বিগত সরকারের আমলে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সীমাহীন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন।
এখানে দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, হাজার হাজার কোটি টাকার মশার ওষুধ এবং বিপুল ‘ম্যান-আওয়ার’ খরচ করে সিটি করপোরেশনগুলো ও পৌর কর্তৃপক্ষগুলো আমলাতান্ত্রিক নির্বুদ্ধিতার কারণে ডেঙ্গুজ্বর (প্রচলিত কথায় ‘ডেঙ্গুজ্বর’) প্রতিরোধে কোনো সাফল্যই পাচ্ছে না, তাতে নাগরিক জীবনে ভয়ংকর সংকট আরও বেশি ঘনীভূত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই রোগে শিশু-কিশোর বয়স্কদের প্রাণহানির ফলে ঘরে ঘরে শোকের মাতম আর থামছে না, আর ডেঙ্গুজ্বর আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা সমস্যার আতঙ্ক সবাইকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ছে। আমাদের কম-নাগরিকেরই হয়তো জানা আছে- পঞ্চাশ দশকের শুরুতে ঢাকা শহরে হঠাৎ ডেঙ্গুজ¦র (এখন চালু-শব্দ-‘ডেঙ্গুজ¦র’ আর ‘চিকুনগুনিয়া’) বেড়ে গিয়ে নাগরিক-জীবনে দুঃসহ সংকট সৃষ্টি করেছিল। (অবশ্য তখনকার সময়ে ডেঙ্গুআক্রান্ত মানুষের প্রাণহানি হার ছিল এখনকার তুলনায় একেবারেই নগণ্য। তবে দায়িত্ববান ও মানবিক ব্যক্তিত্ব প্রাদেশিক স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুুরী ছিলেন-কিংবদন্তিতুল্য দেশপ্রেমিক-রাজনীতিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, দক্ষ মন্ত্রী। তিনি তাঁর দায় সম্পর্কে অতিমাত্রায় সচেতন ছিলেন, নিজের ব্যক্তিগত জীবনের আরাম-আয়েশ ধসিয়ে দিয়ে এই সংকট সমাধানে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তখন ডেঙ্গুজ্বরের ভাইরাসবাহী এডিস মশা জন্মাত প্রধানত রমনা পার্কের বয়স্ক-পুরনো গাছগুলোর দেহের খোঁড়লে-বৃষ্টির পানি ওইসব খোঁড়লে জমে থাকত এবং তার ভিতরে এডিস মশা জন্মাত, সেই এডিস মশা ডেঙ্গু বা ডেঙ্গু রোগের জীবাণুবাহী হলে এবং কোনো মানুষকে কামড়ালে (মানে মানবদেহে হুল ফোটালে) সেই লোকটি ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হতো। তখনকার দিনে ‘এখনকার তথাকথিত আধুনিক নাগরিকদের মতো দায়িত্বজ্ঞানহীনতা’ একটু কমই ছিল। তাই তারা নানা রকমের পাত্র (বা বাড়ি-নির্মাণের জন্য তৈরি-করা ছোট-চৌবাচ্চা) যাতে পানি জমে এডিস মশার জন্মস্থল তৈরি হতে পারে সে সব নষ্টামি করতেন না বললেই চলে। এসব নষ্ট-উপাদানের উৎপাত তেমন একটা ছিল না, (অথবা থেকে থাকলেও তা স্বাস্থ্য-বিশেষজ্ঞদের স্টাডির আওতায় বিবেচনায় আসেনি), স্বাস্থ্য বিভাগের কর্তা ও চিকিৎসা-বিশেষজ্ঞদের অধ্যয়নে প্রমাণ মেলে-সেই পঞ্চাশ দশকে ‘একমাত্র বয়সি-গাছের দেহের খোঁড়লে ওই এডিস মশা জন্মাত।’ স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরী নিজে প্রতিদিন রমনা পার্কে গিয়ে তাঁর কর্মীদের নিয়ে গাছের খোঁড়ল ‘সিমেন্ট-ইত্যাদি-ম্যাটেরিয়ালস’ দিয়ে ভরাট করে করে, এডিস মশার প্রজননস্থল নির্মূল করার ব্যবস্থা করতেন এবং প্রতিদিন সেই ‘খোঁড়ল’ মারার বিস্তারিত রিপোর্ট প্রাদেশিক আইনসভায় গিয়ে প্রকাশ করতেন-একবারে পাক্কা জবাবদিহি। দেখা গেল, মন্ত্রী মহোদয়ের সেই কর্মপ্রচেষ্টা সফল প্রমাণিত হলো; ডেঙ্গুজ্বরের আতঙ্ক নাগরিক-জীবন থেকে দূরীভূত হয়েছিল। সেই ডেঙ্গুজ্বর ফিরে এসেছে প্রায় পঁচিশ-তিরিশ বছর ধরে-এই নগরীতে এবং সারা দেশে; এই রোগটি প্রতি বছরই বেড়ে চলেছে, তাতে আক্রান্ত লোকজনের প্রাণহানিও দিন দিন বেড়েছে। আর এই অসুখের দুর্ভোগ আর বিপুল চিকিৎসা-ব্যয় (বিশেষভাবে হেমোরেজিক ডেঙ্গু রোগীদের ক্ষেত্রে রক্তের বিশেষ ব্যবস্থা করতে) আক্রান্ত রোগী ও তাদের পরিবার-পরিজনকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ছে, নগর-জীবনে এক মহাসংকট নিয়ে এসেছে। চলতি সময়কালে প্রায় এক বছরকালে ডেঙ্গুজ্বরে সতেরো শোর বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা গত বছরে সারা দেশে সোয়া তিন লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এটা ডেঙ্গুজ্বর আক্রান্ত রোগীর হাসপাতাল-ভর্তির সংখ্যা, প্রকৃত আক্রান্ত রোগী হয়তো অনেক বেশি। এর পেছনের কারণ হলো-এডিস মশার প্রজননস্থল বেড়ে চলেছে-নাগরিক দায়িত্বজ্ঞানহীনতায়।
এখন মিডিয়া প্রচারে সবারই জানা যে, এক চা-চামচ পানি কোনো পরিত্যক্ত পাত্রে বা কমোড বা ল্যাট্রিন প্যানে, বাড়ির নিচতলা বা ছাদের ফ্লোরে, বাড়ি-নির্মাণের জন্য তৈরি-করা চৌবাচ্চা, গাড়ির টায়ার বা টিউবে, ডাবের খোসা, তরমুজের খোসা, পরিত্যক্ত গাড়ির স্টিল-দেহ, ফুল-গাছ বা পাতাবাহার বা অন্য-গাছ লাগানোর মাটির বা প্লাস্টিকের টবে, স্টিল-বা অ্যালুমিনিয়াম-ড্রামে, পরিত্যক্ত সুইমিং পুলে, পরিত্যক্ত প্লাস্টিক বা কাপড়ের ব্যাগে, মোটকথা, যে কোনো পরিত্যক্ত পাত্র, এমনকী গাছের দেহের খোঁড়ল বা বাঁশের দেহের খোঁড়ল ইত্যাদি, যে কোনো মোটা-কাগজ বা প্লাস্টিক পাত্র-পানি খাওয়া বা চায়ের পরিত্যক্ত পাত্র যেখানেই এক চা-চামচ বা ততধিক পরিমাণ পানি ধারণ করা যেতে পারে, সে-পাত্রেই এডিস মশা জন্মাতে পারে-তিন-চার দিন এসব পরিত্যক্ত পাত্র টলটলে পানি ভর্তি থাকলেই। অবশ্য সাম্প্রতিককালে বাড়ি ও রাস্তা সংলগ্ন পানিবাহী ড্রেনের ময়লা-পানিতেও এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। মশা নিধনে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। প্রস্তাবনাটি-১. বিদ্যালয়গুলোর দশম শ্রেণির ছাত্র, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এইচএসসি ও ডিগ্রি ক্লাসের শিক্ষার্থীদের স্বেচ্ছাসেবক টিমের সদস্য করতে হবে। শিক্ষকরা একশজনের একেকটি টিমের নেতৃত্ব দেবেন। প্রতিজন স্বেচ্ছাসেবক প্রতিদিন পাঁচ ঘণ্টা করে সপ্তাহে পাঁচ দিন এই ডিউটি পালন করবেন। তারা প্রতিদিন নগরী ও পৌর এলাকার প্রতিটি বাড়িঘরসহ সব প্রতিষ্ঠানের ভবনগুলোর আঙিনা পরিচ্ছন্ন করবেন গণহারে, তাদের পেছনে পৌর কর্মচারী ও ম্যাজিস্ট্রেটরা থাকবেন সহযোগী-হিসেবে। এই কার্যক্রম শক্তভাবে পরিচালনা করা গেলে কোথাও এডিস মশা জন্মাতে পারবে না।
লেখক : সাবেক কলেজ শিক্ষক