স্বাধীনতা-পরবর্তী ব্যান্ড সংগীতের ইতিহাস নতুন নানা বাঁক বদলের মাধ্যমে আজকের অবস্থানে পৌঁছেছে। এ সময় দেশের ব্যান্ড সংগীত নিয়ে যে উচ্ছ্বাস ও রব শোনা যায়, তা আজ থেকে ৫০ বছর আগেও ‘অপসংস্কৃতি’ হিসেবেই পরিচিত ছিল। আর শুরু থেকেই সংগীতের এ ধারাটি সমাজের ‘এলিট’ ও ‘উচ্চ মধ্যবিত্ত’ শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই ধারার পরিবর্তন ঘটে এবং এ শ্রেণির ধারণা থেকে বের হয়ে তরুণ সমাজের মাঝে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। আজকে ব্যান্ড সংগীত যে অবস্থানে তার জন্য পাঁচ কিংবদন্তি পপ শিল্পীর নাম উল্লেখযোগ্য। যাঁদের ‘বাংলা ব্যান্ডের পাঁচ পীর’ নামে ডাকা হতো। এই পাঁচ পীরের প্রথম ও প্রধান পীর ছিলেন পপগুরু আজম খান। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে আজম খান তাঁর বন্ধুদের নিয়ে ‘উচ্চারণ’ ব্যান্ড গঠন করেন। ব্যান্ড ‘উচ্চারণ’ ১৯৭২ সালেই বিটিভিতে এক কনসার্টে ‘এত সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না রে’ ও ‘চার কালেমা সাক্ষী দেবে’ গান দুটি পরিবেশন করে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। সেই ধারাবাহিকতায়ই পরবর্তী সময় স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন করে ব্যান্ড সংগীতের ধারণা মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সাহস তৈরি করতে পেরেছিল বলে মনে করা হয়। আজম খানের দলে পরে যুক্ত হন ফিরোজ সাঁই, ফকির আলমগীর, ফেরদৌস ওয়াহিদ ও পিলু মমতাজ। আজম খানের সেই পপসংগীত থেকেই একটু একটু করে হয়েছে ব্যান্ড সংগীত। এখন দেশে অন্তত ৩০টি ব্যান্ড দল সক্রিয়। ‘উচ্চারণ’-এর পর ‘মাইলস’ আর ‘সোলস’ নামের দুটি দল অনেক দিন রাজত্ব করে। শাফিন আহমেদ, নিলয় দাশ আর তপন চৌধুরী বাংলা ব্যান্ডে যোগ করেন নতুন এক ধারা। এরপর আরও যোগ হয় ফিডব্যাক, ফিলিংস, নগর বাউল, রেনেসাঁর মতো জনপ্রিয় সব ব্যান্ড দল। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় চট্টগ্রামের কিছু গানপাগল তরুণ সাজিদ উল আলম (গিটার), লুলু (গিটার) নেওয়াজ (পারকিউশন), রনি বড়ুয়া (ড্রামস) ও তাজুল (ভোকাল) মিলে বিদেশি গানের দলের অনুকরণে গানের একটি দল গঠন করে যার নাম দেয় ‘সোলস’। ১৯৭২-এর শেষের দিকে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য লুলু ব্যান্ড ত্যাগ করার আগে ‘নকীব খান’ দলে যোগ দেন, যিনি পরবর্তীতে ‘রেনেসাঁ’ ব্যান্ড প্রতিষ্ঠাতা ও ভোকালিস্ট। নকীবের
পথ অনুসরণ করে এরপর ব্যান্ডে যোগ দেন পীলু খান ও তপন চৌধুরী। শুরু হয় সব গানপাগল তরুণের একসঙ্গে স্বপ্ন বোনা আর গান বোনা। ১৯৭৭-এ ব্যান্ডে যোগ দেন নাসিম আলী খান এবং ১৯৭৮-এ আইয়ুব বাচ্চু। শুরু হয় বাংলার সর্বকালের সেরা একটি ব্যান্ড দলের যাত্রা। সে সময় আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন ব্যান্ডের একজন গিটারিস্ট, ভোকাল, গীতিকার ও সুরকার। ১৯৭৯ সালের মাঝামাঝি সময় যোগ দেন বাংলা আধুনিক গানের আরেক দিকপাল কুমার বিশ্বজিৎ। নাম দেখলেই বোঝা যায়, কতটা দুর্দান্ত ছিল তখনকার ‘সোলস’। এমন সেরা লাইনআপ বাংলাব্যান্ড ইতিহাসে দ্বিতীয় আর কারও হয়নি। ব্যান্ড সংগীতের লিজেন্ড আইয়ুব বাচ্চুর ‘এলআরবি’, জেমসের ‘নগর বাউল’, হামিন-শাফিনের ‘মাইলস’, আশিকুজ্জামান টুলু-হাসানের ‘আর্ক’, বিপ্লবের ‘প্রমিথিউজ’, টিপুর ‘অবসকিউর’, খালিদের ‘চাইম’, ফজলের ‘নোভা’, মেজবাহর ‘ডিফারেন্ট টাচ’, চন্দনের ‘উইনিং’, সঞ্জয়ের ‘ওয়ারফেইজ’, পার্থ বড়ুয়ার ‘সোলস’, মাকসুদের ‘ফিডব্যাক’ বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতকে নতুন উচ্চতা দিয়েছে। তবে জনপ্রিয় শিল্পীদের নিয়ে মিক্সড গানের অ্যালবাম বের করার ধারণার জন্য ধন্যবাদ প্রাপ্তির তালিকায় ‘টুগেদার’ ব্যান্ডের আলী আফজাল নিকোলাস। এরপর প্রিন্স মাহমুদের হাতে অজস্র মিক্সড অ্যালবাম তৈরি হয়েছে। তবে একই সঙ্গে আইওলাইটস, ওয়েভস, লেসন ওয়ান, পেন্টাগন, পেপার রাইম, লিজেন্ড, সুইট ভেনমসহ বেশ কিছু দল ব্যান্ড সংগীতকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কৃতিত্বের দাবিদার। বাপ্পা মজুমদার-সঞ্জীব চৌধুরীর ‘দলছুট’, মাকসুদের ‘মাকসুদ ও ঢাকা’ কিন্তু এক দিনে গড়ে ওঠেনি। অন্যদিকে একসময় সুমন ‘ওয়ারফেজ’ ছেড়ে তৈরি করলেন ব্যান্ড ‘অর্থহীন’।
আশির দশককে বিবেচনা করা হয় ব্যান্ড সংগীতের উত্থানের এক উত্তাল সময়। তখন ঢাকার অধিকাংশ তরুণের মুখে মুখে ফিরত নানারকম জনপ্রিয় ব্যান্ডের গান। সে সব গান তরুণদের নানাভাবে মাতিয়ে রাখত। যেখানে গানের বিষয়বস্তু হিসেবে প্রেম, বিরহ থেকে শুরু করে গণতন্ত্র ও সমাজের নানা অসামঞ্জস্য ছিল অন্যতম। তখন
অবশ্য সারা দেশেই সুস্থ ধারার গানের শ্রোতা ছিল। যে কোনো গান জনপ্রিয় হতো গীতিকবির সুন্দর সুন্দর লেখনীতে। সঙ্গে ছিল সুরকারের সুর ও ব্যান্ড দল ভোকালের কণ্ঠের জাদু। সে সময় একটি অ্যালবামের লাখ লাখ কপি বিক্রি হতো। নতুন অ্যালবাম রিলিজ হওয়ার পর পাড়ায় পাড়ায় হিড়িক পড়ে যেত। গান, কথা, সুর নিয়ে আলোচনা হতো। উৎসবে ব্যান্ড মিউজিক পিপাসুরা উন্মুখ হয়ে থাকত নতুন অ্যালবামের প্রতীক্ষায়। এমনও হয়েছে কাটতি বেশি হওয়ায় অ্যালবাম বিক্রি করতে গিয়ে শর্টেজ দেখা দিত। টিভির ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে ওই অ্যালবামের সবচেয়ে ভালো গানটির পরিবেশনা থাকত। পুরো দেশ একসঙ্গে শুনত সে সব মনমাতানো গান। গান ছিল লাখ লাখ শ্রোতা মনের অভিন্ন ভালো লাগা, অভিন্ন অনুভূতি, অভিন্ন উন্মাদনা। তখন একটি অ্যালবামের যেসব গান শ্রোতাপ্রিয় ছিল, এখন সেরকম জনপ্রিয় গান নেই বললেই চলে। এখনকার সময় গান শোনার প্ল্যাটফরম বদলেছে। ফিতা ক্যাসেট আর সিডি-ডিভিডি ও মেমরি কার্ডের স্থানে জায়গা করে নিয়েছে অ্যাপ ও ইউটিউবের যুগ। এখন তো দু-একটি ব্যান্ড দলের অ্যালবামের গান তো দূরের কথা, ছয়-সাতটা দীর্ঘস্থায়ী মৌলিক গান পাওয়াই দুষ্কর! তবে স্বীকার করতেই হবে, ব্যান্ড সংগীত এমনই মন্ত্রমুগ্ধতার, যা অজস্র কোলাহলে জীবনের সঙ্গে মিশে গেছে। যে কোলাহল ব্যস্ত নগরী ঘুমিয়ে পড়লে চাঁদের মৌন কোলাহলে ভরিয়ে দেয় চারপাশ। জোনাক জ্বলা প্রতিটি রাতে অপেক্ষায় থাকে দূরের কারোর জন্য। তবে পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, বাংলা ব্যান্ড মিউজিকে অবদান রেখেছেন এমন অনেক ব্যান্ড, গীতিকার, সুরকার, যন্ত্রশিল্পী, সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারের কথা একবারের জন্যও ওঠে আসেনি কোথাও। বাংলাদেশের ব্যান্ড কিংবা রক সংগীত নিয়ে খুব বেশি লেখালেখি বা গবেষণাও হয়নি। সব কিছুর পরও ব্যান্ড ভক্তদের স্বীকার করতেই হবে যে, এ দেশে এখন ব্যান্ড সংগীতের এক নতুন যুগ শুরু হয়েছে। শিরোনামহীন, ভাইকিং, দ্য ট্র্যাপ, ব্ল্যাক, শূন্য, জলের গান, ক্রিপটেইক ফেইট, চিরকুট, লালন, নেমেসিস, শহরতলি, রিকল নামের ব্যান্ডগুলো তাদের গান ও ভিন্নরকম কাজ দিয়ে নজর কেড়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।