ইসলাম এমন এক তাৎপর্যপূর্ণ মানবিক জীবন বিধান, যেখানে বৃক্ষরোপণের মতো জাগতিক ও সামাজিক কাজেরও বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। ইবাদত বলতে আমরা অনেকে নামাজ-রোজা, জিকির-তেলাওয়াতের মতো বিশেষ আমলকে বুঝে থাকি। কিন্তু ইসলামে শুধু এগুলোই ইবাদত নয়, বরং যে কাজের ভিতরে জীবজগতের উপকার ও কল্যাণ আছে, ইসলামে সেগুলোও ইবাদত। আপাত চোখে বৃক্ষরোপণ নিছকই জাগতিক ও সামাজিক কাজ মনে হয়; কিন্তু ইসলাম বলছে, বৃক্ষরোপণ সওয়াবের কাজ। আনাস ইবনে মালেক থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) বলেছেন, কোনো মুসলিম যদি গাছ লাগায়, অতঃপর তা থেকে মানুষ বা চতুষ্পদ প্রাণী কিছু খায়, তবে তা তার জন্য সদকা হিসেবে গণ্য হবে। (বোখারি)।
এ হাদিস থেকে বোঝা যায়, বৃক্ষরোপণ এককালীন সাধারণ কোনো সওয়াবের কাজ নয়। বরং এটা সদাকায়ে জারিয়া। কারণ গাছ এবং গাছের উপকারিতা দীর্ঘস্থায়ী বিষয়। একটি গাছ লাগানোর পর দীর্ঘদিন ধরে সে অক্সিজেন, ছায়া এবং ফল দেয়। যত দিন মানুষ এ থেকে উপকৃত হবে, তত দিন রোপণকারী এর সওয়াব পেতে থাকবে। এ কারণে ফলের গাছ লাগানোকে নেকির গাছ লাগানোর সঙ্গে তুলনা করা যায়। আমরা চাইলেও কিন্তু অনেক মানুষকে খাওয়াতে পারব না। পশুপাখিদের এক বেলা খাবারের ব্যবস্থা করতে পারব না। কিন্তু একটি ফলের গাছ লাগানোর মাধ্যমে আমরা অসংখ্য মানুষ এবং পশুপাখিদের খাওয়াতে পারি এবং এর অফুরন্ত সওয়াব অর্জন করতে পারি। অনেক সময় পাখিরা আমাদের গাছের ফল খেয়ে যায়। এতে আমরা বিরক্ত হই বা মন খারাপ করি। কিন্তু এতে মন খারাপের কিছু নেই। কারণ সংরক্ষণের পরও কিছু ফল পাখিরা খেয়ে গেলে সেটাও আপনার জন্য সদকার সওয়াব হবে।
গাছ শুধু ফলই দেয় না, গাছ ছায়া এবং অক্সিজেনও দেয়। আপনি একটি গাছ লাগালেন মানে অসংখ্য মানুষের জন্য ছায়া ও অক্সিজেনের ব্যবস্থা করলেন। বৃক্ষরোপণ তাই অল্প পরিশ্রমে, অল্প খরচে বিপুল পরিমাণ সওয়াব অর্জন ও উপকার সাধনের মাধ্যম। বৃক্ষরোপণ যে সদকায়ে জারিয়া, এটা অন্য একটি হাদিস দ্বারাও সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায়। রসুল (সা.) বলেছেন, সাতটি আমলের সওয়াব মৃত্যুর পর কবরে থাকাবস্থায় বান্দার জন্য চালু থাকে। সেগুলো হলো- যে ব্যক্তি বিদ্যা শিক্ষা দিবে, নদী খনন করবে, কূপ খনন করবে, খেজুর গাছ লাগাবে, মসজিদ তৈরি করবে, পবিত্র কোরআনের উত্তরাধিকার রেখে যাবে অথবা এমন সন্তান রেখে যাবে, যে মৃত্যুর পর তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে। (শুআবুল ইমান)।
আরেকটি হাদিস থেকে বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব অনুভব করা যায়। রসুল (সা.) বলেছেন, যদি কেয়ামত এসে যায় আর তখন তোমাদের কারও হাতে একটি চারা গাছ থাকে, তবে কেয়ামত হওয়ার আগে তার পক্ষে সম্ভব হলে যেন চারাটি রোপণ করে। (বোখারি)। কেয়ামত মানে মহাবিশ্বের ধ্বংস হয়ে যাওয়া। সেদিক বিবেচনায় কেয়ামতের আগমুহূর্তে গাছ লাগানোতে পৃথিবী কিংবা মানবজাতির কোনো উপকারিতা নেই। তবু আমাদের নবীজির কাছে গাছ লাগানো এত গুরুত্বপূর্ণ কাজ, তিনি বললেন, কেয়ামত নিশ্চিত জানার পরও তোমার হাতের চারা গাছটি মাটিতে পুঁতে দাও। আবার তিনি এ নির্দেশনাটি তখন দিয়েছেন, যখন বৈশ্বিক উষ্ণতা এবং পরিবেশ বিপর্যয় আজকের দিনের মতো ভয়ংকর আকার ধারণ করেনি। তারপরও বৃক্ষরোপণের বিষয়টিকে তিনি এতটা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন, যেন হাদিসগুলো আজকের পৃথিবীর জন্যই বলেছেন। এতে বোঝা যায়, রসুল (সা.)-এর হাদিস সব সময়ের জন্য চিরপ্রাসঙ্গিক ও কল্যাণকর।
রসুল (সা.) যেমন গাছ লাগাতে উদ্বুদ্ধ করেছেন, তেমনই অকারণে গাছ কাটতেও তিনি নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি কুল গাছ কাটবে, আল্লাহ তাকে মাথা উপুড় করে জাহান্নামে ফেলবেন। (সুনানু আবি দাউদ)। ইমাম আবু দাউদ (রহ.) এই হাদিস সম্পর্কে বলেন, মরু এলাকার কুল গাছ, যার ছায়ায় পথচারী ও চতুস্পদ প্রাণী আশ্রয় নিয়ে থাকে, তা কোনো ব্যক্তি অপ্রয়োজনে ও অন্যায়ভাবে কেটে ফেললে আল্লাহ তাকে উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। এ হাদিস থেকে বোঝা যায়, যেসব গাছ মানুষের কল্যাণে ব্যবহৃত হয়, সেই গাছ অকারণে নিধন করা যাবে না। কেউ যদি অকারণে উপকারী গাছ কেটে ফেলে, পরকালে তার জন্য কঠিন শাস্তি প্রস্তুত থাকবে।
বর্ষাকাল চলছে। সারা দেশেই প্রচুর বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এটা গাছ লাগানোর আদর্শ সময়। দিন যত যাচ্ছে, পৃথিবীর উষ্ণতা তত বাড়ছে। প্রতিদিনই একটু একটু করে সবুজ হারিয়ে যাচ্ছে। সবুজায়ন ও পরিবেশ সুরক্ষার জন্য আমাদেরকে বৃক্ষরোপণে জোর দিতে হবে। এতে আমরা চার ধরনের উপকার পাব। ১. সাধারণ সওয়াব ২. সদাকায়ে জারিয়ার সওয়াব ৩. মানুষ ও পশুপাখির উপকার সাধন ৪. পরিবেশ সুরক্ষা ও সবুজায়ন। তাই আসুন, ক্রমেই বাসের অযোগ্য হয়ে ওঠা এই পৃথিবীকে সুন্দর, নির্মল ও দূষণমুক্ত রাখতে এবং আমলের খাতায় অফুরন্ত সওয়াব জমা করতে এ বর্ষায় বৃক্ষরোপণের বিশেষ কর্মসূচি হাতে নেই।
জুমার মিম্বর থেকে বয়ান
গ্রন্থনা : সাব্বির জাদিদ