মারমা বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। মারমা জনগণের অধিকাংশই বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে বসবাস করে। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে মারমা জনসংখ্যা ১ লাখ ৫৭ হাজার ৩০১। বর্তমানে এ সংখ্যা প্রায় ২ লাখ। মারমারা মঙ্গোলয়েড বর্ণগোষ্ঠীর অন্তর্গত। তাঁদের নিজস্ব ভাষা রয়েছে। মারমাদের ঘর বাঁশ, পাহাড়ি ছন ও ঘাসের তৈরি। এসব ঘর মূলত বাঁশ দিয়ে উঁচু মাচাংয়ের ওপর তৈরি করা হয়। ঘরের প্রতিটি কক্ষই একাধারে শয়নকক্ষ ও গুদামঘর। মাচাংরে নিচের জায়গাটি গবাদি পশু রাখা, জ্বালানি কাঠ সংরক্ষণ অথবা তাঁত স্থাপনের মতো নানাবিধ কাজে ব্যবহৃত হয়। কিছু কিছু ঘর মাটির তৈরি এবং মাচাংবিহীন। ভাত ও সেদ্ধ করা শাকসবজি মারমাদের প্রধান খাদ্য। মারমারা বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। ধর্মীয় উৎসব হিসেবে তাঁরা বুদ্ধপূর্ণিমা, আষাঢ়ী পূর্ণিমা বা প্রবারণা পূর্ণিমা পালন করেন। প্রবারণা উৎসবের রাতে আকাশে রঙিন ফানুশ ওড়ানো হয়। রথযাত্রা হয়। মারমাদের সবচেয়ে বড় উৎসব সাংগ্রাই। এদিন তরুণ-তরুণীরা ‘মৈত্রী পানি’ ছিটিয়ে একে অন্যের মঙ্গল কামনা করে। পাড়ায় পাড়ায় উৎসবের আমেজে পিঠা তৈরির ধুম পড়ে। বুদ্ধপূজা করা হয়। করা হয় বয়স্ক-পূজাও। বয়স্ক-পূজার মধ্য দিয়ে সমাজের প্রবীণ ব্যক্তিদের সম্মান জানানো হয়। মারমাদের প্রধান পেশা কৃষি। জুম চাষ তাঁদের জীবিকা নির্বাহের প্রাথমিক কৃষিজ প্রয়াস। অবশ্য এর পাশাপাশি তাঁরা পাহাড়ি অরণ্য থেকে গাছের পাতা, মূল ও কন্দ সংগ্রহের মাধ্যমে খাদ্যের চাহিদা পূরণ করেন। মারমাদের মধ্যে বসতবাড়ি-সংলগ্ন ভিটায় ক্ষুদ্র আকৃতির বাগানচাষও দেখা যায়। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মধ্যে রয়েছে ঝুড়ি ও চোলাই মদ তৈরি। বস্ত্র তেরি মারমা মেয়েদের মধ্যে খুবই সাধারণ কর্মকান্ড। মারমা সম্প্রদায়ের মধ্যে তিন স্তরবিশিষ্ট প্রথাগত রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা বিদ্যমান। গ্রাম পর্যায়ের প্রশাসনিক প্রধান হলেন একজন কারবারি। মৌজা পর্যায়ের প্রধান একজন হেডম্যান এবং সার্কেল প্রধান হলেন রাজা। গ্রামের কারবারি, মৌজার হেডম্যান ও সার্কেলপ্রধানের মূল দায়দায়িত্ব হলো জুম ট্যাক্স সংগ্রহ করা। এর পাশাপাশি তাঁদের ওপর নিজ নিজ প্রশাসনিক স্তরে বিরোধ নিষ্পত্তি, রায় প্রদান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাসহ বিবিধ সামাজিক-সাংস্কৃতিক দায়দায়িত্ব অর্পিত। মারমারা তাঁদের সামাজিক নেতাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। সেহেতু মারমাদের মধ্যে যে-কোনো বিরোধ স্থানীয় পর্যায়ে শান্তিপূর্ণভাবেই নিষ্পত্তি হয়।
মোহাম্মদ সোহেল