‘নূরলদীনের বাড়ি রংপুরে যে ছিল/ রংপুরে নূরলদীন একদিন ডাক দিয়েছিল/ ১১৮৯ সনে। / আবার বাংলার বুঝি পড়ে যায় মনে,/ নূরুলদীনের কথা মনে পড়ে যায় / যখন শকুন নেমে আসে এই সোনার বাংলায়;/নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায় / যখন আমার দেশ ছেয়ে যায় দালালেরই আলখাল্লায়; /নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়/ যখন আমার স্বপ্ন লুট হয়ে যায়;/ নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়/ যখন আমার কণ্ঠ বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে যায়; /নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায় যখন আমারই দেশে এ আমার দেহ থেকে রক্ত ঝরে যায় ইতিহাসে, প্রতিটি পৃষ্ঠায়।’
বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের (কুড়িগ্রাম) সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি ‘নূরলদীনের সারা জীবন’ কাব্য নাট্যের প্রস্তাবনায় এভাবেই পরিচয় করিয়েছিলেন রংপুর অঞ্চলের সিংহপুরুষ নূরলদীনকে। বাংলা ১১৮৯ সনে অর্থাৎ ইংরেজি ১৭৮২ সালে বর্তমান রংপুরের ২৪ কিলোমিটার দক্ষিণে মিঠাপুর উপজেলার ফুলচৌকি গ্রামে বসবাস করতেন নূরলদীন নামের এক কৃষক।
পলাশীর যুদ্ধ-পরবর্তী এ সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও কোম্পানির মনোনীত জমিদারদের পেটুয়া বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিল সাধারণ জনগণ। তখন রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চলের জমিদার ছিল দেবী সিংহ। খাজনা আদায়ের জন্য দেবী সিংহ ও তাঁর পেটুয়া বাহিনীর দ্বারা কৃষকদের ওপর চালানো বর্বরতার বিরুদ্ধে এক অনবদ্য আন্দোলন, সংগ্রাম ও যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন রংপুরের এই নূরলদীন। ইতিহাস মতে, ১৭৬২ থেকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অর্থাৎ ১৭৮৩ সালে যুদ্ধক্ষেত্রে আহত হওয়ার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি লড়াই চালিয়ে গেছেন শোষণ ও নিষ্ঠুর শাসকের বিরুদ্ধে। তিনি একাই পথ দেখিয়ে গেছেন হাজারো কৃষককে, যে পথ অনুসরণ করে পরবর্তীতে বহুবিধ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ঘটেছে এবং শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশদের এ দেশ ছেড়ে যেতে হয়েছে।
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার ঠিক দক্ষিণের উপজেলাটি হলো পীরগঞ্জ। এই পীরগঞ্জের মদনখালী ইউনিয়নের বাবনপুর গ্রামে জন্মেছিলেন আবু সাঈদ নামের এক সাধারণ কৃষক সন্তান। বাবা নিতান্ত দিনমজুর ছিলেন বিধায় একমাত্র আবু সাঈদ ছাড়া বাকি আট সন্তানের কেউই তেমন লেখাপড়া করতে পারেননি। অত্যন্ত মেধাবী আবু সাঈদ তার অদম্য চেষ্টায় একে একে বিভিন্ন পর্যায়ে ভালো ফলাফল ও শিক্ষাবৃত্তি লাভ করে ভর্তি হন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে।
দেশের এমন শতসহস্র আবু সাঈদ লক্ষ করেন, সেই ১৭৮২ সালে নূরলদীনের দেখা শকুনেরা যেন আবার নেমেছিল এই সোনার বাংলায়। তারা দেখতে পান এ যুগের দেবী সিংহ দল তথা কিছু দালাল আলখেল্লা পরে দেশময় ছড়িয়ে পড়েছে। আবু সাঈদদের একটি সরকারি চাকরি পাওয়ার স্বপ্ন কীভাবে যেন লুট হয়ে গেছে। এসব নিয়ে যখন তারা কথা বলতে যান, তখনই তপ্ত বুলেট আর টিয়ারগ্যাস তাদের কণ্ঠ বাজেয়াপ্ত করে দিতে চায়। তারপরও আন্দোলন করতে গেলে রক্ত ঝরে ইতিহাসের পাতায় পাতায়।
১৭৮২ সালে দীর্ঘদেহী নূরলদীন কৃষকদের ডাক দিয়েছিলেন। ভরাট কণ্ঠে রংপুরের স্থানীয় ভাষায় বলেছিলেন, ‘জাগো বাহে- কোনঠে সবায়’ (জেগে উঠ- কোথায় সবাই?)। আর ২০২৪ সালে ভয়ংকর ও উদ্ধত পুলিশের গুলির সামনে সিনা টান করে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন আবু সাঈদ। সে যুগের নূরলদীনের মতো তেমন কিছু বলতে পারেননি এ যুগের আবু সাঈদ। ব্রিটিশবিরোধী যুদ্ধে শত্রুর চরেরা ঢুকে পড়েছিল নূরলদীনের বাহিনীতে। তাদেরই হাতে মৃত্যু ঘটেছিল নূরলদীনের। আর একালে এসে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে পুলিশের হাতে গুলিবিদ্ধ হন আবু সাঈদ। তিনি নূরলদীনের মতো কিছু বলে যাননি সত্য, তবে অসংখ্য পুলিশের বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়িয়ে বুক উঁচু করে ও দুই হাত প্রশস্ত করে যে দেহ ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছিলেন, সেই প্রতিবাদের ভাষা ঠিকই বুঝে গিয়েছিল সারা দেশের কোটি কোটি তরুণ, কিশোর, যুবক-যুবতী তথা আমজনতা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেই প্রতিবাদের দৃশ্য এবং প্রথমে একটি গুলিবিদ্ধ হয়ে আবারও আবু সাঈদের ঘুরে দাঁড়ানো এবং প্রতিবাদ করার দৃশ্য দেখে ফুঁসে উঠেছিল পুরো দেশ। এ ঘটনার পর মনে হয়েছিল বুলেট যেন শুধু আবু সাঈদের দেহেই প্রবেশ করেনি, কোটি কোটি জনতার, বিশেষত আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রীদের বুকে বারুদ হয়ে প্রবেশ করে ভয়ংকর রূপে বিস্ফোরিত হচ্ছিল। আবু সাঈদের সেই না বলা কথা, নিঃশব্দ প্রতিবাদ যেন যুদ্ধে যোগ দেওয়ার চূড়ান্ত দামামা বাজিয়ে ছিল, যে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে লজ্জাজনক বিদায় ঘটে এক লৌহ মানবীর; তথা মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই একটি অতি প্রাচীন রাজনৈতিক দলের দীর্ঘ প্রায় ১৫ বছরের শাসনের বাধ্যতামূলক অবসান ঘটে।
মাত্র কিছুদিন আগেও যে দল ও সরকারকে এতটুকু টলানো যাবে না বলে মনে হয়েছিল, আজ সে দলের সব কর্মী ও সরকারের মন্ত্রীরা গা-ঢাকা দিয়েছেন। বাস্তবে কী কারণে এমনটা ঘটল- এ নিয়ে ইতোমধ্যে বেশ কিছু বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়েছে। এখনো এ নিয়ে লেখা হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে এ নিয়ে হয়তো অনেক গবেষণাও হবে। তবে কোনো কারণ বিশ্লেষণে না গিয়ে এ বিষয়ে শুধু কয়েকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতে চাই।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের বিশাল সম্পদ নিয়ে দেশজুড়ে তখন আলোচনা-সমালোচনার সুনামি বইছিল।
এ সময় একটি অনুষ্ঠানে একজন অতি প্রবীণ সম্পাদক তাঁর বক্তৃতায় উল্লেখ করেছিলেন, বেনজীর আহমেদের দুর্নীতির অনেক তথ্যই আমরা জানতাম, কিন্তু লিখতে পারিনি। অতি সম্প্রতি একজন উপদেষ্টা সাংবাদিকদের তাৎক্ষণিক এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, আপনারা অর্থাৎ এই মিডিয়াই পুলিশকে নষ্ট করেছেন।
ইউটিউবে প্রাপ্ত একটি কনটেন্টে দেখা যায় একজন ব্যবসায়ী নেতা বলছেন, আপনি হয় আমার পক্ষে- না হয় আমার বিপক্ষে, মাঝামাঝি কিছু নেই। এটাই ছিল সরকারের ফিলোসফি। বিসিআইসি-বঙ্গবন্ধু ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স সেন্টারে যে ব্যবসায়ী সম্মেলন হয়েছিল, তারা সরকারের পাশে এসেছে ঘাড়ে এক মাথা থাকার কারণে। তার প্রশ্ন সরকার ডাকলে আপনি আপত্তি করতে পারবেন? আবার তারই উত্তর ‘আপনার এক ঘাড়ে যদি দুই মাথা থাকে, আপনি পারবেন। আমাদের তো দুই মাথা ছিল না! আমাদের এক মাথাই ছিল। ইনভাইট করা হইছে অ্যান্ড আই কুড নট রিফুউইজ ইট (আমাকে ডাকা হয়েছে, আমি এটা না করতে পারিনি)।’
তবে আশার কথা, স্রোতে গা না ভাসিয়েও বহু ব্যবসায়ী ভালোই ব্যবসা করেছেন বিগত দিনে। সফরসঙ্গী না হয়ে বা ঘন ঘন আমন্ত্রণে না গিয়েও সফল ব্যবসায়ীর সংখ্যা কম নয়। আবার সম্মেলনে গিয়েও ন্যায্য কথা বলেছেন, তাও দেখেছি অবাক বিস্ময়ে। বিশেষত অপেক্ষকৃত কম বয়সি এক ব্যবসায়ী তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলতে পেরেছেন, ব্যবসার স্বার্থে ‘আপনি ইন্টারনেট চালু করে দেন।’ এ সংক্রান্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে তিনি প্রশ্ন করেন, ‘আমরা এটা পারব না? আমরা এটা (ইন্টারনেট চালু) পারব।’ এমন ঘটনা আমাদের প্রত্যাশা বাড়ায়।
বড় আশা জাগানিয়া এ যুগের জেনারেশন জেড (Gen Z)। এক পাসপোর্ট অফিসের জনৈক সরকারি অফিসার অবৈধ টাকা নিতে গিয়ে সম্প্রতি ছাত্রদের হাতে সরেজমিনে ধরা পড়েন। ইউটিউবে দেখা যায়, তিনি প্রকাশ্যে বলছেন ‘প্রয়োজনে রিকশা চালায়ে খাব- তাও আর অন্যায়ভাবে টাকা চাইব না’। জেনারেশন জেড জেগেছে। এক মাথা নিয়েই তারা জেগেছে। আসুন সর্বস্তরের সবাই ঘাড়ের ওপর মাথা না গুনে জেগে উঠি। সুকান্তের দুর্মর কবিতার মতো করে বলি-
“-হঠাৎ নিরীহ মাটিতে কখন
জন্ম নিয়েছে সচেতনতার দান,
গত আকালের মৃত্যুকে মুছে
আবার এসেছে বাংলাদেশের প্রাণ।
‘হয় দান নয় প্রাণ’ এ শব্দে
সারা দেশ দিশাহারা,
একবার মরে ভুলে গেছে আজ
মৃত্যুর ভয় তারা।
সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী
অবাক তাকিয়ে রয় ঃ
জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার
তবু মাথা নোয়াবার নয়।
এবার লোকের ঘরে ঘরে যাবে
সোনালী নয়কো, রক্তে রঙিন ধান,
দেখবে সকলে সেখানে জ্বলছে
দাউ দাউ করে বাংলাদেশের প্রাণ।।’’
লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
ইমেইল : [email protected]