দমে দমে জপ রে মন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, দমে দমে জপ রে মন গাউছে মাইজভান্ডার, আমার গাউছুল আজম কেবলা কাবা, এমন অসংখ্য ভান্ডারি গান এখনো মাইজভান্ডার ভক্তদের মনকে পুণ্যতার দিকে টেনে নেয়, করে বিমোহিত, পুলকিত। আমার গাউছুল আজম কেবলা কাবা মাইজভান্ডারি গান মাইজভান্ডারি ধারার অনুসারীদের গাওয়া মরমি গান। এ ধারার প্রবর্তক গাউছুল আজম হজরত মাওলানা সৈয়দ আহমদুল্লাহ মাইজভান্ডারি (রহ.) এবং গাউছুল আজম হজরত মাওলানা সৈয়দ গোলামুর রহমান মাইজভান্ডারি প্রকাশ : বাবা ভান্ডারি।
১০০ বছরেরও আগে চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি উপজেলায় এ ধারার গানের উদ্ভব হয়। এ পর্যন্ত শতাধিক ভক্ত কবি হাজারেরও বেশি গান রচনা করেন। রমেশ শীল, আবদুল জব্বার, শাহ্ মিমনগরী, আবদুল হাদি, বজলুল করিম, আবদুল গফুর হালী, মনমোহন দত্ত, মাহাবুব উল আলম প্রমুখ মাইজভান্ডারি গান রচনা করে সুনাম অর্জন করেন। মাইজভান্ডারি মরমি গানের উদ্ভব ঘটে মূলত উনিশ শতকের শেষের দিকে। ছৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারি এই অঞ্চলে মাইজভান্ডারি তরিকার প্রতিষ্ঠা করলে এই তরিকার অন্যতম অপরিহার্য অংশ হিসেবে মাইজভান্ডারি গানের উদ্ভব ঘটে।

মাইজভান্ডারি দর্শন বা তরিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, সেমা মাহফিল। আর সেমা মাহফিলের অন্যতম সহায়ক উপাদান হচ্ছে মরমি গান বা মাইজভান্ডারি সংগীত। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রায় ১০ হাজারেরও বেশি মাইজভান্ডারি গান উপমহাদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। মূলত মাইজভান্ডারি গান হচ্ছে একটি আধ্যাত্মিক সংগীত; যা স্রষ্টার প্রেমে ভক্তকুলের হƒদয়কে উদ্বেলিত করে ভাব-বিহ্বলতায় বিভোর করে দেয়। স্রষ্টার নৈকট্য হাসিলে সহায়তা করে এবং স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির যোগসূত্র স্থাপন করে। এই সংগীতের নূর ও কথা ভক্তকুলের হƒদয় মনকে অনাবিল স্বর্গীয় পবিত্রতায় ভরে দেয়। মাইজভান্ডারি দর্শনের মহান শিক্ষা হচ্ছে, মানুষের দৈনন্দিন জীবনাচরণে নিষ্প্রয়োজনীয় চিন্তা, কামনা-বাসনা থেকে মুক্ত রেখে অল্পে সন্তুষ্টির যে সুফি দর্শন মানুষকে ঝামেলা ও মানসিক চাপমুক্ত অবস্থায় মানসিক প্রশান্তিতে নির্বিলাস জীবনযাপনে অভ্যস্ত করা এবং মানুষের ব্যক্তিক, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক পারস্পরিক সম্পর্কের মূলমন্ত্র হিসেবে অবদান রাখতে সাহায্য করে উপমহাদেশের সুফি সাধনার একটি বিশেষ ধারা। এই মাইজভান্ডারি মরমি গান রচনায় মাইজভান্ডারের সাংস্কৃতিক দূত, অবিভক্ত বাংলার কবিগানের কিংবদন্তির নায়ক কবিয়াল সম্রাট রমেশ শীল এক বিশেষ অবস্থান অধিকার করে আছেন। রমেশ শীল তাঁর প্রতিটি গান রচনার শীর্ষে এর তাল সম্পর্কে নির্দেশ দিতেন। মাইজভান্ডারি গানের অন্যতম গীতিকার রমেশ শীলের জন্ম বাংলা ১২৮৪ সালের ২৬ বৈশাখ, ৯ মে ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে বোয়ালখালীর পূর্ব-গোমদণ্ডী গ্রামে। কবিয়াল হিসেবে রমেশ শীলের যশ-খ্যাতি আঞ্চলিক সীমা ছাড়িয়ে বাংলা উপমহাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। তিনি ১৯২৩ সালের (৯ মাঘ ১৩৩০ বঙ্গাব্দ) সাধক জমিদার সারদা বাবুর সঙ্গে মাইজভাণ্ডার শরিফ গমন করে কুতুবুল আকতাব হজরত গাউছুল আজম শাহ সুফি মাওলানা সৈয়দ গোলামুর রহমান বাবা ভান্ডারির সান্নিধ্যে গিয়ে কৃপা প্রাপ্ত হন। গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের মুখে, রাখালের মুখে, নৌকার মাঝির মুখে শব্দে বা গুনগুন করে যার গানটি গেয়ে সৃষ্টির প্রতি অনুরাগ হতে সাহায্য করে সে অমর গীতিকার রমেশ শীল। রমেশ শীলের গানে এমন সুরের ঝঙ্কার রয়েছে যা মানুষকে নৃত্যপ্রবণ করে তোলে। তাল, লয়, ভাব, কথা ও সুরের এক অপূর্ব সমাবেশ রয়েছে রমেশের গানে। ফলে প্রতিটি গানেই এক অপূর্ব সাবলীল গতি পরিদৃষ্ট হয়।
মাইজভান্ডারি গানের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে এই গানের রানী-খ্যাত শিল্পী কল্যাণী ঘোষ বলেন, মাইজভান্ডারি গানের অবস্থা এখনো ভালো। ক্যাসেট, অ্যালবাম, সিডি না থাকায় এখন এই গান হয়তো আগের মতো সবার কাছে পৌঁছায় না। তারপরও এর আবেদন একটুও কমেনি। তার কথায়, ‘সত্তরের দশকে আমি যখন মাইজভান্ডারি গান শুরু করি, তখন আমিই একমাত্র এই গানের মহিলা শিল্পী ছিলাম। তখন শ্রোতারা আমাকে এই গানের রানী আখ্যা দেয়।’ একটা হিন্দু মেয়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের গান গাইছে এটি একটি অসাধারণ ব্যাপার। প্রশংসার ফুলঝুরিতে ভাসতাম আমি। যদিও এর বিপরীত চিত্রও ছিল। আর তা হলো অনেকের কথায়, ‘হিন্দু মেয়ে কেন মুসলমানদের ধর্মীয় গান গাইবে। এটি হতে পারে না।’ এ কথা শুনে খুব দুঃখ লাগত। তারপরও ৭৫ ভাগ শ্রোতা আমার গান পছন্দ করত এটিই ছিল আমার সাহস ও সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। আর আমার গানের গুরু প্রয়াত আবদুল গফুর হালি আমাকে অভয় দিয়ে বলতেন, আমরা ভান্ডারি গানকে যুদ্ধ করে এ পর্যন্ত টিকিয়ে রেখেছি। তুমি নিন্দুকের কথায় এই গান ছেড়ে দিলে তো হেরে গেলে।
এটি কখনো হতে দিও না। আমি তাঁর কথা আজও অক্ষরে অক্ষরে পালন করছি। এখনো নিয়মিত মাইজভান্ডার দরবার শরিফসহ বিভিন্ন স্থানে ভান্ডারি গান করে যাচ্ছি। মাইজভান্ডারি ও আঞ্চলিক গানের গীতিকার সৈয়দ মহিউদ্দিন বলেন, আঞ্চলিক ও ভান্ডারি গান হচ্ছে চট্টগ্রামের মানুষের প্রাণের গান। দুঃখ এসব গানকে অবিকৃতভাবে ধরে রাখতে আর কেউ এখন সাধনা করে না। নতুনভাবে এসব গান রচনার তাগিদ অনুভব করে না। পুরনো গানগুলোর চর্বিত চর্বণ করে যাচ্ছে এখনকার শিল্পীরা। তাও আবার মডিফাই আর রিমিক্স করতে গিয়ে এই গানের মৌলিকত্ব নষ্ট করছে। এটি আমাদের কাম্য নয়। মহিউদ্দিনের কথায়, রমেশ শীল যুগের পর সেলিম নিজামী, আবদুর রশিদ কাওয়ালরা, ফারুক হাসান প্রমুখ যথাযথভাবে ভান্ডারি গান উপস্থাপন করতেন। তারা মারা যাওয়ার পর এখন কেবল আবদুল মান্নান কাওয়াল আর কল্যাণী ঘোষের কাছ থেকেই প্রকৃত মাইজভান্ডারি গানের প্রাপ্তি ঘটছে শ্রোতাদের। এই গানকে অনন্তকাল বাঁচিয়ে রাখতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ দরকার। এ গান সংরক্ষণ করতে আর্কাইভেরও প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন মাইজভান্ডারি গানের ভক্তরা।
 
                         
                                     
                                                             
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        