‘পেয়ার কিয়াতো ডরনা কেয়া, পেয়ার কিয়াতো ছুপ ছুপ আহে মরণা কেয়া’... সিংহাসনে উপবিষ্ট মুঘল সম্রাট আকবর ও পাশে তাঁর পুত্র শাহজাদা সেলিম। রাজদরবারের নর্তকী আনারকলিকে ভালোবাসেন সেলিম। পিতা আকবর এ প্রেম কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেন না। শুরু হয় পিতা-পুত্রের দ্বন্দ্ব। আনারকলিও প্রেম নিয়ে একপর্যায়ে সাহসী হয়ে ওঠে। একসময় সম্রাট আকবরের সামনে তাকে উদ্দেশ্য করে গেয়ে ওঠেন- ‘পেয়ার কিয়াতো ডরনা কেয়া’। সম্রাটের চোখে-মুখে তখন ক্রোধের আগুন। এ দৃশ্যের কথা হয়তো এখনো দর্শক ভোলেননি। বলিউডের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল ও ব্যবসাসফল ছবি ‘মুঘল-ই-আজম’, যে ছবিটি নির্মাণ করতে লেগেছিল ১৬ বছর। কিন্তু কেন? ১৯৬০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত একটি ঐতিহাসিক রোমান্টিক ভারতীয় চলচ্চিত্র এটি। যার পরিচালনায় ছিলেন ভারতের বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার কে আসিফ এবং প্রযোজনা করেছেন সফররাজ পাল্লোনঝি। দিলীপ কুমার, মধুবালা, এবং পৃথ্বীরাজ কাপুর অভিনীত এ চলচ্চিত্রে মূলত মুঘল শাহজাদা সেলিমের সঙ্গে মহলের নর্তকী আনারকলির প্রেমকে উপজীব্য করা হয়েছে এবং এ অসম প্রেম নিয়ে শেষ পর্যন্ত মুঘল সম্রাট আকবরের সঙ্গে পুত্র সেলিমের সংঘটিত যুদ্ধকে চলচ্চিত্রে তুলে ধরা হয়েছে।
মুঘল-ই-আজম সিনেমায় ব্যবহৃত সব পোশাক দিল্লিতে সেলাই করা হয়েছিল এবং এ পোশাকগুলোতে নকশা খোদাই করা হয়েছিল সুরাটে। হায়দরাবাদে গহনা তৈরি করা হয়েছিল এবং মুকুট তৈরি হয়েছিল কোলহাপুরে। একই সময়ে রাজস্থান থেকে অস্ত্র আমদানি করা হয়েছিল। এ ছবিতে ২ হাজার উট ও ৪ হাজার ঘোড়া ব্যবহার করা হয়েছিল। শীশ মহল সেটে মধুবালার সঙ্গে শুট করা ‘পেয়ার কিয়া তো ডরনা কেয়া...’ গানটি লিখেন শাকিল বন্দউনি। সংগীত পরিচালক নওশাদের অনুমোদন পাওয়ার আগে এটি ১০৫ বার লেখা হয়েছিল। এ গানটি সেই সময়ে ১০ লাখ টাকায় শুট করা হয়েছিল, যা একটি সম্পূর্ণ চলচ্চিত্র তৈরির জন্য যথেষ্ট ছিল। এ গানটি গেয়েছিলেন প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী লতা মুঙ্গেশকর। প্রায় তিন মাস সময় লেগেছিল গানটি রেকর্ড করতে। এ গানের ইকো সাউন্ড তৈরির জন্য বাথরুমে ইকো সাউন্ডের অংশটি ধারণ করা হয়েছিল। কে আসিফ পরিচালিত বলিউডের আইকনিক চলচ্চিত্র মুঘল-ই-আজম ১৯৬০ সালে মুক্তি পায়। বড়পর্দায় প্রেম, আনুগত্য, পরিবার এবং যুদ্ধকে দুর্দান্তভাবে চিত্রিত করা এ সিনেমাটি তৈরির পেছনের গল্পও এ ছবির মতোই অসাধারণ।
সিনেমাটি তৈরি করতে প্রায় ১৬ বছর সময় লেগেছিল। এর নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ১৯৪৪ সালে এবং ১৯৬০ সালে ছবিটি মুক্তি পায়। কিন্তু এত বছর সময় লাগল কেন? কারণ, ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হয়। এরপর দেশের পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন হয় এবং এর প্রভাব পড়ে কে আসিফের এ চলচ্চিত্রের ওপরও। এরই মধ্যে এ ছবির কাস্টও বদল হয় বেশ কয়েকবার। প্রথম কাস্টে আকবরের চরিত্রে চন্দ্রমোহন, সেলিম চরিত্রে ডি কে সাপ্রু এবং আনারকলির ভূমিকায় নার্গিস অভিনয় করেছিলেন।
১৯৪৯ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চন্দ্রমোহন মারা যান। এরপর প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া ছবিটি আবার নতুন কাস্ট নিয়ে কাজ শুরু হয়। যেখানে মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন পৃথ্বীরাজ কাপুর, দিলীপ কুমার, মধুবালা। ছবিটি বিলম্বের ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল। দ্বিতীয় কারণ ছিল, এ ছবির জাঁকজমক সেট। এটি সেই সময়ে সবচেয়ে ব্যয়বহুল চলচ্চিত্র ছিল এবং এর দুর্দান্ত সেটগুলোর জন্য শুটিংয়ের সময় বিশ্বের আলোচনায় পরিণত হয়েছিল। মুঘল-এ-আজমের শুটিং চলাকালীন, শীশ মহলের সেট তৈরি করতে প্রায় দুই বছর লেগেছিল। আসিফ জয়পুরের আমের ফোর্টের শীশ মহল থেকে এর অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন।
ভারতে যে রঙিন কাচ পাওয়া যায় তা তেমন ভালো ছিল না, তাই আসিফ এ সেটের জন্য বেলজিয়াম থেকে কাচের অর্ডার দিয়েছিলেন। খাতিজা আকবর তাঁর জীবনী ‘দ্য স্টোরি অব মধুবালা’তে লিখেছেন- মুঘল-ই-আজমের শুটিংয়ের জাঁকজমক এমন ছিল যে, অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এর শুটিং দেখতে আসেন। এতে চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই, বিখ্যাত উর্দু কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোও ছিলেন, যিনি পরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। এত সময়, ধৈর্য এবং অর্থ ব্যয় করার পর এ ছবিটিও প্রচুর প্রশংসা পেয়েছে। কে আসিফের অনবদ্য পরিচালনা, দুর্দান্ত সেট, চমৎকার সংগীতের জন্য মুঘল-ই-আজম আজও স্মরণীয়।