দৈনন্দিন ব্যবহারের জিনিসপত্রে একদিন ম্যাজিকের মতো পরিবর্তন এনে দিয়েছিল প্লাস্টিক। জিনিসের দাম কমেছিল চট করে। কম দামের জেরে প্লাস্টিকের ব্যবহার বেড়েছে হু হু করে। কী না হয় প্লাস্টিক দিয়ে। আর এখন ওই প্লাস্টিক গিলে খেতে চাইছে আমাদের। পরিবেশ বিষিয়ে এখন প্লাস্টিক মেরে চলেছে পানি-স্থল-অন্তরীক্ষের প্রাণী। প্লাস্টিক আজ এক যন্ত্রণার নাম। প্লাস্টিক দূষণে সমুদ্রের পানি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সামুদ্রিক প্লাস্টিকের ৮০ শতাংশই আসে স্থলভাগ থেকে। আর বাকি ২০ শতাংশ আসে জাহাজ ও মাছ ধরা ট্রলার বা লঞ্চ থেকে ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক বর্জ্য দ্বারা। সারা বিশ্বে অন্তত ২৬৭ প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণী প্লাস্টিক দূষণের শিকার হয়েছে। সমস্ত সামুদ্রিক কচ্ছপ প্রজাতির ৮৬ শতাংশ কোনো না কোনোভাবে আক্রান্ত। সামুদ্রিক পাখিদের ৪৪ শতাংশ প্রজাতি এবং সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ৪৩ শতাংশ প্রজাতি প্লাস্টিক দূষণে ধুঁকছে। সামুদ্রিক কচ্ছপদের অন্যতম প্রিয় খাদ্য জেলিফিশ। ওরা জেলিফিশ মনে করে পলিথিন ব্যাগ খেয়ে ফেলছে। তিমি ও সিলেরাও খাচ্ছে। আর এর ফলে তাদের খাদ্যনালিতে প্লাস্টিক জড়িয়ে গিয়ে তারা মারা পড়ছে। পরিবেশবিদদের হিসাব, গড়ে প্রতি বছর ৪ লাখ সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী মারা পড়ছে প্লাস্টিক দূষণের কারণে।
সামুদ্রিক পাখিরা নিজেরা তো খাবার ভেবে প্লাস্টিক খাচ্ছে, তাদের বাচ্চাদেরও প্লাস্টিক খাইয়ে দিচ্ছে। এশিয়া ও উত্তর আমেরিকার মাঝে অবস্থিত হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের উত্তরে বিশালাকার সামুদ্রিক পাখি লেশান অ্যালবাট্রসদের বাস। এরা তাদের বাচ্চাদের ভুল করে খাবার ভেবে প্লাস্টিক খাওয়াচ্ছে। পরীক্ষা করে ৯৮ শতাংশ বাচ্চার পেটে প্লাস্টিক পাওয়া গেছে। দেখা গেছে, এদের খাদ্যনালিতে লাল, গোলাপি, নীল ও খয়েরি রঙের প্লাস্টিক বেশি রয়েছে। কিছুদিন আগে করা এক সমীক্ষাতেও জানা যায়, আর এক সামুদ্রিক পাখি সি-গালদের পেটে গড়ে ৩০টি করে প্লাস্টিক উপস্থিত। এর ফলে খাদ্যনালি ও শ্বাসনালি অবরুদ্ধ হয়ে অসংখ্য অ্যালবাট্রস ও সি-গাল মারা পড়ছে। এ ছাড়া প্লাস্টিক থেকে উৎপন্ন পলিক্লোরিনেটেড বাইফিনাইনস (পিসিবি) সমুদ্রের উপরিতলে সঞ্চিত হয় এবং তা থেকে সামুদ্রিক পাখিদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, প্রজনন ক্ষমতা ও হরমোনের ভারসাম্য বিঘ্নিত হচ্ছে। প্লাস্টিকের কারণে লেশান অ্যালবাট্রস ও সি-গালসহ সমস্ত সামুদ্রিক পাখি আজ মারাত্মক বিপন্ন।
পরিবেশবিদদের মতে, পৃথিবীর প্রধান পাঁচটি মহাসাগরের কোথাও এক বর্গকিমি এলাকা খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে প্লাস্টিক নেই। এ প্লাস্টিক বিয়োজিত হয়ে সমুদ্রের জলে বিসফেনলে, পলিস্টাইরিন, ডাই ইথাইল হেক্সাইল থ্যালেট ইত্যাদি বিষাক্ত রাসায়নিক সংযোজিত হচ্ছে। এসব রাসায়নিক খাদ্য শৃঙ্খলের মাধ্যমে মানুষের দেহেও পৌঁছে যাচ্ছে। তার ফলে ক্যান্সার, বন্ধ্যত্ব, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস, জন্মগত ত্রুটি ইত্যাদি হওয়ার সম্ভাবনাও বাড়ছে।
আগেই বলা হয়েছে, ৫ মিলিমিটারের চেয়ে কম সাইজের প্লাস্টিক হলো মাইক্রোপ্লাস্টিক। কিন্তু এই মাইক্রোপ্লাস্টিকও আবার ভেঙে গিয়ে ন্যানোপার্টিকলে পরিণত হয়, যার আকার ০.১ মাইক্রোমিটারেরও কম। এই ন্যানো প্লাস্টিক কণা মিশছে মাটিতে। তারপর চুইয়ে চুইয়ে চলে যাচ্ছে ভূগর্ভের পানিতে। অনেকেই জানি না, আমরা সিন্থেটিক জামা-কাপড় প্রতিবার সাবান দিয়ে ধোয়ার পর যে পানি ফেলে দিই তাতে লাখ লাখ ন্যানোপ্লাস্টিক কণা থাকে। ওয়াটার ওয়ার্ড নামে এক সংস্থার সমীক্ষায় বলা হয়েছে, প্রতিবার ওয়াশিং মেশিন থেকে নির্গত পানিতে প্রায় ৭ লাখ ন্যানো প্লাস্টিক কণা থাকে। বিভিন্ন কসমেটিকে থাকে এই কণা। অ্যাস্ট্রোটার্ফ বা কৃত্রিম ঘাসের মাঠ থেকেও বিপুল পরিমাণে তৈরি হয় এই ন্যানোপ্লাস্টিক। মাটিতে মাইক্রোপ্লাস্টিক ব্লু ন্যানোপ্লাস্টিক মিশে থাকলে মাটিতে বসবাসকারী প্রাণীদের মারাত্মক সমস্যা হয়। যেমন কেঁচোর পক্ষে এমন মাটিতে বসবাস করা খুব মুশকিল। এর ফলে মাটির উর্বরতা হ্রাস পায়। এদিকে ভূগর্ভস্থ পানিতে ন্যানো প্লাস্টিক কণা মিশে থাকার কারণে পানীয়জল হয়ে পড়ে বিষাক্ত। সেই পানি পান করলে ত্বকের রোগ, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা হতে পারে। প্লাস্টিকের ভয়াবহ বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার ব্যবস্থা করতেই হবে। জীবনযাত্রার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা প্লাস্টিকের নাগপাশ থেকে মুক্তি লাভ করতে হবে আমাদেরই স্বার্থে।
লেখক : প্রাবন্ধিক