‘বিনি সুতার মালা’ ছবির শুটিং হয় কুয়াকাটা ও সাভারে। ছবির গল্পে ওয়াসিম ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রেম। কিন্তু গ্রামের মোড়ল আমাকে হরণ করে। পায়ে শিকল বেঁধে পালকিতে করে আমাকে বিয়ের জন্য নিয়ে যাচ্ছে। সেই পালকিওয়ালা হলেন ওয়াসিম। তিনি যখন আমাকে দেখেন, দুজনেই কেঁদেকেটে অস্থির। সেই কান্না শুটিং শেষ হলেও আমরা থামাতে পারিনি।
অভিনেত্রী রোজিনা আবারও বলেছেন, তিনি তাঁর পরম বন্ধু ও সহযোগিতাপরায়ণ সহকর্মী অভিনেতা ওয়াসিমকে হারিয়ে আজও ব্যথিত। ২০২১ সালের ১৮ এপ্রিল পরপারে পাড়ি জমান ঢাকাই চলচ্চিত্রের অন্যতম জনপ্রিয় নায়ক ওয়াসিম। দেশীয় চলচ্চিত্রের অন্যতম সার্থক জুটি বলা হয় ওয়াসিম-রোজিনাকে। ৭৫টিরও বেশি ছবিতে তাঁরা জুটি বেঁধেছেন। যা মাইলফলক। বাস্তবেও তাঁরা ছিলেন পরম বন্ধু। রোজিনা বলেন, আমি এখনো ভাবি পরম বন্ধু ওয়াসিমের মৃত্যুর খবর মিথ্যা। ওয়াসিম ভাইয়ের বিদায়ে আমার মনে কষ্টের পাহাড় গড়ে উঠেছে। আর বারবার মনে পড়ে আমাদের অভিনয় জীবনের সোনালি দিনগুলোর কথা। একক নায়িকা হিসেবে আমার প্রথম ছবি ছিল ‘রাজমহল’। ছবিটিতে ওয়াসিম ছিলেন আমার নায়ক। তখন তিনি সুপারস্টার আর আমার পথচলা মাত্র শুরু। তাঁর মতো একজন বড় মাপের অভিনেতার বিপরীতে কাজের প্রস্তাব ছিল স্বপ্নের মতো। আনন্দে আত্মহারা হয়েছিলাম, ভয়ও কাজ করেছিল। পর্দায় ওয়াসিমের সামনে ঠিকভাবে নিজেকে মেলে ধরতে পারব কিনা, এ নিয়ে ভয় ছিল। কিন্তু প্রথম দিনের শুটিংয়েই সব ভয় দূর করে দিয়েছিলেন ওয়াসিম ভাই। গল্প-চরিত্র নিয়ে এমনভাবে আলোচনায় বসেছিলেন, যেন বহুদিনের চেনাজানা আমাদের। তাঁর মতো এত সহজভাবে বন্ধু হয়ে মিশে যাওয়ার ক্ষমতা খুব কম শিল্পীরই আছে। শুটিং শুরু হয় এফডিসির ৪ নম্বর ফ্লোরে। পরিচালক এফ কবির সাহেব পরিচয় করিয়ে দিলেন ওয়াসিমের সঙ্গে। প্রথম পরিচয়েই আপনি বলে ডাকতে শুরু করলেন। অনেক বিনয়ী, ভদ্র ছিলেন। পরে আমি তাঁকে বললাম আপনি না করে তুমি বা তুই করে বললে খুশি হব। তিনি বললেন ধন্যবাদ।
১৯৭৭ সালে ‘রাজমহল’-এর শুটিং করি। মুক্তি পায় ১৯৭৮ সালে। সিনেমাটি ব্যাপক ব্যবসা করে।
‘রাজমহল’ আমার জীবনের গল্পই বদলে দিয়েছিল। ওয়াসিম ভাইয়ের সঙ্গে ৭৫টির মতো ছবিতে কাজ করেছি। তাঁর সঙ্গে কাজ করা ‘জীবন ধারা’ ছবির জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা অভিনেত্রীর সম্মানও পেয়েছি। আমি ওয়াসিম ভাইয়ের সঙ্গে কারও তুলনা করতে চাই না। সে সময় রাজ্জাক, আলমগীর, ফারুক, সোহেল রানা, জাফর ইকবাল ভাই স্ট্যাবলিশড, সুপারস্টার। সবার সঙ্গে আমাদের ফ্রেন্ডলি সম্পর্ক। তবে ওয়াসিম ভাই অন্যরকম আন্তরিক ছিলেন। খোশমেজাজে থাকতেন। অন্যকে হাসিখুশি রাখতে পছন্দ করতেন। দেখা গেল, শুটিংয়ের মধ্যে নিজেই ‘কাট’ বলে আবার অভিনয় শুরু করে দিলেন। ওয়াসিম ভাইকে ঘিরে অনেক স্মৃতি মনের গহিনে জমা আছে। তাঁর সঙ্গে যখন কাজ করতাম, মনে হতো একেবারে বাস্তবে আছি আমরা। যেমন- ‘বিনি সুতার মালা’ ছবির শুটিং হয় কুয়াকাটা ও সাভারে। ছবির গল্পে ওয়াসিম ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রেম। কিন্তু গ্রামের মোড়ল আমাকে হরণ করে। পায়ে শিকল বেঁধে পালকিতে চড়িয়ে আমাকে বিয়ের জন্য নিয়ে যাচ্ছে। সেই পালকিওয়ালা হলেন ওয়াসিম। তিনি যখন আমাকে দেখেন, দুজনেই কেঁদেকেটে অস্থির। সেই কান্না শুটিং শেষ হলেও আমরা থামাতে পারিনি। এরপর ফখরুল হাসান বৈরাগী ভাইসহ অনেকে এসে আমাদের কান্না থামানোর চেষ্টা করেন। এ ছবিতেই আরও একটি দৃশ্য আছে। অন্ধকারে আমি ও ওয়াসিম ভাই দৌড়ে পালাতে থাকি। দুর্ভাগ্যক্রমে আমি পা পিছলে নদীতে পড়ে যাই। বিষয়টি ওয়াসিম ভাই টের পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে পানিতে লাফ দেন। আমি সাঁতার জানতাম না। এদিকে আমাদের দেখে মোড়লের লোকজনও পানিতে ঝাঁপ দেয়। তারা ভাবে, তখনো শুটিং চলছে। পরে ওয়াসিম ভাই বলে, ‘তোমরা থামো, এটা দৃশ্য না। রোজিনা পড়ে গেছে।’ ওয়াসিম ভাই শুধু মিস্টার ইস্ট পাকিস্তানই ছিলেন না, তিনি খুবই স্বাস্থ্য সচেতন ছিলেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। কখনো মদের ধারেকাছেও যাননি। এমনকি সিগারেটও পান করতেন না। অত্যন্ত বিনয়ী ভদ্র নম্র্র স্বভাবের একজন পরিপূর্ণ মানুষ ছিলেন তিনি। ওয়াসিম ভাইয়ের সঙ্গে বেশি ছবি করার কারণ- তাঁর সঙ্গে আমার রসায়নটা দর্শক গ্রহণ করেছিল, তাই নির্মাতারাও আমাদের চাইতেন। নিজেদের ভিতর বোঝাপড়াটা ভালো ছিল, একাত্মতা ছিল। ছবিও ভালো ছিল। সব মিলিয়ে প্রযোজকরা ভাবতেন, আমাদের নিলেই ছবি ব্যবসা সফল হবে। সে জন্যই বেশি ছবি করা। ওয়াসিম ভাই সেটের মধ্যে গম্ভীর মুখে বসে থাকতে পারতেন না। বড্ড হাসিখুশি ও পরিপাটি স্বভাবের একজন অসাধারণ মনের মানুষ ছিলেন তিনি। ছবির সেটে জোঁক বলে সবাইকে হাসাতেন। নেশা জাতীয় কিছু পান করতেন না। নামাজ-রোজায় মনোযোগী ছিলেন। কাউকে কখনো মনে কষ্ট দিয়ে কথা বলেননি। পরিপূর্ণ একজন ভালো মানুষ ছিলেন। ওয়াসিম ভাই আপনি যেখানেই থাকুন, বিধাতা যেন আপনাকে শান্তিতে রাখেন- এই আমার প্রার্থনা।