বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ঠিক পরের বছরই কাজী জহির নির্মাণ করলেন হিন্দু-মুসলিম মেলবন্ধনের প্রেম-প্রীতি-বন্ধুত্বের সুন্দর একটি চলচ্চিত্র ‘অবুঝ মন’। ১৯৭২ সালের ৮ নভেম্বর মুক্তি পায়। চলচ্চিত্রের কাহিনি লিখেছেন চিত্রা সিনহা। বনেদি হিন্দু জমিদার পরিবারের কন্যা মাধবী বন্দ্যোপাধ্যায়, মানে শাবানার সঙ্গে সদ্য ডাক্তারি পাস করা মুসলিম যুবক মাসুম, মানে রাজ্জাকের পরিচয় হয়। প্রথম দর্শনে খুনসুটি-দুষ্টুমিতে অভিজাত পরিবারের নারীর আভিজাত্য আর এলেবেলে ডাক্তারের তীব্র মান-অভিমানবোধ একে অন্যের জিনিস ট্রেনের জানালা দিয়ে ফেলে দেয়। সেই ট্রেন হঠাৎ অচল হয়ে থেমে গেলে রাতের অন্ধকারে অজানা-অচেনা জায়গায় মাসুম আবার মাধবীর আশ্রয় হয়ে ওঠে। মাসুমের অনুরোধে মাধবী গান ধরে- ‘শুধু গান গেয়ে পরিচয়/ চলার পথে ক্ষণিক দেখা/ একি শুধু অভিনয়...।’ একরাশ মুগ্ধ আবেশ ছড়ানো কালজয়ী এ গানটি পদে পদে আক্ষরিক অর্থে এ ছবির অমূল্য চাবিকাঠি হয়ে ওঠে। ‘এই অবুঝ মনে কে যে ক্ষণে ক্ষণে/ চুপি চুপি দোলা দেয়/ ওগো জোছনা তুমি বলো না/ কেন যে উতলা এ হৃদয়...।’ আবেগ ভরা দরদি গানের কথায় যেমন ছবির নামকরণ লুকিয়ে থাকে, আবার একই গন্তব্যের পথিক দুটি হৃদয় একই গ্রামে গিয়ে দুজন দুজনের জন্য উতলা হয়ে ওঠে। মাসুম-মাধবীর প্রেমের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় আজন্মলালিত বনেদি আভিজাত্য আগ্রাসী রক্তের আগুন আর ধর্মীয় সংস্কার। দুজনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল একে অন্যকে ছেড়ে কখনো কিছুতেই যাবে না। মাধবীর বাবার কাতর অনুনয়-বিনয়ের কাছে এবং অসুস্থ হয়ে পড়া বৃদ্ধের প্রাণ বাঁচাতে ডাক্তারি নীতি-ধর্মের কাছে মাসুমকে তবু হার মানতে হয়। যে ট্রেনে চেপে প্রথম আলাপে প্রেমে পড়ে দুজন গ্রামে এসেছিল, একসময় ব্যর্থ প্রেমিক হৃদয় নিঃসঙ্গ একাকী সেই ট্রেনে চেপে গ্রাম ছেড়ে যায়। এ ব্যর্থ প্রেমিকের চরম হৃদয়দগ্ধ ব্যথার প্রতিফলন হয়ে ওঠে একই গানের পরের কথাগুলো- ‘জানি সাঁঝের বেলা ফেলে সকল খেলা/ নীড়ে পাখি ফিরে যায়/ তবু আকাশে, গানের আভাসে/ চলারও কাহিনি লেখা রয়।’ ছবির কাহিনি অন্য রকম অনবদ্য রূপ নেয়। পিতার চাপে বাধ্য হয়ে বিয়ে করা মাধবী বাসর রাতে বরকে নিজের জীবনের সব কথা জানিয়ে দেয়। ফুলের বাসরে কাঁটার দগ্ধ ব্যথায় বিজয়ের জীবনে নেমে আসে কালরাত্রি, অগ্নিপরীক্ষা। বিজয় চরিত্রে কিংবদন্তি অভিনেতা শওকত আকবর অনন্য নজির রেখেছেন। দুই বন্ধুর বন্ধুত্ব এমনই যে দুজন দুজনের জন্য প্রাণপ্রিয়াকে ছেড়ে দিতে প্রস্তুত। মাধবীও এখন শুধু মাসুমকেই চায়। ব্যর্থ সম্পর্কের রিক্ত যন্ত্রণা তুঙ্গে ওঠে। গাড়ি দুর্ঘটনায় বিজয়ের দুটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়। অধ্যাপক-ডাক্তার চরিত্রে খলিলউল্লাহ খান জানিয়ে দেন- এ দুটো চোখ আর কোনো দিন আলো ফিরে পাবে না। ডাক্তার মাসুম কিন্তু বন্ধুর অন্ধ চোখের বন্ধ দুয়ার খুলে আলো ফিরিয়ে দিতে প্রস্তুত। অপারেশনের পর সব জানতে পেরে মাধবীর দুচোখ পানিতে ভেসে যায়। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জমিদার বাবাকে বলে, ‘ধর্ম দিয়ে কখনো মানুষের বিচার করো না। দেখ বন্ধুর জন্য বন্ধু কেমন নিজের চোখ পর্যন্ত দান করে দিতে পারে।’ বিজয় দৃষ্টি ফিরে পায়। সব জানতে পেরে বন্ধু মাসুমকে বুকছাড়া করতে চায় না। মাসুম এবার মাধবীকে বিজয়ের হাতে তুলে দেয়।
ছবির অন্য গানগুলোও ভালো লাগে। গানগুলো রচনা করেছেন মনিরুজ্জামান ও গাজী মাজহারুল আনোয়ার। চিরন্তনী গানে কণ্ঠ দিয়েছেন সাবিনা ইয়াসমিন, আবদুল জব্বার ও ফেরদৌসী রহমান। আহমদ জামান চৌধুরীর চিত্রনাট্য, সংলাপ রচনায় সৈয়দ শামসুল হক, সংগীত পরিচালক আলতাফ মাহমুদ, সুরকার আলতাফ মাহমুদ গীতিকার মনিরুজ্জামান মনির, গাজী মাজহারুল আনোয়ার। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম এ ছবিটি ভারতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উৎসবের জন্য নির্বাচিত হয়েছিল। মুক্তির পর চলচ্চিত্রটি দেখতে হলে দর্শকের ঢল নেমেছিল। চলচ্চিত্রটি টানা ১০০ সপ্তাহের বেশি সময় ধরে প্রদর্শিত হয়ে প্লাটিনাম জুবলী পালন করে। এ চলচ্চিত্রের অন্যতম অভিনেত্রী যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী শাবানা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মুঠোফোনে বলেন, গান গেয়ে পরিচয় হওয়ার ছবি অবুঝ মন। সেই সময়ে হিন্দু-মুসলমানের প্রেম কাহিনি নিয়ে একটি সাহসী ছবি নির্মাণ করেন দক্ষ নির্মাতা কাজী জহির। বেশ উৎসবমুখর আয়োজনে ছবির কাজ করেছিলাম আমরা। ছবিটি যে এমন সাড়া জাগাবে তা প্রথমে বুঝতে পারিনি। তারপর তো বলতে গেলে ‘অবুঝ মন’ বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে আছে। এ চলচ্চিত্রটির কথা শুধু আমি নই, কেউই কোনো দিন ভুলতে পারবে বলে আমার মনে হয় না।