শনিবার, ২৬ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

বাংলাদেশ দ্রুত এগিয়ে চলেছে

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

আজ ২৬ মার্চ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে ঘুম থেকে উঠেই গোটা বিশ্বের বাঙালিরা যে যেখানে  ছিল সবাই জানতে পারল আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান রেডিওর মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেছেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ৯১ হাজার সেনা নিয়ে আত্মসমর্পণ করেন নিয়াজি। তার সঙ্গে ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল টিক্কা খান ও জেনারেল রাও ফরমান আলি। একদিকে যখন আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনা চলছে, তখন অন্যদিকে বাঙালি হত্যার কাজ শুরু করে দিয়েছে। এদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল বাঙালিবিদ্বেষী একশ্রেণির বাঙালি এবং ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব বিহার থেকে পূর্ব বাংলায় আশ্রয় নেওয়া কয়েক লাখ বিহারি মুসলমান। তারা সেখানে গিয়ে দাঙ্গা লাগিয়ে হিন্দুদের বিতাড়িত করে এবং তাদের বাড়িঘর দখল করে নেয়, দখল করে নেয় বাড়ির মহিলাদেরও। এর ফলস্বরূপ ১৯৫০ সালে পূর্ব বাংলাজুড়ে ব্যাপক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। তখন পূর্ব পাকিস্তানে জেলায় জেলায় জেলা শাসক ও পুলিশ সুপার নিয়োগ করা হয় পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পাঞ্জাবিদের এনে। পরিস্থিতি তখন হাতের বাইরে চলে যায়। বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর দল আওয়ামী লীগ এর প্রতিবাদে ৭ মার্চ ঢাকার রমনা ময়দানে লাখ লাখ মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেন- ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু, একই সঙ্গে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন ‘ইত্তেফাক’ কাগজের সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন (যিনি মানিক মিয়া নামে পরিচিত ছিলেন।) তাঁর কাগজে তিনি নিজের সই করা সম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন, ‘বাঙালি রুখিয়া দাঁড়াও’।

এবার দেখা যাক ৫০ বছর আগে সেদিন চট্টগ্রামে কী ঘটেছিল। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তাঁর স্বাধীনতার ঘোষণা পূর্ব বাংলার বিভিন্ন রেডিও স্টেশনে আওয়ামী লীগ নেতারা পৌঁছে দিয়েছিলেন। তাঁর নির্দেশ ছিল, যে রেডিও স্টেশন থেকে আগে সম্ভব হবে সেখান থেকেই যেন তাঁর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি পাঠ করা হয। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সাড়ে ১৭ মিনিটের ঐতিহাসিক বক্তৃতার তিন দিনের মধ্যেই পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে সব রেল যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এ ছাড়া সরকারি বাস পরিষেবা ও স্টিমারও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। সামরিক বাহিনীর লোকজন ছাড়া সাধারণ নাগরিকদের কোথাও যাতায়াত করার উপায় ছিল না। তার ফলে ১ কোটি মানুষ যারা ভারতের বিভিন্ন জায়গায় আসছিলেন, তারা সমস্যায় পড়েন। এ সুযোগে পাক সেনাবাহিনী অসহায় মানুষগুলোর ওপর অত্যাচার চালায়। তাদের জিনিসপত্র লুট করে নেওয়া হয়, মহিলাদের ওপর অত্যাচার চালানো হয়। সে সময় ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মিশে গিয়ে ওইসব মানুষকে উদ্ধার করে এবং পাক সেনাদের তৈরি বাংকারগুলো গুঁড়িয়ে দেয়। আমরা বাংলাদেশে ঢুকে এ চিত্র অনেক জায়গায়ই দেখেছি। সে সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভারত -বাংলাদেশ সীমান্তের বিভিন্ন জায়গা খুলে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ কথা আমায় বলেছিলেন বিএসএফের ডিজি রুস্তমজি। সে সময় আমরা বাংলাদেশের নম্বরপ্লেট লাগানো বহু গাড়ি কলকাতার রাস্তায় চলতে দেখেছি। সে সময় ইন্দিরা গান্ধী আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ দিয়েছিলেন। তা হলো, বাংলাদেশের যত গাড়িতে করে মুক্তিযুদ্ধের লোকেরা কলকাতায় আসবে তাদের সবাইকে পেট্রোল পাম্প থেকে পেট্রোল ও ডিজেল দেওয়া হবে। বাংলাদেশ থেকে আগত প্রায় ১ কোটি মানুষের খাওয়া-দাওয়া, চিকিৎসার জন্য ৭০০-৮০০ ত্রাণশিবির খোলা হয়েছিল। এসব ত্রাণশিবিরের দায়িত্ব দেওয়া হয় রামকৃষ্ণ মিশন, ভারত সেবাশ্রম সংঘসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে। আর এদের মাথায় রাখা হয়েছিল জেলা শাসকদের। সে সময় সংসদের উভয় সভায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ওপর চাপ দেওয়া হতে থাকে বাংলাদেশের পক্ষ নিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার জন্য। ইন্দিরা তখন কথা বলেন চিফ অব দি আর্মি স্টাফ মানেকশর সঙ্গে। মানেকশ তাঁকে বলেন, ‘এই সময় (জুন-জুলাই) বর্ষার মরশুম। এখন যুদ্ধ করা যাবে না। কারণ বর্ষার কাদামাটিতে যুদ্ধ করা অসুবিধে। আর বর্ষার সময় পাক সেনারা বিষধর সাপ ছেড়ে দিতে পারে। এসব কারণে এখনই যুদ্ধে যাওয়াটা ঠিক হবে না।’ এরপর সেপ্টেম্বরে ইন্দিরা গান্ধী আমেরিকা সফরে যান। সেখানে তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে বলেন, ‘আপনি অবিলম্বে বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ করতে বলুন।’ কিন্তু নিক্সন সে কথা শোনেননি। এরপর ইন্দিরা গান্ধী নিউইয়র্কে জেনারেল অ্যাসেম্বলিতে গিয়ে গোটা বিশ্বের কাছে আবেদন জানান, ‘আপনারা পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করুন গণহত্যা বন্ধের জন্য। আর আমেরিকা, চীনের ওপরও চাপ সৃষ্টি করুন। কারণ এ দুই দেশ পাকিস্তানকে মদদ দিচ্ছে।’ এরপর ইন্দিরা জার্মানিতে যান এবং সেখানকার চ্যান্সেলরের সঙ্গে দেখা করে একই আবেদন জানান।

৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান একতরফাভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ১৩ দিনের সে যুদ্ধ শেষ হয় ১৬ ডিসেম্বর। পরাজিত হয় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। জন্ম হয় স্বাধীন সার্বভৌম, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের। সেদিন ভারতের সংসদের অধিবেশন চলছিল। বিকাল ৫টায় অধিবেশন শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তখনো আসেননি। স্পিকার দুবার এসে ফিরে গেছেন। ৫-৭ মিনিট পরে সংসদে ঢোকেন ইন্দিরা গান্ধী। এসেই ঘোষণা করলেন, ‘আজ পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে। জন্ম হয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাংলাদেশের।’ তখন সংসদে তুমুল করতালি। অটল বিহারি বাজপেয়ি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আপনি মা দুর্গা’। সমস্ত বিরোধী নেতাও তখন ইন্দিরার পাশে। এরপর ইন্দিরা বিরোধীদের বললেন, ‘আপনারা আমার পাশে নয় মাস ছিলেন। বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয়েছে। এবার আমাদের লক্ষ্য আমার ভাই মুজিবের মুক্তি। পাকিস্তানের জেলে এখন তিনি বন্দি রয়েছেন। তাঁর মুক্তিই এখন আমাদের সবার লক্ষ্য।’

এরপর ৮ জানুয়ারি মুজিবকে পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। সেখান থেকে তিনি লন্ডনে পৌঁছেন। লন্ডনেই তিনি পাকিস্তানের পরাজয়ের খবর শোনেন। লন্ডন থেকে ১০ জানুয়ারি মুজিবুর রহমান দিল্লিতে আসেন। দিল্লিতে ভারতের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকে সাদর অভ্যর্থনা জানান। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে স্বাধীন বাংলাদেশ আজ নানা ক্ষেত্রে দ্রুত এগিয়ে চলেছে।

লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক [ভারত]।

সর্বশেষ খবর