জুনায়েদ হালিম
[চলচ্চিত্র গবেষক ও শিক্ষক]
বর্তমানে চলচ্চিত্রে বিনিয়োগ হচ্ছে ওয়ান কাইন্ড অব গ্যাম্বলিং। যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। প্রেক্ষাগৃহ সংকট চলচ্চিত্রের মন্দ ব্যবসার অন্যতম একটি কারণ। '৯০/৯১ সাল পর্যন্ত দেশে প্রায় সাড়ে বারশ' প্রেক্ষগৃহ ছিল। তাতে সপ্তাহে দুই-তিনটি ছবি মুক্তি পেত। তা থেকে বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত আসত। এখন বড় জোর সাড়ে তিনশ' প্রেক্ষাগৃহ আছে। এ অবস্থায় এক কোটি টাকা বিনিয়োগ করে একটি ছবি নির্মাণ করলে সেই টাকা ফেরত আসবে কোথা থেকে।
ছয় বছর আগে মুক্তি পাওয়া 'মনপুরা' ছবিটির কথাই বলি। ছবিটি যে বাণিজ্যিক সফলতা পেয়েছিল এবং যে উচ্চতায় উঠেছিল সেই তুলনায় অর্থ ফেরত আনতে পারেনি।
কারণ প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা কম। আরেকটি ঝুঁকি হচ্ছে বিপণন ও প্রদর্শনের ক্ষেত্রে অব্যবস্থা। ১০০ টাকার একটি টিকিট থেকে প্রযোজক পায় মাত্র ২০ টাকার মতো। ৫০ ভাগের বেশি নিয়ে নেয় প্রেক্ষাগৃহ মালিক। বাকিটা কর হিসেবে পায় সরকার। মধ্যখানে আবার নির্মাতা ও প্রেক্ষাগৃহ থেকে বড় অঙ্কের কমিশন নেয় বুকিং এজেন্টরা। ফলে এক কোটি টাকা ব্যয়ে একটি ছবি নির্মাণ করলে সেই টাকা ফেরত আসার সুযোগ কোথায়? তাই এই ব্যবসা এখন পুরোপুরি ঝুঁকিপূর্ণ। আরেকটি বিষয় হচ্ছে যোগাযোগের অব্যবস্থার কারণে যানজটে পড়ে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টার একটি ছবি দেখতে দর্শককে ব্যয় করতে হচ্ছে ৫ ঘণ্টারও বেশি সময়। প্রেক্ষাগৃহের পরিবেশও ভালো না। ফলে ছবি দেখার আনন্দ পরিণত হচ্ছে ভোগান্তিতে। তাই দর্শক প্রেক্ষাগৃহে যেতে বিরক্তবোধ করে। এতে চলচ্চিত্র ব্যবসা এখন বিলুপ্তির পথে। সম্প্রতি এক কোটি পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে 'মেঘমল্লার' ছবিটি নির্মাণ করেছি। এখন পর্যন্ত চার লাখ টাকাও ফেরত পাইনি।
এই ব্যবসায়িক ঝুঁকি থেকে মুক্তি পেতে প্রয়োজন প্রাইভেট পাবলিক জয়েন্ট ভেঞ্চারে গিয়ে প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা বাড়ানো। প্রেক্ষাগৃহকে সামাজিক মিলনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। মানে সিনেপ্লেক্স নির্মাণের বিকল্প নেই। যেখানে থাকবে বহুমুখী সংস্কৃতিক কার্যক্রম থেকে শুরু করে নানা বিনোদন। না হলে চলচ্চিত্রের বিনিয়োগ ঝুঁকির মধ্যেই থেকে যাবে।
অনুপম হায়াৎ
[চলচ্চিত্র সাংবাদিক, গবেষক]
চলচ্চিত্র ব্যবসা এখন ঝুঁকিযুক্ত। এখন চলচ্চিত্রে ভালো কাহিনী, নির্মাণ, অভিনয়, উপস্থাপনা, কারিগরিমানসহ কোনো বৈচিত্র্য নেই। শুধু ডিজিটাল বললে তো হবে না। যথাযথ প্রযুক্তির অনুসরণ করতে হবে। এখন উম্মুক্ত আকাশ সংস্কৃতি আর বাজারের যুগ। ঘরে বসে নেট, ইউটিউব, মোবাইলসহ নানা মাধ্যমে ছবি ডাউনলোড করে দেখা যায়। গুলিস্তানের ফুটপাতে যদি ১০ টাকা দিয়ে ছবির পাইরেটেড সিডি কিনতে পাওয়া যায় তাহলে ১০০ টাকা খরচ করে দর্শক প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে ছবি দেখবে কেন? বর্তমানে দেশে মাত্র ৩২২টির মতো প্রেক্ষাগৃহ রয়েছে। তাই কোটি টাকা ব্যয় করে ছবি নির্মাণ করে সেই টাকা তুলবে কোথা থেকে। এসবের সঙ্গে মেধাহীনতাও জড়িত। এখন সুভাষ দত্ত, খান আতা, জহির রায়হান, মিতা, সালাউদ্দীন, আমজাদ হোসেনের মতো নির্মাতা কোথায়? সুভাষ দত্তের 'সুতরাং' নির্মাণ হয়েছিল এক লাখ ৩০ হাজার টাকা দিয়ে। আর ছবিটি ব্যবসা করে প্রায় সাড়ে আট লাখ টাকার। ঢালিউডের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ব্যবসা সফল ছবি হচ্ছে 'বেদের মেয়ে জোছনা'। ১৯৮৯ সালে অর্ধলক্ষ টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ ছবিটি ব্যবসা করে কয়েক কোটি টাকার। এ সাফল্যের পিছনে কাজ করেছে ব্যবসায়িক প্রটেকশন ও মান। চলচ্চিত্রের ব্যবসা ঝুঁকিমুক্ত করতে হলে দরকার বিষয়বস্তুর পরিবর্তন, আকাশ সংস্কৃতি ও নানা মাধ্যম সীমিতকরণ, প্রযুক্তির উন্নয়ন, সার্ভার সিস্টেমে প্রদর্শন, সিনেপ্লেক্স নির্মাণ ও পাইরেসি রোধ।
মিয়া আলাউদ্দীন
[সাধারণ সম্পাদক, চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি]
চলচ্চিত্র ব্যবসা এখন শতভাগ ঝুঁকিপূর্ণ। ভালো গল্প, নির্মাণ ও অভিনয়ের অভাবে চলচ্চিত্র ব্যবসায় ধস নেমেছে। অবাধ আকাশ সংস্কৃতি ও নেটের প্রচলনও এর জন্য দায়ী। যতদিন স্যাটেলাইট চ্যানেল নিয়ন্ত্রণ করা না যাবে ততদিন এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে না। আগে ভারতের কয়েকটি বাংলা ছবি এনেছি। কিন্তু সেগুলো আগেই ঘরে বসে দর্শক ডিস লাইন ও সিডিতে দেখেছে। তাই প্রত্যাশিত সাড়া পাওয়া যায়নি। এখন হিন্দি 'ওয়ান্টেড' মুক্তি দেব। সেটিও ব্যবসা করবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। কারণ ছবিটি ডিস ও সিডিতে দর্শক আগেই দেখে ফেলেছে। এ ছাড়া প্রেক্ষাগৃহের নিম্নমানের পরিবেশের কারণে দর্শক ছবি দেখতে যেতে পারে না। অনেকের মতে প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা কমে যাওয়াতে ছবি ব্যবসা করে না। কথাটির সঙ্গে আমি একমত নই। কারণ ভালো ছবি হলে একটি প্রেক্ষাগৃহে দীর্ঘদিন তা প্রদর্শন হয় এবং মুনাফাসহ পুঁজি ফেরত আসে। এর অন্যতম উদাহরণ বলিউডের 'দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে'। তাই ভালো গল্প, অভিনয়, নির্মাণ এবং প্রেক্ষাগৃহের উন্নত পরিবেশ ছাড়া চলচ্চিত্র ব্যবসাকে ঝুঁকিমুক্ত করা যাবে না।
দেলোয়ার জাহান ঝন্টু
[সভাপতি : চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি]
ভালো গল্প ও শিল্পীর অভাবে চলচ্চিত্র ব্যবসা এখন ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। প্রযোজকরা এই খাতে আর বিনিয়োগ করতে চায় না। এখনকার নির্মাতারা তামিল ছবির গল্প কপি অর্থাৎ নকলের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। দেশীয় প্রখ্যাত গল্পকারদের গল্প তারা নেয় না এবং চরিত্র অনুযায়ী কাস্টিং করে না। ফলে এসব ছবি দর্শক দেখে না। এতে চরম লোকসান গুনতে হয় প্রযোজককে। তাই প্রযোজকরা নির্মাণ অর্থাৎ এই খাতে বিনিয়োগে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। ছবি ও দর্শকের অভাবে সিংহভাগ প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হয়ে গেছে। এ অবস্থার উন্নয়নে দেশের খ্যাতনামা সাহিত্যিকদের কাছ থেকে গল্প নিতে হবে, যোগ্য অভিনয় শিল্পী কাস্ট করতে হবে এবং প্রেক্ষাগৃহের পরিবেশ উন্নত করতে হবে।
খোরশেদ আলম খসরু
[সাবেক সি. সহ-সভাপতি, চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতি]
যতক্ষণ পর্যন্ত না পাইরেসি নির্মূল করা যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত চলচ্চিত্রে বিনিয়োগ চরম ঝুঁকির মধ্যে থাকবে। পাশাপাশি ইউটিউব আর নেটে মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে ছবি চলে আসছে। এ অবস্থায় চলচ্চিত্রের ব্যবসা নিরাপদ হবে কিভাবে। প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা উদ্বেজনক হারে কমে গেছে। যেগুলো আছে তার মধ্যে বেশির ভাগেরই পরিবেশ ভালো নেই। এ অবস্থায় কোটি টাকা ব্যয়ে একটি ছবি নির্মাণ করে তা যদি চালানো না যায় তাহলে প্রযোজক লাভের মুখ দেখবে কিভাবে। বর্তমানে প্রেক্ষাগৃহে ডিজিটালের নামে ইলেকট্রিক্যাল প্রজেক্টর বসিয়ে দর্শকদের ধোঁকা দেওয়া হচ্ছে। ডিজিটাল চলচ্চিত্রের নামে টেলিফিল্ম বানিয়ে দর্শকদের বোকা বানানো হচ্ছে। কিন্তু দর্শক এখন সচেতন। মানসম্মত গল্প, নির্মাতা আর অভিনয় শিল্পীর এখন বড়ই অভাব। গল্পের ফর্মুলা তত্ত্ব এখনো চারটি ফাইট আর ছয়টি গানে আটকে আছে। মৌলিক গল্প নিয়ে ছবি নির্মাণ করতে হবে। আর সত্যিকারের অভিনয় শিল্পী নিয়ে ছবি বানাতে হবে।