক্তির আওতায় কোলাবায়ো যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যাম ল্যাব থেকে ন্যানো সারের প্রযুক্তি গ্রহণ করবে এবং তারাও তাদের জৈবপ্রযুক্তি ন্যাম ল্যাবের সঙ্গে শেয়ার করবে। তিনি তিন ধরনের ন্যানো ইউরিয়া উদ্ভাবন করেছেন ধান, ভুট্টা ও শাকসবজির জন্য।
বছর আঠারো আগে টাঙ্গাইলের কৃষক আবদুল আজিজ বলেছিলেন, তিনি ইউরিয়া সার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করে উপকার পাচ্ছেন। একদিন আবদুল আজিজ আমার দপ্তরে এসে বললেন, ‘স্যার, আমি পরীক্ষা করে দেখেছি ইউরিয়া সার ছিটিয়ে না দিয়ে বিঘাতে দুই-তিন কেজি স্প্রে করে ধান চাষ করা সম্ভব। এতে ইউরিয়া সার কম প্রয়োগ করেও বেশি ধানের ফলন ঠিকঠাক পাওয়া যায়।’ সে সময় ২০০৭ সালে বিশ্বব্যাপী সারের ঘাটতি ছিল, কৃষকদের মাঝে সার নিয়ে অসন্তোষ। এর মাঝে যদি কোনো প্রযুক্তির মাধ্যমে ইউরিয়া সারের ব্যবহার কমিয়ে ফেলা যায়, তবে সেটি হবে চমৎকার একটি বিষয়। বিষয়টি ভালো করে বুঝতে এবং যাচাইবাছাই করতে ছুটে গেলাম টাঙ্গাইলের শালিয়াবহ গ্রামে। আবদুল আজিজ বললেন, ‘স্যার, আমি দেখলাম গাছের পাতায় সূক্ষ্ম ছিদ্র আছে। যদি পানিতে মিশিয়ে গাছের পাতায় স্প্রে করে দিই তাহলে গাছ সরাসরি গ্রহণ করতে পারে। সেই ভাবনা থেকে পরীক্ষামূলক ইউরিয়া সার পানিতে মিশিয়ে গাছে স্প্রে করে উপকার পেয়েছি।’ বিষয়টি কতটা বিজ্ঞানসম্মত তা জানতে সে সময় আমি যোগাযোগ করি বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কৃষিতত্ত্ব বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আবদুল মজিদের সঙ্গে। তিনি ছয়টি প্লটে পরীক্ষামূলকভাবে আবদুল আজিজের পদ্ধতিতে ইউরিয়া সার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করে যাচাইবাছাই করে দেখলেন আবদুল আজিজের কথাই ঠিক। একই সময়ে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের কৃষি প্রকৌশলী ইফতেখারুল ইসলামকে বিষয়টি জানিয়েছিলাম। তিনি গবেষণা করে বলেছিলেন, ধান গাছের খাদ্য গ্রহণ পদ্ধতি অনুসারে ইউরিয়া সার ছিটিয়ে প্রয়োগ করলে ২০ ভাগ ও গাছ গ্রহণ করতে পারে না। বাতাসে বাষ্পীভূত হয়ে যায়। খেতে জমা পানিতে মিশে নষ্ট হয়। গুটি ইউরিয়া কিছুটা গ্রহণ করতে পারে বটে। তবে ইউরিয়া সার পানিতে মিশিয়ে গাছের পাতায় স্প্রে করলে সবচেয়ে বেশি কার্যকর হয়। সে সময় ইউরিয়া সারের প্রয়োগ নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন প্রচার করেছিলাম। সেই সব প্রতিবেদনে এ বিষয়গুলো তুলে ধরেছিলাম। কোনো এক অজানা কারণে দেশের কৃষিবিজ্ঞানীরা বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করেননি। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, আঠারো বছর আগে একজন সাধারণ কৃষক তার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলেছিলেন ইউরিয়া স্প্রে করে প্রয়োগ করলে বেশি উপকার, আজ গবেষকরা তাদের গবেষণার মাধ্যমে কৃষক আজিজের চিন্তার কাছে পৌঁছালেন ন্যানো ইউরিয়া উদ্ভাবনের মাধ্যমে। ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহার বিশ্বব্যাপী শিল্পায়নে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। উন্নত বিশ্বের ধারাবাহিকতায়, আমাদের ড. জাভেদ উদ্ভাবিত ন্যানো সার যদি দেশের কৃষকের হাতে পৌঁছে দেওয়া যায়, তাহলে তা কৃষি উৎপাদনে অভূতপূর্ব অগ্রগতি এনে দিতে পারে। এর মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তনের পথ তৈরির সম্ভাবনা আছে।
লেখক : মিডিয়াব্যক্তিত্ব