অনুমান করা কঠিন নয় যে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর এক নোংরা যুদ্ধ চাপিয়ে দিতে যাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মতে, ইরান প্রতিরক্ষাহীন। যদিও গত বুধবার কেবিনেট বৈঠকের পর হোয়াইট হাউস থেকে বলা হয়েছে, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প স্থির করবেন যে যুক্তরাষ্ট্র ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে সরাসরি জড়িত হবে কি না। কিন্তু তাঁর প্রতিদিনের কথাবার্তা থেকে স্পষ্ট যে তিনি যে কোনো মুহূর্তে যুদ্ধে জড়িত হওয়ার ঘোষণা দিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণের সক্ষমতা অর্জন নস্যাৎ করা যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাহানা মাত্র। ইরান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে শুরু থেকেই বলে আসছে তাদের পারমাণবিক প্রকল্পের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ বেসামরিক। যুক্তরাষ্ট্র এবং তার পোষ্য ইসরায়েল তা মানতে রাজি নয়। সবার মনে থাকার কথা আড়াই দশক আগে যুক্তরাষ্ট্র ইরাকের বিরুদ্ধে ‘ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র’ তৈরির অভিযোগ এনে ‘বিশ্ব শান্তির প্রতি হুমকি’ দূর করার অজুহাতে জাতিসংঘের মাধ্যমে সামরিক কোয়ালিশন গঠন করে ২০০৩ সালে ইরাকের ওপর হামলা চালিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের সমৃদ্ধ দেশটিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল। কিন্তু ইরাকে তথাকথিত ‘ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র’ উৎপাদনের কোনো প্রমাণই খুঁজে পাওয়া যায়নি, অথচ যুদ্ধে প্রায় ৫ লাখ নিরীহ বেসামরিক ইরাকি নিহত হয় এবং ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের অধিক সম্পদহানি ঘটে।
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ দশম দিবসে প্রবেশ করেছে। দৃশ্যত ২০২৪ সালে নির্বাচনি প্রচারাভিযান চলাকালে ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার ‘চিরন্তন যুদ্ধ’ বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিলেও প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের ছয় মাসের কম সময়ের মধ্যে তিনি ইরানের সঙ্গে চিরন্তন যুদ্ধ শুরু করার প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন। তার প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই। শুধু ট্রাম্প নন, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশেষ করে বিশ্বজুড়ে আধিপত্য বজায় রাখার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রেসিডেন্টের কথা ও কাজের মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িত হতে হলে কংগ্রেসের আগাম অনুমোদন গ্রহণের যে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এখনো তা গ্রহণ করেননি। ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে জাতিসংঘের সমর্থন বা মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে কোয়ালিশন গঠনেরও উদ্যোগ গ্রহণ করেননি, এমনকি যুক্তরাষ্ট্র তার আগের ‘চিরন্তন যুদ্ধে’ লিপ্ত হতে ‘ওয়ার পাওয়ারস অ্যাক্ট’ স্থগিত করেননি। তা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও যুদ্ধবিষয়ক পর্যবেক্ষক ও বিশেষজ্ঞদের ধারণা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শিগগিরই আমেরিকান যুদ্ধবিমানগুলোকে নির্দেশ দেবেন ইরানের ওপর বোমাবর্ষণ করতে এবং তা যে কোনো দিন, যে কোনো মুহূর্তে হতে পারে। কারণ ইতোমধ্যে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি বিমানবাহী রণতরিকে ইরানের দক্ষিণ উপকূলে আরব সাগরে মোতায়েন করার নির্দেশ দিয়েছেন। রণতরি ও যুদ্ধবিমানগুলো মোতায়েন করার মূল উদ্দেশ্য ভারত মহাসাগরের ডিয়েগো গর্সিয়া দ্বীপে আমেরিকান বিমানঘাঁটি থেকে তাদের বি-২ কৌশলগত বোমারু বিমান উড্ডয়নের নিরাপদ করিডর সৃষ্টি করা, যাতে বিমানগুলো ভূপৃষ্ঠের গভীরে ইরানের তিনটি বা আরও অধিকসংখ্যক সন্দেহজনক স্থানে বোমাবর্ষণ করে সেগুলোকে ধ্বংস বা নিষ্ক্রিয় করতে পারে। ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করে আসছিল যে ইরান ওই সব ভূগর্ভস্থ স্থাপনাকে বোমা তৈরির জন্য পারমাণবিক উপকরণ ব্যবহার করছে। যুক্তরাষ্ট্র যদি ইরানের কথিত ভূগর্ভস্থ স্থাপনায় বোমাবর্ষণ করে তাহলে তা পুরোপুরি তুচ্ছ কারণে অন্যায়ভাবে হামলা করা হবে। বিশ্বাসযোগ্য কোনো প্রমাণ ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের নেতৃত্ব ও দেশ দুটির একশ্রেণির মিডিয়া দীর্ঘদিন থেকে অপপ্রচার চালাচ্ছে যে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করেছে এবং কোনো অবস্থাতেই ইরানকে পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হতে দেওয়া হবে না। এর বিপরীতে মাত্র তিন মাস আগে গত মার্চে পারমাণবিক বিষয়ে বিশ্বের কেন্দ্রীয় আন্তঃসরকার ফোরাম জাতিসংঘের স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সির (আইএএফএ) পরিদর্শকরা বলেছেন যে ইরান পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হতে যাচ্ছে এমন কোনো প্রমাণ তারা পাননি। আমেরিকার ১৭টি গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়কারী প্রতিষ্ঠান ইউএস ডাইরেক্টর অব ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্সের ডাইরেক্টর তুলসি গ্যাবার্ডও একই মাসে কংগ্রেসকে জানিয়েছেন যে ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কোনো প্রমাণ নেই। কিন্তু ট্রাম্পের বক্তব্য হচ্ছে, ‘তিনি (তুলসি গ্যাবার্ড) কী বলেছেন, আমি তা পরোয়া করি না। আমি বলছি, তারা একটি অস্ত্র (পারমাণবিক) তৈরির ওপর কাজ করছে। আমি তার কথা শুনি না।’
তাহলে কার কথা শোনেন ট্রাম্প? আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর পরিবর্তে তিনি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এবং ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদ’-এর কথা শোনেন? ১২ জুন ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় কেবল স্থাপনার ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়নি, পরমাণুবিজ্ঞানী ও সামরিক বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের জেনারেলসহ ১৩ ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। ইরান এ ঘটনার জবাব দিয়েছে ইসরায়েলের কয়েকটি শহরের সামরিক ও কৌশলগত স্থাপনা এবং হাইফা বন্দরের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে। এরপর থেকে উভয় দেশের মধ্যে ক্ষেপণাস্ত্র বিনিময় অব্যাহত রয়েছে। উভয় পক্ষে সাধারণ মানুষ হতাহত হচ্ছে, স্থাপনা ধ্বংস হচ্ছে। একে অপরের আকাশসীমা নিয়ন্ত্রণের দাবি করলেও বাস্তবে কেউ কারও আকাশসীমার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হয়নি। যেহেতু কৃতিত্ব দাবির প্রচারণাযুদ্ধ কৌশলের একটি অংশ, অতএব এ ধরনের একের ওপর অন্যের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার দাবির মধ্যে অযৌক্তিক কিছু নেই। তবে এ পরিস্থিতির মধ্যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনির জীবনের ওপর হুমকি দিয়ে ইরানকে পাল্টা হুমকি দেওয়ার উসকানি দিয়েছেন। ইরান পারস্য উপসাগরে আমেরিকান রণতরি এবং ইরাকসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে আমেরিকান ঘাঁটিগুলোর ওপর হামলার হুমকি দিয়েছে।
ইরান-ইসরায়েল চলমান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত হওয়ার অর্থ পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলকে দীর্ঘস্থায়ী এক যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলা, যে যুদ্ধে সবচেয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হবে স্বয়ং যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্প প্রশাসন দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে গণবিরোধী শুল্কনীতি, ইমিগ্রেশন নীতি বাস্তবায়নে নিষ্ঠুরতা এবং রাজনৈতিক সহিংসতা বিস্তারের কারণে অভ্যন্তরীণ চাপের মধ্যে রয়েছে। ইসরায়েলের স্বার্থ রক্ষা করার নামে গাজা ধ্বংস ও ফিলিস্তিনিদের হত্যা বন্ধ করতে আমেরিকা কার্যত নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। এখন ইরায়েলের আগ্রাসি ভূমিকার সমর্থনে ইরানের ওপর সরাসরি হামলা নিজ দেশে ধূমায়িত ক্ষোভ বিস্ফোরণে রূপ নিতে পারে। ইরান তো যুক্তরাষ্ট্রের ওপর যুদ্ধে লিপ্ত নয় অথবা ইরানের তেমন কোনো পরিকল্পনাও নেই, সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে সাড়ে চার দশক ধরে চলে আসা তিক্ততা প্রশমনের চেষ্টার পরিবর্তে কী কারণে ইরানের সঙ্গে তিক্ততাকে স্থায়ী রূপ দেবে, তা আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের বোধগম্য নয়।
তাদের মতে, ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার যুক্তি থাকত যদি তা যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ইরানের কোনো হামলা প্রতিহত করার কারণে হতো; মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সামরিক ঘাঁটিতে অথবা পশ্চিম এশিয়ায় নিয়োজিত ৪০ হাজার আমেরিকান সৈন্যের ওপর ইরানের প্রকৃত বা অনিবার্য হামলা প্রতিহত করার কারণে হতো; অথবা আমেরিকান যুদ্ধজাহাজ বা কোনো বাণিজ্যিক জাহাজে হামলার কারণে হতো। চলমান যুদ্ধে ট্রাম্পের হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে পাল্টা হুমকি দেওয়া ছাড়া ইরান আমেরিকাকে এখন পর্যন্ত কোনো উসকানি দেয়নি। এ কথা সত্য যে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের তেমন কোনো মিত্র নেই। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কি ইসরায়েলকে ইরানের ওপর হামলা চালানোর ইশারা দিয়ে একপর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রকে তথাকথিত ‘বিশ্বশান্তি’ রক্ষার মুরুব্বিয়ানা ফলাতে স্বয়ং ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িত করছেন? তা না হলে গাজায় দেড় বছর ধরে যুদ্ধ চালানোর পর ইরানের মতো একটি বৃহৎ আঞ্চলিক শক্তির ওপর হঠাৎ করে যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া কোনো যৌক্তিক সমরকৌশলের মধ্যে পড়ে না। বিশেষ করে যখন ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা নিয়ে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইতিবাচক আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিল।
ইসরায়েলের আচমকা হামলার কয়েক দিন আগেই ইরান যুক্তরাষ্ট্রকে এমন ইঙ্গিত দিয়ে একটি চুক্তিতে উপনীত হতে সম্মত হয়েছিল যে ইরানের কাছে কোনো পারমাণবিক অস্ত্র নেই এবং ভবিষ্যতেও পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করবে না। যুক্তরাষ্ট্র তখন নতুন নতুন শর্ত আরোপ করতে শুরু করে এবং আমেরিকান ও ইসরায়েলি ইন্সপেক্টরদের কাছে তাদের সামরিক স্থাপনাগুলো পরিদর্শনের দাবি তোলে। ইরানকে তার বিভাজনযোগ্য ইউরেনিয়ামের মজুত অর্পণ করতে বলে। ইরানের বেসামরিক পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পরিচালনার জন্য যা প্রয়োজন, তা ছাড়া তার অতিরিক্ত উপকরণ প্রত্যর্পণে সম্মত হয়েছিল। আলোচনার আশাব্যঞ্জক অগ্রগতির মধ্যে ১৫ জুন যখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানি প্রতিনিধিদলের পুনরায় মিলিত হওয়ার কথা, তার আগেই ১২ জুন মধ্যরাতে ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনার ওপর হামলা চালিয়ে সব হিসাবনিকাশ পাল্টে দেয়। ট্রাম্প বলেছেন, এ হামলার কথা তিনি জানতেন। এটাই সত্য। যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন সিগন্যাল ছাড়া ইসরায়েল এ ধরনের পদক্ষেপ নিতেই পারে না। এটাই যদি বাস্তবতা হয় তাহলে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে অর্থহীনভাবে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিল কেন? যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার জন্য ইসরায়েলকে ব্যবহার করেছে মাত্র।
এখন ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সমর প্রস্তুতি ও ট্রাম্প প্রশাসনের হম্বিতম্বিতে যুক্তরাষ্ট্রের আসল চেহারা উন্মোচিত হয়েছে। ইরানের ওপর আমেরিকান বি-২ বোমারু বিমান থেকে ভূগর্ভ বিদীর্ণকারী বোমা নিক্ষেপ এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এ পরিস্থিতিতে দুটি বৃহৎ ও শক্তিশালী দেশ চীন ও রাশিয়া ইরানের সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন ইসরায়েল ও ইরানের প্রতি দ্রুত যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁরা একই সঙ্গে বলেছেন যে মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি যদি অস্থিতিশীল হয় তাহলে তৃতীয় বিশ্বে শান্তি বিঘ্নিত হবে। অবশ্য তাঁরা এ কথা বলেননি যে যুদ্ধ প্রলম্বিত হলে তাদের দেশের স্বার্থের জন্যও ক্ষতিকর হবে। প্রকৃত যুদ্ধ শুরু হলে স্পষ্ট হয়ে উঠবে, এ দুটি দেশ যুদ্ধে কী ভূমিকা পালন করতে আগ্রহী।
ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক পদক্ষেপে চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থ বিপুলভাবে বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হবে। ইরান বিশ্বের তৃতীয় প্রধান তেল উৎপাদনকারী দেশ এবং ইরানের উৎপাদিত অপরিশোধিত তেলের ৯০ শতাংশই চীন আমদানি করে। এ ছাড়া চীনের মোট তেল চাহিদার ৪০ শতাংশই আমদানি করা হয় ইরানসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। অন্যদিকে ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে সাবেক পারস্য সাম্রাজ্যের সঙ্গে রাশিয়ার সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য বৈরিতা বিরাজ করলেও তাদের মধ্যে শত শত বছর ধরে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কও বিদ্যমান ছিল। রাশিয়া কোনোভাবে ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টাকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করবে না। চীন ও রাশিয়ার বাইরে এ যুদ্ধে ইরানের পক্ষে সমর্থন ঘোষণা করেছে উত্তর কোরিয়া, তুরস্ক ও পাকিস্তান। তবে এখন পর্যন্ত কেউ প্রয়োজনে ইরানকে সামরিক সহায়তা দেবে বলে ঘোষণা করেনি। অতএব এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি বিশ্লেষণে যা মনে হচ্ছে তাতে ইরানকে নিজ শক্তির ওপর ভর করেই ইসরায়েল এবং আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।
সম্ভবত এরই প্রস্তুতি হিসেবে এবং আমেরিকার দ্রুত যুদ্ধে জড়ানোর সম্ভাব্যতার কারণে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি তাঁর উল্লেখযোগ্য কর্তৃত্ব ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোরসহ ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর সুপ্রিম কাউন্সিলের ওপর ন্যস্ত করেছেন। কৌশলগত এ পরিবর্তনের ফলে সামরিক বিষয়ে বড় ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য, এমনকি তা যদি ইরানের কাছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের কথিত পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের প্রশ্ন আসে সে ক্ষেত্রেও সশস্ত্র বাহিনীকে সর্বোচ্চ নেতার ওপর সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। তা ছাড়া আলী খামেনির জীবনের ওপর ৩০ বছর ধরে চলে আসা অব্যাহত হুমকি যদি বাস্তবে রূপ নেয় অর্থাৎ তিনি নিহত হলেও দেশের প্রশাসনিক ও সামরিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে না। ফলে দৃশ্যত চরম পরিস্থিতিতেও ইরানে ক্ষমতার শূন্যতা বা ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা নেই।
যুদ্ধকালীন এ সতর্কতার সঙ্গে ইরানকে বাড়তি সতর্কতা গ্রহণ করতে হবে বিপ্লবোত্তর সরকারগুলোর প্রতিপক্ষ অভ্যন্তরীণ নাশকতা সৃষ্টিকারী অপশক্তিগুলো সম্পর্কে যাদের গোয়েন্দা তথ্যে সমৃদ্ধ হয়ে শত্রু দেশ, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল ইরানের স্পর্শকাতর স্থাপনা এবং শীর্ষস্থানীয় সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিদের সঠিক অবস্থানে আক্রমণ চালিয়ে ধ্বংস ও হত্যা করতে সক্ষম হয়। ইরানি নেতারা বাগাড়ম্বর করতে কম করেননি, যার মূল্য এখন তাঁদের দিতে হচ্ছে। সবকিছুর মধ্যে সমগ্র বিশ্ব ইরানের দিকে তাকিয়ে আছে গভীর আগ্রহ নিয়ে। বিশ্ব জনমত বিপুলভাবে ইরানের পক্ষে। তারা ইরানের ওপর চাপিয়ে দেওয়া নোংরা যুদ্ধের অবসান প্রত্যাশা করে।
লেখক : যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সিনিয়র সাংবাদিক